এস এম রানা: পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ‘সমন্বয়কারী’ ও খুনের ঘটনাস্থলে উপস্থিত কামরুল ইসলাম ওরফে মুছা সিকদারকে নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ দাবি করেছে, তিনি পলাতক। কিন্তু পরিবারের দাবি, পুলিশ তাঁকে তুলে নিয়ে গেছে। অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করার জন্য মুছাকে ঢাকায় নেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে তাঁকে আর চট্টগ্রামে ফিরিয়ে আনা হয়নি। এখন সন্দেহ করা হচ্ছে, মুছাকে আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি তাঁকে পাওয়া না যায় তাহলে খুনের নির্দেশদাতা সম্পর্কে তথ্য জানার পথও রুদ্ধ হয়ে যাবে। জবানবন্দিতে যেখানে আসামিরা মুছাকে সমন্বয়কারী বলছে, সেখানে একমাত্র তিনিই পরিকল্পনাকারীর নাম বলতে পারতেন। ফলে মুছার ‘নিখোঁজ’ হওয়ার অর্থ দাঁড়াবে, এ খুনের রহস্য আর কখনোই উন্মোচিত না হওয়া।
অসমর্থিত সূত্রে আরো জানা গেছে, মুছার পরিবারও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) কবজায় রয়েছে। তাঁকে গুম করে ফেলা হয়েছে কি না এখন এই সন্দেহও ঘুরপাক খাচ্ছে। মুছাকে গুম করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে কি না, এমন প্রশ্ন করা হলে সিএমপি কমিশনার মো. ইকবাল বাহার বলেন, ‘মুছাকে গ্রেপ্তারই করা হয়নি। পুলিশ মুছাকে খুঁজছে। যদি মুছার মৃতদেহও পাওয়া যেত, তাহলেও মামলার একটা গতি হতো।’ মুছা সিকদারকে ‘পুলিশ তুলে নিয়েছে’ পরিবারের এমন দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশ মুছাকে তুলে নেবে কেন? তাকে খোঁজা হচ্ছে, পেলে গ্রেপ্তার করবে।’ মুছার পরিবারকে নগর পুলিশের কবজায় নেওয়া হয়েছে এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ ঈদ খরচের জন্য টাকা দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘সিএমপি কেন ঈদ খরচ দেবে? কেউ ব্যক্তিগতভাবে সদয় হয়ে কিছু করলে এটা ভিন্ন কথা।’ মুছার পরিবারকে নগর পুলিশ লাইনে রাখা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না।’ তিনি বলেন, ‘মুছার পরিবার কোথায় সেটা আপনারা (প্রতিবেদক) খুঁজে বের করতে পারেন।’
গত ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরের জিইসি মোড় এলাকায় ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করা হয় এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তারা বাবুলকে চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে বাবুল আক্তার সাফল্য দেখিয়েছেন, সে কারণে ক্ষিপ্ত হয়ে জঙ্গিরা তাঁর স্ত্রীকে হত্যা করে থাকতে পারে। তদন্তের প্রথম দিকে জঙ্গিদের সন্দেহ করা হলেও পরবর্তী সময়ে পুলিশ সে অবস্থান থেকে সরে আসে। এর মধ্যে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখাও এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে দাবি করে, তারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়নি। মিতু হত্যা মামলায় মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম ও মো. আনোয়ার নামের দুজনকে গ্রেপ্তারের পর গত রবিবার চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কমিশনার সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই সময় তিনি জানান, খুনে অংশ নেওয়া আসামিরা সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্য। তারা পেশাদার অপরাধী। তবে কার নির্দেশে তারা খুনে অংশ নিয়েছিল তা বলা যাচ্ছে না।
ওই দুজনকে শনিবার আটক করা হয় বলে পুলিশ জানায়। রবিবার উভয়েই আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে খুনের দায় স্বীকার করে। জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানিয়েছিল, সে গুলি করে মিতুর মৃত্যু নিশ্চিত করে। আর ঘটনার সময় আনোয়ার রেকি করে। আর মুছা নামের একজন সোর্স তাদের পাঁচ-সাত লাখ টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ভাড়া করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় মুছাও ঘটনাস্থলে ছিলেন। জবানবন্দিতে ওই দুই আসামি যে এমন কথা বলেছিল তা নিশ্চিত করেছিলেন সিএমপি কমিশনার মো. ইকবাল বাহার। কিন্তু ওই আসামিদের জবানবন্দির আগেই গত শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানীর মেরাদিয়া এলাকার শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে নিয়ে যায় পুলিশ। তাঁকে ১৫ ঘণ্টা ধরে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করা হয়। পরদিন বিকেলে বাবুল আক্তার বাসায় ফেরেন। তবে তাঁকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ’ করার বিষয় নিয়েও নানা বিভ্রান্তি রয়েছে।
এরপর গত সোমবার রাত ও মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে আটক করা হয় এহতেশামুল হক ভোলা ও মনির হোসেনকে। তাদের কাছ থেকে মিতু হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দুটি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, মুছা সিকদার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেশাদার সোর্স। ভোলাও পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বলে জানা গেছে। বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবেও কাজ করেছেন মুছা। তবে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সোর্স হয়েও মুছা কেন মিতু হত্যাকাণ্ডে জড়িয়েছেন, সেই প্রশ্নের কোনো উত্তর এখনো দেয়নি পুলিশ।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মিতু হত্যাকাণ্ডের সমন্বয়কারী মুছা। টাকার বিনিময়ে খুনি ভাড়া করে ও অস্ত্র জোগাড় করে খুনের ঘটনা ঘটিয়েছেন তিনি। হত্যাকাণ্ডেও মুছা অংশ নিয়েছেন এবং খুনের পর মোটরসাইকেল চালিয়ে পালিয়ে যান। খুনের ঘটনায় অন্তত সাতজন অংশ নিয়েছে। গত শুক্রবার পর্যন্ত পুলিশ দাবি করেছিল, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা তাদের নজরদারিতে রয়েছে। যেকোনো সময় তাদের ধরে ফেলা হবে। অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, মুছা সিকদারকে আগেই আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ করে তাঁর ভাষ্যও রেকর্ড করা হয়। সর্বশেষ মুছাকে অন্য কয়েকজন সন্দেহভাজন আসামির সঙ্গে ঢাকায় নেওয়া হয় বাবুল আক্তারের মুখোমুখি করার জন্য। কিন্তু সেখান থেকে বাকিদের ফিরিয়ে আনা হলেও মুছাকে চট্টগ্রামে আনা হয়নি।
এদিকে গতকাল বুধবার মিতু হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচ সন্দেহভাজনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় মুছার নামও আছে। মুছা ছাড়া অন্যরা হলো রাশেদ, নবী, শাজাহান ও কালু। তারা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য দেশের সব বিমান, স্থল ও নৌবন্দরে তাদের ছবিসহ অন্যান্য তথ্য পাঠানো হয়েছে। ‘নিরুদ্দেশ’ হয়ে যাওয়া মুছা সিকদার পরিবার নিয়ে থাকতেন নগরের বাকলিয়া থানা এলাকায়। তাঁর গ্রামের বাড়ি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের রানীরহাট এলাকায়। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর মুছা সিকদারের স্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, তাঁর স্বামীকে পুলিশ ‘তুলে’ নিয়ে গেছে। এ নিয়ে ২২ জুন স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এর পর থেকে মুছার সঙ্গে পরিবারের আর যোগাযোগ হয়নি। আর দুই-তিন দিন ধরে মুছার পরিবারের হদিসও পাওয়া যাচ্ছে না। নগরের বাকলিয়া ও গ্রামের বাড়িতে গিয়েও সাংবাদিকরা পরিবারটির হদিস পায়নি। এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে বাকলিয়া থানার ওসি আবুল মনসুর জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। মিতু হত্যাকাণ্ডের পর মুছার নাম উঠে আসায় থানা পুলিশের এ বিষয়ে কিছু করণীয় ছিল কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমন দায়িত্ব আমাকে কেউ দেয়নি। আমি কিছু জানি না।’
কে এই মুছা : মুছা সিকদারের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর ইউনিয়নের রানীরহাট এলাকায়। তাঁর বাবার নাম মৃত শাহ আলম সিকদার। ৯ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় মুছা দীর্ঘদিন সৌদি আরব প্রবাসে ছিলেন। ২০০০ সালের শুরুর দিকে দেশে ফিরে চাচাতো বোনকে বিয়ে করেন। এলাকায় ফিরে ওই সময় চারদলীয় জোটের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছত্রচ্ছায়ায় থাকার সুযোগ হয় মুছার।
ওই সময় উত্তর রাঙ্গুনিয়ায় মুছা ও তাঁর ‘বাহিনী’ নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়েছিল বলে প্রচার আছে। এরপর পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য সংস্থার সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করেন মুছা। সোর্স হিসেবে কাজ শুরু করার পর মুছা এলাকায় তাঁর প্রতিপক্ষকে পুলিশ-র্যাব দিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো, ‘ক্রসফায়ারের’ নেপথ্যে ভূমিকা রাখার অভিযোগও আছে। সোর্স হিসেবে কাজ করার সুবাদে রাঙ্গুনিয়া ছাড়াও রাউজান, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ি উপজেলার অপরাধীদের সঙ্গে মুছার সখ্য তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে নিজেই বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। পেশাদার পুলিশের সোর্স মুছাকে পুলিশ কর্মকর্তারা ব্যবহার করতেন। সেভাবে বাবুল আক্তারও সোর্স হিসেবে কাজে লাগান মুছাকে। মুছা সিকদার ২০০৯ সালে সেনাবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ আটক হন। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকা ছেড়ে চট্টগ্রাম নগরের কালামিয়া বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় ওঠেন। কালামিয়া বাজারে থাকার সময়ই মুছা ইয়াবা ও অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন বলে পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এসপি বাবুলকে নিয়ে গুঞ্জন বাড়ছে : আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার পদত্যাগ করেছেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়েছে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কেউই গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। অন্যদিকে স্ত্রী হত্যায় বাবুলের ‘সংশ্লিষ্টতা’ নিয়ে যে আলোচনা চলছে, ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরা এ বিষয়ও বিশ্বাস করতে রাজি নন। ঘটনার আগের রাতে অফিসার্স মেসে বাবুল সহকর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক আড্ডা দিয়েছেন বলে অনেকে দাবি করেছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, এসপি বাবুল আক্তার পদত্যাগ করেছেন এবং সেই চিঠি মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে বলে গতকাল সকাল থেকে আলোচনা হয়। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলেও অনেকের অভিমত। কিন্তু পরে কেউই এ বিষয়ে ‘সঠিক তথ্য’ জানেন না বলে দাবি করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গতকাল অনুষ্ঠিত দুটি সভায় যোগ দেন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁদেরই একজন বলেন, ‘৫ জুন ভোরে বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়। আগের রাতে বাবুল আক্তার অফিসার্স মেসে ছিলেন। কয়েকজন ব্যাচমেট রাত ২টা পর্যন্ত আড্ডা দেন। সে সময় বাবুল আক্তারকে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত দেখা গেছে।’ স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার বিষয়ে বাবুল আক্তার নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তের একপর্যায়ে গত শুক্রবার রাতে পুলিশ বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে যায়। ১৪ ঘণ্টা পর তিনি শ্বশুরালয়ে ফেরেন। এ ঘটনার পর থেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার পাচ্ছে, স্ত্রী হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে বাবুলকে সন্দেহ করা হচ্ছে। এমনকি জিজ্ঞাসাবাদের নামে চাপ দিয়ে বাবুল আক্তারের কাছ থেকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায়।
মিতু হত্যার পর থেকেই বাবুল আক্তার সন্তানসহ অবস্থান করছেন ঢাকায় শ্বশুরালয়ে। এ পরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে আবেদন করা হবে বলে জানা গেছে। হত্যায় বাবুলের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে ন্যূনতম সন্দেহ করছেন না স্বজনরা। বাবুলের পদত্যাগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্বশুর মোশাররফ হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।-কালের কন্ঠ
৩০ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ