সাহাদাত হোসেন পরশ: পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার। স্ত্রীকে হত্যার পর তিনিই খুনের মামলার বাদী হয়েছেন। মামলার বাদী হিসেবে স্বাভাবিক কারণে তদন্তের অগ্রগতি ও আনুষঙ্গিক ব্যাপারে তারই 'দৌড়ঝাঁপ' করার কথা ছিল। শুধু স্বামী হিসেবে নন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবেও তিনি তদন্তে অনেক সহায়তা করতে পারতেন। তবে এখন দৃশ্যপট পুরোপুরি উল্টো। ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকে পাল্টে যায় পুরো পরিস্থিতি। মামলার বাদী সন্দেহের কাঠগড়ায়! গত ছয় দিন শ্বশুরের বাসা থেকে একবারের জন্যও বের হননি তিনি। একটি কক্ষেই কাটছে তার দিনরাত। প্রকাশ্যে গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথাও বলছেন না। ঘরে বাবুল কার্যত 'বন্দি' থাকলেও বাইরে নানা গুঞ্জন আর উল্টো হাওয়া। গত কয়েক দিন এসবের জবাব দিচ্ছেন তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। এখনও মেয়ের জামাইয়ের ওপর অগাধ আস্থা তার।
পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাবুলকে আবারও ডাকা হতে পারে। তবে মিতু হত্যায় পুলিশের সন্দেহে তার জামাতা। শ্বশুর বলছেন, মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে বাবুলের কথা বলার ক্ষেত্রে 'বিধিনিষেধ' রয়েছে। কয়েক দিন গণমাধ্যমে তার এমন বক্তব্য প্রকাশিতও হয়েছে। তবে এখনও পুলিশের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়নি, সত্যি সত্যি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে বাবুলের ওপর কোনো চাপ রয়েছে কি-না। এমনকি 'কঠিন সত্য' বেরিয়ে এলো যে পরিস্থিতিতে মামলার বাদীই এখন সন্দেহে রয়েছেন। এমন বাস্তবতায় মূল পরিকল্পনাকারী কে, হত্যার মোটিভ কী_ এ প্রশ্নে পুলিশ যেমন নিশ্চুপ; তেমনি বাবুল কেন বাদী হিসেবে সন্দেহের তালিকায় তা নিয়েও কেউ মুখ খুলছেন না। পুলিশ প্রশাসন ও বাবুল আক্তার নিশ্চুপ থাকায় ধূম্রজাল আরও বাড়ছে।
মিতু হত্যার ব্যাপারে নানা প্রশ্ন উঠলেও পুলিশের পক্ষ থেকে এখনও পরিষ্কার কোনো বক্তব্য দেওয়া হয়নি। সংবাদমাধ্যমে বাবুল আক্তার পুলিশে থাকা-না থাকার বিষয়েও নানা ধরনের খবর বের হচ্ছে। এ নিয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল কেউ কোনো মন্তব্যও করেননি। এদিকে পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যারহস্য পুরোপুরি উদ্ঘাটনে আবারও বাবুলকে 'ডেকে' নেওয়া হতে পারে। শুধু মামলার বাদী হিসেবে নয়, কিছু তথ্য যাচাই-বাছাই করতে তার সঙ্গে ফের 'কথা' বলবেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। এবার পুলিশের অন্য একটি দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে। তবে এ ব্যাপারে এখনই চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, মিতু হত্যার ঘটনায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এরই মধ্যে পুলিশের হাতে রয়েছে। তবে এসব তথ্য এখন 'আলোর মুখ' দেখবে কি-না, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলছেন না তারা। মিতু হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সম্প্রতি যেসব ঘটনাপ্রবাহ সামনে আসছে, তা নিয়ে পুলিশের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, যে কোনো 'কঠিন' সত্যকেই সামনে আনা জরুরি। এটা পুলিশ বাহিনীর ইমেজের সঙ্গে জড়িত। যদি ব্যক্তিগত কোনো ঘটনা মিতু হত্যার নেপথ্যে কাজ করে থাকে, তাহলে তা এখন সামনে আনা জরুরি। আর কোনো পক্ষ যদি বিষয়টি ভিন্ন খাতে নিতে অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে, তাহলেও সেটি প্রকাশ করা উচিত। গত ২৪ জুন খিলগাঁওয়ের মেরাদিয়ার ভুঁইয়াপাড়ার বাসা থেকে গভীর রাতে বাবুলকে তুলে নিয়ে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাসায় পৌছে দেওয়া হয়। এ সময় তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের কমিশনার ইকবাল বাহার, পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এবং পুলিশ সদর দপ্তরের একজন অতিরিক্ত ডিআইজি।
তারা পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নির্দেশে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রক্রিয়া নিয়েও কিছু প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি পুলিশের কেউ কেউ বলছেন, শুধু মামলার বাদী হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে অন্যভাবে বাবুলকে ডাকা যেত। এ ছাড়া বাবুল আক্তারের সঙ্গে বিকল্পভাবে কথা বলা যেত। আর কিছু তথ্য নিয়ে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে কেন তাকে এই প্রক্রিয়ায় ছেড়ে দেওয়া হলো, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের অনেক কর্মকর্তার মন্তব্য, মিতু হত্যার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে পুলিশের কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুখ না খুললেও গত কয়েক দিন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মুখে মুখে এ বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্যকে তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছেও বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, মিতু হত্যার পর পরই স্বাভাবিক কারণে পুলিশ সদস্যদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করেন। তারা হামলাকারীদের 'উপযুক্ত' জবাব দেওয়ার 'পরিকল্পনা' করেন। তবে 'কিছু তথ্যের' ভিত্তিতে বাবুলকে ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে পাল্টে যেতে থাকে দৃশ্যপট। মিতু হত্যা ঘিরে পুলিশ মামলার বাদীকে সন্দেহ করতে থাকে। মিতু ইস্যুতে বাবুলকে নিয়ে গণমাধ্যমে ধারাবাহিক খবর প্রকাশের ঘটনায় পুলিশ ও সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, বাবুল আক্তার জড়িত থাকলে তাকে দ্রুত গ্রেফতার করা জরুরি। আবার কারও মন্তব্য, জড়িত না থাকলে তাও গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানানো উচিত। তবে এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, গোয়েন্দারা কাজ করছেন। তিনি প্রকৃত তথ্য বের হওয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু অপেক্ষা করার কথা বলেছেন ।
বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেছেন, তদন্ত অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। আমার মেয়ে কোনো চাকরি বা ব্যবসা করত না। কিন্তু পুলিশের তদন্তকারীরা হত্যাকান্ডের তদন্তের মূল জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে বা এড়িয়ে যাচ্ছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, মিতু হত্যার ব্যাপারে কোনো তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হলে বাবুলকে প্রয়োজন হলে তদন্ত সহায়ক টিম রয়েছে। তারাই সিদ্ধান্ত নেবে। এই মামলায় মোটিভ স্পষ্ট করাসহ অন্য আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।-সমকাল
১ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ