মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু: মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে মহলবিশেষের প্রোপাগান্ডা থামছে না। অফ দ্য রেকর্ডের নামে আইনশৃংখলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র থেকে সাংবাদিকদের নানাভাবে তথ্য দেয়া হচ্ছে। যারা এসব তথ্য দিচ্ছেন তারা এখনও নিশ্চিতভাবেই বলছেন চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে এসপি বাবুলের হাত রয়েছে। কিন্তু এর সপক্ষে তারা প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত যেমন সংবাদমাধ্যমকে দিচ্ছেন না, তেমনি জনসম্মুখেও প্রকাশ করছেন না। ওদিকে এমনও তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যে, ডিবি অফিসে জিজ্ঞাসাবাদের সময় সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসপি বাবুল আক্তারের কাছ থেকে তার পদত্যাগ পর্যন্ত নিয়ে নিয়েছেন। তাকে শর্ত দিয়ে বলা হয়, স্ত্রী মিতু হত্যা মামলায় আসামি হতে না চাইলে চাকরি ছাড়তে হবে। অগত্যা চাকরি ছাড়ার প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন বাবুল আক্তার। খুনের মামলার বোঝাপড়া এমনও হতে পারে, এটিও এখন সবাইকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে!
এদিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে পনেরো দিন আগে বাবুল আক্তারকে গভীর রাতে ডিবি অফিসে নেয়ার পর থেকে নানা রকম গল্পের যেন শেষ নেই। আবার এ কথাও সত্য যে, এসব গল্প সাংবাদিকরা নিজের থেকে বানিয়েও লিখছেন না। যাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তারা আর দশটা খুনের ঘটনার রিপোর্ট যেভাবে করে থাকেন, এটিও তেমন। কিন্তু মিতু হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ফারাকটা হল, অন্য কোনো ঘটনায় পুলিশের সূত্রগুলো অফ দ্য রেকর্ডে তথ্য দিলেও তা প্রকাশের পর এ রকম বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় না। কোনো প্রশ্ন দেখা দিলে বিষয়টি দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে স্পষ্ট করা হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি ভিন্ন। চাঞ্চল্যকর এ মামলাটির তদন্তের শুরুতেই বলা হল- এটি জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কাজ। পুলিশ ও পুলিশ পরিবারের মনোবল ভেঙে দিতে এভাবে আঘাত করা হচ্ছে। এ জন্য বাবুল আক্তারের মতো একজন সৎ ও সাহসী অফিসারের পরিবারকে বেছে নেয়া হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে আবিষ্কার হল এটি শিবির ক্যাডারদের কাজ। রীতিমতো একজন ধরাও হল। যিনি স্থানীয় একটি মাজারের খাদেম বলে পরিচিত।
কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই গ্রেফতার নিয়ে মাজার পরিচালনাকারী একটি পক্ষ তা প্রত্যাখ্যান করায় ওই চেষ্টা তেমন একটা হালে পানি পায়নি। ওই সময় এ ঘটনায় আরও কয়েকজনকে আটকের খবর নামসহ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও পুলিশের পক্ষ থেকে তা স্বীকার করা হয়নি। যদিও পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে থেকে দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। আবার এটাও মেনে নিতে হচ্ছে যে, যারা খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে তারা নির্দেশদাতা কিংবা পরিকল্পনাকারীর নাম-পরিচয় জানে না। চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি নিয়ে এই যখন অবস্থা তখন গত ১৫ জুন রাতের পর থেকে একেবারে ইউটার্ন নেয়। মাহমুদা খানম মিতুর স্বামী মামলার বাদী এসপি বাবুল আক্তারকে গভীর রাতে ডিবি অফিসে ডেকে নিয়ে রীতিমতো আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়।
জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাকে তার পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে ছাড়া হয় ১৫ ঘণ্টা পর। ওই জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকে পানি ক্রমেই ঘোলা হতে থাকে। প্রথমত. গভীর রাতে বাবুল আক্তারকে এভাবে ডেকে নিয়ে জনগণের মধ্যে একটি নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেয়া হয়। তারপর তো একেবারে কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়াই আইনশৃংখলা বাহিনীর সূত্রগুলো থেকে বলা হল, এ হত্যাকাণ্ডের জন্য বাবুলই দায়ী। প্রথমে বলা হচ্ছিল, মিতুর পরকীয়ার কারণে বাবুল তার সোর্স মুসাকে ব্যবহার করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এরপর ছড়ানো হল স্ত্রীর না, বাবুলের পরকীয়ার কারণে মিতুকে এভাবে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া এসপি বাবুলের চাকরি আদৌ আছে কিনা তাও অনেকটা ধাঁধার মধ্যে রয়েছে। কেননা, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাকে চাকরি ছাড়ার শর্ত দিয়ে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর পর্যন্ত নেয়া হয়, যা এখন আইনশৃংখলা বাহিনীর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সংরক্ষিত আছে।
এমনকি পর্দার আড়াল থেকে যেসব সূত্র মিডিয়াতে তথ্য দিচ্ছেন তারা সম্প্রতি কম্পিউটার কম্পোজ করে সাংবাদিকদের কাছে বাবুলের বিরুদ্ধে সবিস্তারে বিস্মিত হওয়ার মতো নতুন নতুন তথ্যও দিচ্ছেন। যে এসপি বাবুল আক্তার সাহসী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে গত কয়েক বছরে একাধিক রাষ্ট্রীয় পদক পেয়েছেন তাকে এখন শিবিরের সাবেক ক্যাডার বানানোর চেষ্টাও হচ্ছে। আর যারা এসব তথ্য দিচ্ছেন বা যেসব সূত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে তারা সবাই উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। ওদিকে এখনও অনড় অবস্থানে বাবুলের শ্বশুরপক্ষ। তারা বলছেন, পুরো বিষয়টি নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। কিন্তু তারা মুখ খুললে সব ষড়যন্ত্র উড়ে যাবে। এতে প্রতীয়মান হয়, আইনশৃংখলা বাহিনীর মধ্যে কোনো একটি পক্ষ গোপনে সক্রিয় রয়েছে, যারা এসব ছড়াচ্ছে।
পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন, এমন একটি চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত নিয়ে যদি খোদ আইনশৃংখলা বাহিনীর মধ্যে এ রকম ‘অফ দ্য রেকর্ড’ পক্ষ তৈরি হয় তাহলে তা হবে খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এ জন্য সবার আগে এই তৃতীয় পক্ষকে চিহ্নিত করতে হবে। জানতে হবে- এরা কারা? তারা মনে করেন, তাদের কাছে যদি সত্যিই খুনের নির্দেশদাতা কিংবা পরিকল্পনাকারী হিসেবে বাবুলের বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত থেকে থাকে তাহলে তাকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেয়া হোক। খুনের দায়ে চিহ্নিত কোনো ব্যক্তি এভাবে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে দায়মুক্ত হতে পারে না। এটি কোনো আইনের ভাষাও নয়। কিন্তু প্রমাণ না করে যারা এসপি বাবুলকে সে ফ চাকরি ছাড়া করতে চায় তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন হতে পারে। এটিই এখন তদন্তের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। তিনি বলেন, তদন্ত চলছে, অগ্রগতি হলে অবশ্যই তা মিডিয়াকে জানানো হবে। সরকারি ভাষ্য না আসায় মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে, আর এতে তদন্তে বিঘ্ন হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘তদন্তের কাজ পুলিশ করছে এবং এখন পর্যন্ত তদন্তে ভালো অগ্রগতি আছে। তারা আমাকে অগ্রগতির বিষয়ে যা বলছে আমি তাই বলছি।’ গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে তদন্ত বিঘ্নিত হবে না বলে তিনি মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এমএ কাইয়ুম বলেন, মিতু হত্যা নিয়ে প্রথম থেকেই তদন্তের স্বচ্ছতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এক ধরনের রহস্যজনক আচরণ করা হচ্ছে। গল্পকাহিনীও কম হচ্ছে না। তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে প্রথম থেকেই সন্দেহজনক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটি হতাশাজনক। তিনি মনে করেন, পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিলে প্রকৃত খুনিরা অবশ্যই চিহ্নিত হবে। পুলিশের সে ধরনের সক্ষমতা আছে। তিনিও মনে করেন, যারা মামলাটিকে ভিন্ন দিকে নিতে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে সবার আগে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।
এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘কে কি লিখল তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। আমরা আমাদের কাজ করছি। তদন্ত শেষ হলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে।’ ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব পত্রিকা নানান তথ্য দিয়ে লিখছে ওইসব পত্রিকার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসা করুন।’ পত্রপত্রিকায় আইনশৃংখলা বাহিনীর উদ্ধৃতি দিয়ে যেসব লেখা হচ্ছে সে বিষয়ে আপনাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেয়া হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কিংবা প্রতিবাদ এজন্যই দেয়া হবে না যে, কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে কামড় দিয়েছে পায়।’ এরপর তিনি অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দেশবাসীর খেয়ে এত কাজ নেই যে, তারা বিভ্রান্ত হবে। বিভ্রান্ত করলে মিডিয়া করতে পারে।’
এসপি বাবুল আক্তারের সোর্স মুসাকে গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে ইকবাল বাহার বলেন, ‘না তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। কোন পত্রিকা তার স্ত্রীর বরাত দিয়ে কী ছেপেছে তার সপক্ষে যুক্তি প্রমাণ লাগবে। তবে আমরা বলছি, তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।’ এসপি বাবুল আক্তার ছুটিতে আছেন কিনা কিংবা কবে নাগাদ তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দেবেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইজি (প্রশাসন) বিনয়কৃষ্ণ বালা বলেন, বাবুল আক্তার পুলিশ সদর দফতরে সংযুক্তি হিসেবে আছেন। পদোন্নতির পর তাকে এখানে সংযুক্ত করা হয়। তবে তাকে এখনও অন্য কোথাও পদায়ন করা হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তার কর্মস্থল পরিবর্তন হলে তাকে দূরুত্ব অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন ছুটি দেয়া হয়। এক্ষেত্রে বাবুল আক্তারকে ১৫ দিনের ছুটি দেয়া হয়। তবে তার স্ত্রীর এই মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় তারা বিষয়টিকে সেভাবে বিবেচনায় নিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরীর ও আর নিজাম রোডের বাসার অদূরে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু। মোটরসাইকেলে করে আসা তিন হামলাকারী মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।-যুগান্তর
১ জুলাই,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ