চট্টগ্রাম: ‘আমার কোনো কথা শুনতো না ছেলেটি। সবসময় নিজেকে আড়াল করে রাখতো। বাড়ির বাইরে রাত কাটানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে ক্ষেপে যেত। শেষবার বাড়ি থেকে নিখোঁজ হওয়ার আগে বলেছিল বন্ধুর বোনের বিয়ে। তারপর সেই যে গেল আর ফিরে আসেনি। একটা ফোনও করেনি গত ফেব্রুয়ারি থেকে। কথাগুলো বলেই অসহায় চোখে অন্যদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আজিজুল হক চৌধুরী রাশেদ।
ঢাকার কল্যাণপুরে নিহত নয় জঙ্গির মধ্যে ছেলে সাব্বিরুল হক কণিকের লাশও আছে বলে তিনি ছবি দেখে সন্দেহ করছেন। তবে এ বিষয়ে গতকাল পুলিশের দেয়া পরিচয় শনাক্ত হওয়া সাতজনের তালিকায় তার নাম ছিল না।
গণমাধ্যমে গুলিবিদ্ধ লাশ দেখার পর গতকাল সকালে তাকে চট্টগ্রামের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে ডেকে নেয়া হয়। এই সময় সেখানে তিনি জঙ্গি কাজে ছেলের জড়িয়ে পড়া ও সামাজিক লজ্জার ভয়ে বিষয়টি গোপন রাখার কথা তুলে ধরেন।
অন্যদিকে গতকাল দুপুরে এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে সরজমিনে কণিকের শহরের বাসা বাকলিয়া কালামিয়া বাজার সংলগ্ন ইসহাকের পুল এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে বাড়িতে কেউ নেই। তালা ঝুলছে।
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আজিজুল হক। তিনি জানান, ছেলের কর্মকাণ্ডে পুরো পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে গেছেন। ঘটনার পর পরই টিভিতে লাশের ছবি দেখে বাড়ির সবাইকে তিনি বলেছিলেন দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার পর নিজের পুত্রের কর্মকাণ্ডে সমাজে আর বসবাস করা যাবে না। এতো চেষ্টা করেও ছেলেটাকে জঙ্গি তৎপরতা থেকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
যেভাবে জঙ্গি হলো কণিক: ছেলের বিপথে যাওয়ার কথা বর্ণনা করতে গিয়ে আজিজুল হক চৌধুরী রাশেদ বলেন, আমার তিন ছেলে-মেয়ের মধ্যে সাব্বিরুল হক কণিক সবার বড়। সে প্রথমে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে ভালো রেজাল্ট নিয়ে এসএসসি পাস করে। ২০১২ সালে কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে। সে পর্যন্ত ঠিক ছিল। এরপর সীতাকুণ্ডের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কেমন যেন বদলে যায়।
তিনি বলেন, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর সে নিজেকে আড়াল করে রাখতো। কিছু বললে মেজাজ দেখাতো। খিটখেটে ভাব থাকতো। প্রায় সময় বাইরে রাত কাটাতো। আজিজুল হক চৌধুরী রাশেদ জানান, চলতি বছরের ২১শে ফেব্রুয়ারি সে বাড়ি থেকে চলে যায়। তখন সে চতুর্থ সেমিস্টারের ছাত্র। কোথায় যাচ্ছে?-জানতে চাইলে সে বলেছিল কোনো বন্ধুর আত্মীয়ের নাকি বিয়ে। যাওয়ার আগে ভীষণ তর্কাতর্কি হয়। কারণ বাইরে থাকলে সহজে বাড়ি ফিরতো না।
কণিকের বাবা বলেন, এর আগেও সে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছে। তবে আবার ফিরে এসেছে। একবার চলে গেলে ৭ দিন পর আবার আসে। আমি বলেছি এভাবে বাইরে থাকা ভালো না। কে শোনে কার কথা।
থানায় জিডি করিনি লজ্জায়: কিছুদিন আগে যখন ঢাকার গুলশান ও শোলাকিয়ায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে তখন বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠছিল। আর আঁতকে উঠছিলাম যাতে আমার ছেলে এসব কাজে জড়িত না হয়। কারণ সে যে এসব কাজে জড়িত হয়েছে তা আমরা নিশ্চিত ছিলাম। তবে ধর্ম নিয়ে তার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বাড়ির কেউ মেনে নেইনি।
এই নিয়ে সবার ক্ষোভ ছিল ওর আচরণে। নিখোঁজ হওয়ার রাগে, ক্ষোভে ছেলের খোঁজ চেয়ে জিডি করিনি। তিনি বলেন, সে কোথায় আছে, কিভাবে আছে কিছুই জানতাম না। মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া যায়। আমরা ভেবেছিলাম ঢাকায় আছে। হয়তো কোনো কাজ না পেলে আবার ফিরে আসবে। কিন্তু সে যে এই কাজে জড়াবে তা কল্পনার বাইরে ছিল।
আজিজুল হক চৌধুরী বলেন, কণিক আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনোমিক্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ছাত্র ছিল। একদিন আমি তাকে বাসায় বলেছিলাম আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। তোমার চাচারাও সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তুমি ধর্ম নিয়ে যে রেগে যাও তা ঠিক নয়।
জবাবে সে বলে, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। এই নিয়ে কথা বলো না। তাহলে বাড়ি আসবো না। আমি কারও ক্ষতি করছি না। আজিজুল হক চৌধুরী বলেন, ছেলের এমন কথায় সব সময় আতঙ্কে থাকতাম। কখন সে কোন্ কাজে জড়িয়ে যায়। সিটি করপোরশনের রাজস্ব বিভাগে চাকরি করি। এতো কাজের চাপ। কিন্তু কখনও মন বসতো না। টেনশনে থাকতাম।
বাড়িতে তালা, কেউ নেই: ঢাকার কল্যাণপুরে নিহত হওয়ার পর জঙ্গি সাব্বিরুল হক কণিকের বাড়ির লোকজন শহরের বাকলিয়া কালামিয়া বাজার সংলগ্ন ইসহাকের পুল এলাকা থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। তবে তার বাবার সঙ্গে গোয়েন্দা পুলিশের লোকজন গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কথা বললেও স্থানীয় বাকলিয়া পুলিশ রাতে গিয়ে পরিবারের কাউকেই পায়নি বলে জানান ওসি আবুল মনসুর।
এই বিষয়ে তিনি বলেন, ওদের কেউ নেই বাড়িতে। কোথায় গেছে জানি না। তবে কণিক এলাকায় খুব কম থাকতো। তার বাবাকে সবাই চেনে। তিনি আরো বলেন, কণিকের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। সেখানে সে খুব যেত বলে আমরা জানতে পেরেছি। তার বন্ধুদের বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছি।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেন, জঙ্গি কণিকের পিতা আজিজ সাহেবকে আমরা ডেকেছি। তিনি ছবি দেখে বলেছেন হ্যাঁ, সে আমার ছেলে। তবে ফেব্রুয়ারিতে নিখোঁজ হওয়ার পর কণিক বাড়িতে কোনো ফোন করেনি বলে জানায় তার বাবা।
ফেসবুকে ‘আইডি নাম্বার দুই’: আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনোমিক্স অ্যান্ড ব্যাংকিং এর ছাত্র কণিক ফেসবুকে ছিলেন খুবই সরব। তবে তিনি নিজের নামে কোনো আইডি খোলেননি। ছদ্ম নামে ‘আইডি নাম্বার দুই’ শিরোনামে একটি একাউন্ট খোলেন।
আনোয়ারা উপজেলার বরুমচড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আজিজুল হক চৌধুরীর ছেলে কণিকের কোনো ছবিও নেই তার ফেসবুকে। তবে আহত জঙ্গি হাসান বলেছিল ৮ নম্বর লাশের ছবিটি কণিকের।
গতকাল বিষয়টি জানার জন্য বাকলিয়ার বাসায় গেলে সেখানে কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে প্রতিবেশিরা জানান, পরিবারের অপর এক আত্মীয়ের বাকলিয়া সৈয়দ শাহ রোডের বাসায় রাত কাটাচ্ছেন কণিকের পরিবার। এই বিষয়ে জানতে সেখানে গেলে বাড়ির কেউ দরজা খুলতে রাজি হননি।
নগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, সর্বশেষ নিখোঁজ হওয়ার আগে রাউজানে এক বিয়েতে যাওয়ার কথা বলে বের হয় কণিক। যাওয়ার সময় ৫০০ টাকা নিয়ে যায়। তারপর ‘আইডি নাম্বার দুই’ নামে ফেসবুকে একটি ভুয়া একাউন্ট খোলেন।
যেখানে জানান, বিয়ে করে সুখে আছেন। কিন্তু কোথায় আছেন তা এখনি বলতে রাজি নন। তবে এই একাউন্ট খোলার আগে ২০০৮ সালে ‘আমাগো সাব্বির দা’ নামে সে আরেকটি একাউন্ট খুলে।
তবে তা বন্ধ করে দেয় দুই বছর চালানোর পর।
আইডি নাম্বার দুই একাউন্টে কণিক সবসময় তার নিজস্ব ভঙ্গিতে কোরআন-হাদিসের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতো। সেখানে ২০১৪ সালে অস্ত্র তাক করা এক জঙ্গির ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করেন। ফটো অ্যালবামে জমা রাখেন উটের দৌড়ের আর পোশাকধারী মানুষের কিছু লাশের ছবি।-এমজমিন
২৮ জুলাই, ২০১৬ এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ