আহমদুল হাসান আসিক ও গোবিন্দলাল দাস : গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারি দলের সংসদ সদস্য (এমপি) মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যার পর তার স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির ঘনিষ্ঠ তিনজনকে নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
তারা তিনজন সুন্দরগঞ্জের সাবেক এমপি ও জামায়াত নেতা আবদুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। এ তিনজন হলেন সাগীর আলী বিহারি, জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদুর রহমান ওরফে মিসকিন মুকুল।
ঘোড়ামারা আজিজ যখন এমপি ছিলেন তারা তিনজন তখন সুন্দরগঞ্জের প্রভাবশালী নেতা। লিটন এমপি হওয়ার পর এই তিন ব্যক্তির সঙ্গে তার স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। তারা স্মৃতির মাধ্যমে সুন্দরগঞ্জের বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ ভাগিয়ে নিতেন।
স্ত্রীর মাধ্যমেই এ তিনজনের সঙ্গে লিটনেরও ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। লিটন হত্যাকাণ্ডের পর থেকে এ তিনজনকে সুন্দরগঞ্জে আর দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে এ তিনজনকে নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। গাইবান্ধা পুলিশের একটি সূত্র যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
অপরদিকে ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিচালক (আইজিপি) একেএম শহীদুল হক জানিয়েছেন, এমপি লিটন হত্যার মোটিভ উদ্ধার হয়নি। তদন্ত চলছে। এদিকে লিটনের বাড়ির সামনের গাব গাছের নিচ থেকে কালো রঙের একটি ক্যাপ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
এখন এ ক্যাপের সূত্র ধরেই চলছে তদন্ত। এরই মধ্যে ওই ক্যাপের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পুলিশের অপরাধ বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের সময় দুর্বৃত্তদের ব্যবহৃত কালো রঙের পালসার মোটরসাইকেলের মালিককে খুঁজে বের করতে র্যাবের একটি দল সুন্দরগঞ্জে তৎপর রয়েছে।
র্যাবের একটি সূত্র জানিয়েছে, এলাকার কালো রঙের সব পালসার মোটরসাইকেল মালিকদের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ছায়া তদন্তের সঙ্গে জড়িত একটি সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, দুর্বৃত্তদের ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেলের একটির মালিকের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে।
তাকে গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে। জেলা পুলিশের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল ফারুক বৃহস্পতিবার লেন, নানা বিষয় নিয়েই তদন্ত চলছে। মোটরসাইকেল মালিকদেরও খোঁজা হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রাণের সংশয়ের কথা একাধিকবার ঘনিষ্ঠজনদের বলেছিলেন লিটন। এমপির ঘনিষ্ঠরা জানান, গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুস সামাদকে তিনি দীর্ঘদিন ধরে অনুরোধ করে আসছিলেন তার লাইসেন্স করা পিস্তলটি যেন ফিরিয়ে দেয়া হয়।
এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্যও হয়। ২০১৪ সালে শিশু সাহাদাত হোসেন সৌরভকে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে গুলি করেছিলেন এমপি লিটন। তখন তার লাইসেন্স স্থগিত করে অস্ত্রটি জেলা প্রশাসন হেফাজতে নেয়।
এ বিষয়ে গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবদুস সামাদ বলেন, পিস্তল ফিরিয়ে দিতে এমপি লিটন জেলা প্রশাসনের কাছে কোনো আবেদন করেননি। তবে আদালতের কাছে তিনি এ বিষয়ে জানিয়েছিলেন।
লিটনের ঘনিষ্ঠ একজন বলেন, নভেম্বরের শেষদিকে লিটন ঢাকা থেকে ডিসিকে মোবাইল ফোনে তার লাইসেন্স করা অস্ত্রটি ফিরিয়ে দেয়ার অনুরোধও জানিয়েছিলেন। তখন ডিসিকে বলেছিলেন, তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে হুমকি পাচ্ছেন।
তার ধারণা ছিল, জামায়াত-শিবির তাকে টার্গেট করেছে। তাই পিস্তলটি ফিরিয়ে দিতে তিনি ডিসিকে অনুরোধ করেন। তবে লিটনের স্ত্রী মঙ্গলবার সাংবাদিকদের কাছে বলেছেন, বিভিন্ন সময় লিটনকে মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে হুমকি দেয়া হলেও ২০১৬ সালে কেউ তাকে হুমকি দেয়নি। এ মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত পুলিশের একটি সূত্র বলছে, এমপি লিটন হত্যার পর উপজেলা জামায়াত-শিবিরের পাঁচ নেতাকে খুঁজছে পুলিশ।
গাইবান্ধা জেলা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেন, এমপি লিটনের বাড়ির সামনে থেকে উদ্ধার হওয়া কালো রঙের ক্যাপের সূত্র ধরে খুনিদের শনাক্তে চেষ্টা চলছে। ক্যাপটি ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকার সিআইডি ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।
জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, সাগীর আলী বিহারি, জাহাঙ্গীর আলম ও মাসুদুর রহমান ওরফে মিসকিন মুকুল জামায়াত নেতা ঘোড়ামারা আজিজের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল। এমপির স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করে তারা এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
সুন্দরগঞ্জের ঠিকাদারির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করত তার স্ত্রী স্মৃতি। ওই তিন ব্যক্তি স্মৃতির মাধ্যমে ঠিকাদারি কাজ ভাগিয়ে নিত। তারা লিটন হত্যার সঙ্গে জড়িত কিনা তা তদন্ত করে দেখতে চায় পুলিশ। ঘটনার পর থেকে তাদের এলাকায় দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।
লিটন হত্যার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, লিটনের শ্বশুর বাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে জামায়াত-শিবিরের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার সময় লিটনের শ্যালক বেদারুল আহসান বেতারের ভূমিকা এবং রহস্যজনকভাবে বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ার কারণে তাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নজরদারিতে রেখেছে।
ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সুজা জানান, এমপি লিটনের প্রাণের সংশয় ছিল বলে বিভিন্ন সময় জানিয়েছেন। তার আশংকা ছিল জামায়াত-শিবির তাকে টার্গেট করে হত্যা করতে পারে। তার আশংকাই সত্যি হল।
মঙ্গলবার লিটনের স্ত্রী খুরশিদ জাহান সাংবাদিকদের বলেন, বিভিন্ন সময় জামায়াত-শিবির লিটনকে হুমকি দিলেও ২০১৬ সালে তিনি কোনো হুমকির কথা জানেন না। তবে জামায়াত-শিবির তাকে হত্যা করেছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
কালো রঙের ক্যাপে ক্লু খুঁজছে পুলিশ : এমপি লিটন হত্যার দিন তার বাড়ির সামনে গাব গাছের দক্ষিণ দিক থেকে একটি কালো রংয়ের ক্যাপ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, গুলি চালিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সময় কোনো এক খুনির মাথা থেকে ক্যাপটি পড়ে যায়। ডিএনএ টেস্টের জন্য ঢাকায় ক্যাপটি পাঠানো হয়েছে। পুলিশ এখন এ ক্যাপের সূত্র ধরে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করতে চাইছে।
জামায়াত-শিবিরের পাঁচ নেতাকে খোঁজা হচ্ছে : এ ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, সুন্দরগঞ্জের সাবেক আবদুল আজিজ ওরফে ঘোড়া আজিজ, উপজেলা চেয়ারম্যান মাজেদুর রহমান, রামজীবন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমীর ইউনুস আলীর ছেলে জামায়াত-শিবির ক্যাডার শহিদুল ও আশরাফুলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেফতার করতে পারলে এ মামলার রহস্যের জট খুলবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
এ পাঁচজনের মধ্যে জামায়াত নেতা মাজেদুর রহমান ও মিজানুর রহমান এখন সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। তারা দু’জন নাশকতা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা খলিলুর রহমান মামুন হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। তারা সবাই আত্মগোপনে রয়েছে। তারা লিটন হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, লিটন হত্যাকাণ্ডে ঘনিষ্ঠজন ও জামায়াত শিবিরের কানেকশনের বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, পাঁচটি কারণকে সামনে রেখে তদন্ত শুরু করলেও এখন তারা এ দুটি কারণকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন।
লিটনের মৃত্যুতে কার লাভ ও কার ক্ষতি হয়েছে তা বিশ্লেষণ করে দেখা হচ্ছে। ঘটনার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন, লিটনের পর কে সরকারি দলের টিকিটে সুন্দরগঞ্জের এমপি হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে আছেন। এতে করে জামায়াত-শিবিরের কোনো লাভ হবে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হত্যার মোটিভ উদ্ধার হয়নি : রাজধানীর পল্টনে কাবাডি ফেডারেশনের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আইজিপি একেএম শহীদুল হক জানিয়েছেন, এমপি লিটন হত্যার মোটিভ উদ্ধার হয়নি। তদন্ত চলছে। সবকিছু পরে জানানো হবে। তিনি আরও বলেন, যত তথ্য পাই সবই বিবেচনায় আনা হয়, গণমাধ্যমে আসে, বিভিন্ন ব্যক্তি বলে, সব মাথায় রেখে আমাদের কৌশলে নিরপেক্ষভাবে পেশাদারিত্ব নিয়ে আমরা কাজ করছি।
৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গায় নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে খুন হন এমপি লিটন। যুগান্তর
০৬ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসএস