শুক্রবার, ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, ০৮:৩৮:২৮

এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমান, দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন ৩৫ বছর ধরে!

এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমান, দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন ৩৫ বছর ধরে!

গাইবান্ধা: গাইবান্ধার লুৎফর রহমান একজন সর্বহারা মানুষ। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে যাকে লোকে চেনে সর্বহারা হিসেবে, আবার কেউ আশ্রিত মানুষ হিসেবেও জানেন। তার নামের আগে এমন বিশেষণ জড়িয়ে আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে তিনি যে এখন এক টাকার মাস্টার হিসেবেই সমধিক পরিচিত।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদীর বাধে আশ্রিত লুৎফর রহমান একজন শিক্ষানুরাগি মানুষ। দরিদ্র ও অসহায়দের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াতে তিনি নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ৬৯ বছর বয়সেও বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে  দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে দীর্ঘদিন যাবৎ দিনরাত ছুটে বেড়াচ্ছেন। বিনিময়ে তিনি একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে দিনে এক টাকা করে নেন।

আর তাই, গাইবান্ধা শহর ও গ্রামের মানুষ লুৎফর রহমানকে চেনেন এক টাকার মাস্টার নামেই। এ কারণে ওই অঞ্চলের মানুষ লূৎফর রহমান নামটি ভুলে যেতে বসেছেন। তবে, এক টাকার মাস্টার নামটি ওই এলাকার মানুষের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির।

গাইবান্ধা শহর থেকে ৭ কিলোমিটার পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধের এক পাশে এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমানের বাড়ি। ১৯৭৪ সালে তার বাড়িঘর জমিজমা ব্রহ্মপুত্র নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরপর উড়িয়া গ্রাম থেকে এসে আশ্রয় নেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্র নদীর বাধে। এখনও সেখানেই বসবাস করছেন তিনি। কপালে জুটে ‘আশ্রিত’ তকমাও। স্ত্রী ও দুই ছেলেসহ চারজনের সংসার তার।

১৯৭২ সালে ফুলছড়ি উপজেলার গুনভরি উচ্চ্ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন লুৎফর রহমান। এরপর আর্থিক অনটনে তার আর পড়ালেখা করা হয়নি। দুই বছরের মাথায় নদীতে ভিটেমাটিসহ সব হারিয়ে সর্বহারা হয়ে যান। এতে মানসিকভাবে ভেঙ্গেও পড়েন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ার সেই ধাক্কাটা আজও তার মাঝে বিরাজমান।

লুৎফর রহমান জানান, সব হারিয়ে সদর উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাধে আশ্রয় নেয়ার পর চাকরির জন্য কিছুদিন চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু তা জুটেনি। স্বাধীনচেতা বলে পরে চাকরি পেতে তেমন আগ্রহ ছিল না। এজন্য স্থানীয় বাজারে লন্ড্রি দোকান খুলে বসেন। কিন্তু এখানেও মন বসেনি তার।

কারণ, তিনি লক্ষ্য করেছেন ওই এলাকার দরিদ্র মানুষের শিশু সন্তানরা টাকার জন্য পড়ালেখা করতে পারছে না। স্কুলে গেলেও পড়ালেখায় এগুতে পারে না। পেটের ভাত যোগার করাই দুঃসাধ্য, তার উপর সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালানো দরিদ্র পরিবারের কাছে অসম্ভব।  কেউ কিছুটা পড়ালেখায় এগুতে গিয়েও প্রাইভেট বা কোচিং পড়ার সামথ্য না থাকায় ঝরে পড়ছে।  তাই চিন্তা করলেন এমন শিশুদের যাতে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে না যায় তার দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। যারা স্কুলে যায়, বা যেতে চায় না তাদের পড়ালেখা করানোর দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিলেন।

শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৮৪ সাল থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ালেখায় সহযোগিতা করছেন লুৎফর রহমান। ১০ থেকে ১২ জনকে একত্র করেন। এভাবে ভাগ ভাগ করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে শিক্ষার্থীদের পড়াতে শুরু করলেন। সে থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর ওই এলাকার গ্রামগুলোতে শিক্ষার আলো ছড়ানোর বিনিময়ে প্রতি শিক্ষার্থী থেকে দিনে চার আনা (পঁচিশ পয়সা) থেকে শুরু করে বর্তমানে ১ টাকা পর্যন্ত ভাতা গ্রহণ করছেন তিনি।

এভাবে লুৎফর মাস্টার বাগুড়িয়া, মদনের পাড়া, ঢুলিপাড়া, কঞ্জিপাড়া, পুলবন্দিসহ বেশ কিছু গ্রামে পায়ে হেটেই শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। আর তাই তার নাম হয়ে যায় এক টাকার মাস্টার। গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকা জুড়ে তাকে নাম ধরে না চিনলেও এক টাকার মাস্টার হিসেবে চেনে লোকেরা।

মদনেরপাড়ার আকতার মাঝি ও কঞ্জিপাড়ার বাসিন্দা সোহরাব মন্ডল বলেন, আমরা গরিব মানুষ। সন্তানদের পড়ালেখার খরচ জোগাতে পারি না। প্রাইভেট মাস্টার বা কোচিং সেন্টারে দিলে ২০০/৩ ০০ টাকা দিতে হয়। সে সামর্থ আমাদের নেই। কাজেই আমরা এক টাকার মাস্টারের কাছে পড়তে দেই। তিনি ভালো পড়ান। ভালো করে যত্ন সহকারে শিক্ষা দেন।

শিশু বয়সে লুৎফর রহমানের কাছে পাঠ নিয়েছেন এমন কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীদের সাথে কথা হয় ইউএনবি প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে একজন রুহুল আলম। বর্তমানে তিনি একজন এনজিও কর্মী। ওই সময় ‘লুৎফর মাস্টার’ এর সহযোগিতা না ফেলে তার শিক্ষা লাভ দূরুহ ছিল বলেন জানান।

স্নাতক (ডিগ্রি) পর্যন্ত পড়েছেন জানিয়ে রুহুল আলম আরও বলেন, তার মতো এমন অনেকেই এক টাকার মাস্টারের কাছ থেকে শিক্ষার আলো নিয়ে আজ সমাজ, পরিবার ও দেশের জন্য অবদান রাখার সুযোগ হয়েছে।

উচ্চশিক্ষিত কিছু তরুণ জঙ্গীবাদের মতো বিপথগামী পথে ধাবিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এক টাকার মাস্টার লুৎফর রহমান বলেন, জঙ্গীরা দেশের ও মানুষের ক্ষতি করে। আমার ছাত্ররা জঙ্গী হবে না। তারা পড়ালেখা করে অনেক বড় হবে, মানুষ হবে।

‘দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়তে শিক্ষার বিকল্প নেই, শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশ ও জাতির উন্নতি হতে পারে না। শিক্ষা জাগিয়ে তুলতে এবং জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি শিশুদের পড়ালেখা শেখান’, বলেন তিনি।

লুৎফর রহমান বলেন, তার শিক্ষার্থীরা গরিব মানুষ, তাদের কাছ থেকে ১ টাকা করে নেন। শিক্ষার্থীদের অনেক পরিবার ১ টাকা দেয়ারও সামর্থ রাখেন না, কিন্তু তাদেরও শিক্ষা দেন তিনি।

এভাবে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে বর্তমানে মাসে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা ভাতা পান বলে জানান লুৎফর রহমান মাস্টার।

সূত্র : ইউএনবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে