হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশুকে যেভাবে খুন করা হয় জানালেন রুবেল মিয়া (১৮)। তাদের পরিবারের ওপর ক্ষোভ ও পঞ্চায়েতের দ্বন্দ্বের কারণে এ হত্যাকাণ্ড। হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় ছয়জন। শিশুদের প্রথমে অচেতন করা হয় এবং তারপর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
রুবেল মিয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের বিচারিক হাকিম আদালতের বিচারক কৌশিক আহমদ খোন্দকারের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন রুবেল। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়।
তবে হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র বলেছেন, রুবেলের জবানবন্দিই এ মামলার চূড়ান্ত নয়। তিনি অনেক কিছু আড়াল করতে পারেন এবং নিজের পরিবারের সদস্যদের রক্ষার চেষ্টাও থাকতে পারে তার। তবে তার জবানবন্দি থেকে পুলিশ হত্যার বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা পেয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে মামলার অভিযোগপত্র দেয়া সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
রুবেলের জবানবন্দি অনুযায়ী, এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকায় ছিল গ্রামের অটোরিকশাচালক বাচ্চু মিয়া। শিশুদের পরিবারের ওপর তার ক্ষোভ ছিল। পুলিশ বলেছে, বাচ্চু মিয়া এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। তবে তার পরিবার দাবি করেছে, গত বুধবার র্যাব তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে। র্যাবের তরফে এ বিষয়ে কিছু জানায়নি।
এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। এরা হলেন আবদুল আলী, তার দুই ছেলে জুয়েল (২০) ও রুবেল (১৮) এবং গ্রামের আরজু ও বশির। আবদুল আলী গ্রামের বিভক্ত পঞ্চায়েতের এক পক্ষের নেতা।
রুবেলের জবানবন্দি দেয়ার পর রাত সাড়ে আটটায় হবিগঞ্জের পুলিশ সুপার জয়দেব কুমার ভদ্র তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। রুবেলের জবানবন্দির তথ্য উদ্ধৃত করে পুলিশ সুপার বলেন, হত্যাকাণ্ডটি ছিল পরিকল্পিত। এ হত্যাকাণ্ডে ছয় ব্যক্তি সরাসরি অংশ নেন। আরো কয়েকজন তাদের সহযোগিতা করেন।
এসপি বলেন, ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে চার শিশু ভাদেশ্বর গ্রামে খেলা দেখতে যাওয়ার বিষয়টি গ্রেপ্তারকৃত আরজু ও অটোরিকশাচালক বাচ্চু দেখতে পান।
এরপরই বাচ্চু তার অটোরিকশা নিয়ে ভাদেশ্বর-সুন্দ্রাটিকি সড়কের মাঝামাঝি এক জায়গায় অপেক্ষায় থাকেন।
সন্ধ্যার আগে চার শিশু তাজেল, মনির, জাকারিয়া ও ইসমাইল হেঁটে বাড়ির দিকে রওনা হয়। তারা অটোরিকশাটির কাছে এলে বাচ্চু তাদের বাড়িতে নামিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন। শিশুরা তার অটোরিকশায় ওঠে।
অটোরিকশার ভেতরেই শিশুদের চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে অচেতন করা হয়। পরে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বাচ্চুর অটোরিকশার গ্যারেজে। গ্যারেজটি বাচ্চুর বাড়ির ভেতরে। সেখানে রুবেল, বাচ্চু, আরজুসহ ছয়জন মিলে তাদের একে একে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে আরো কয়েকজনের সহযোগিতায় ওই রাতেই গ্রামের বালুছড়ায় তাদের মাটিচাপা দেয়া হয়।
রুবেল তার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, বাচ্চু ও আরজু বিভিন্ন সময় নিহত শিশুদের পরিবারের সদস্যদের দ্বারা অপমানিত হয়েছেন। বাচ্চুর অনেক ক্ষোভ ছিল। গ্রামে পঞ্চায়েত নিয়ে দ্বন্দ্ব আছে। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আবদুল খালেক মাস্টার (৭৫)।
তিনি জানান, তিনি গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। নিহত শিশুদের পরিবারগুলো ছিল আবদুল খালেক মাস্টারের সমর্থক। অপর পক্ষে আবদুল আলী (৬০)। তিনি স্থানীয় ফয়জাবাদ চা-বাগানের পাহারাদারের চাকরি করতেন। সম্প্রতি একটি বরইগাছ কাটাকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের বিরোধ চাঙ্গা হয়। ওই পক্ষকে দুর্বল করতে শিশুদের হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
পুলিশ সুপার বলেন, অটোরিকশা গ্যারেজ থেকে রক্তমাখা একটি পাঞ্জাবি, একটি শাবল, বস্তাসহ হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত কিছু আলামত উদ্ধার করা হয়েছে।
বাচ্চুর পরিবারের দাবি, গত বুধবার রাতে র্যাবের একটি দল বাচ্চুকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেছে। এ বিষয়ে র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মনিরুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, বাহুবলের ঘটনাটি খুবই স্পর্শকাতর। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন।
২০ ফেব্রুয়ারি,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/প্রতিনিধি/এমআর/এসএম