কেশবপুর থেকে : যশোরের ফুল বৌদি। দেশজুড়ে তার নাম ও খ্যাতি। এর পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। অভাবগ্রস্ত থেকে আজ স্বাবলম্বী। সুখী মানুষের এক দৃষ্টান্ত। নিজ মুখেই তিনি বলে বেড়ান সেইসব দিনের কথা। যে সময় দিনের পর দিন ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে পার করতে হয়েছে। রাতে ঘুমাবার মতো জায়গাটুকুও ছিল না। অসুস্থ বাচ্চাদের চিকিৎসা করাতে পারেননি অর্থাভাবে।
তিনি অঞ্জু সরকার। বয়স পঁয়তাল্লিশ। শনিবার বাংলা একাডেমিতে তিন দিনব্যাপী ফুল মেলার শেষ দিনে মুখোমুখি হন একটি দৈনিকের। ফিরে যান ২০ বছর আগের স্মৃতিতে। বিয়ের পর পরই শুরু হয় অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ। স্বামীর ছোট্ট একটি খুপরি ঘর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অভাব, অনটন, ক্ষুধা, দরিদ্রতাই ছিল নিত্য সঙ্গী।
তিনি বলেন, অসুস্থ বাচ্চাদের খেতে দিতে পারতাম না। পরার জন্য ১টি মাত্র কাপড় ছিল। মানুষের বাসায়, মাঠে, ঘাটে শ্রমিকের কাজ করে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে চলতো দিন। কতো দিন যে না খেয়ে কাটিয়েছি তার হিসাব নেই। অভাবের সংসারে যখন দুই ছেলের জন্ম হলো, তখন যেন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল। দুই ছেলেই নানা রকম অসুখে ভুগতো। তাদের চিকিৎসার খরচ, খাবারের খরচ আর অন্যদিকে স্বামীর অকর্মণ্যতা। সবকিছু মিলিয়ে যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এরই মধ্যে একদিন ভারতের ঠাকুরনগর থেকে আমার দিদি আসে।
সে আমার এই অবস্থা দেখে অবাক হয়ে যায়। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে আমাকে ঠাকুরনগর যাওয়ার কথা বলে। সেখানে আমাকে ১টি কাজের ব্যবস্থা করে দেবে। দিদির সেই বার্তাই আমার জীবনে ভাগ্য বদলের বার্তা হয়ে আসে। অঞ্জু সরকার বলেন, ঠাকুরনগরে ফুলের বাগান ছিল বেশি। সেখানে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। একদিন কাজ করলে তিন দিন খাওয়ার টাকা হয়। প্রথমদিকে আমি রাজি হইনি। দিদি চলে যাওয়ার পর অনেক কিছু ভেবেচিন্তে দেখলাম। এভাবে আর কতদিন মানুষের কাছে হাত পেতে চলা যায়।
চার জনের সংসারে কোনো আয়-রোজগার নেই। স্বামীর কাজকর্ম করার প্রতি কোনো মনোযোগ নেই। নিজে না খেয়ে থাকলে কোনো সমস্যা নেই। বাচ্চাদের খাবার আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। স্বামীকে না বলে পরদিন খুব ভোরে ছোট ছেলেকে নিয়ে ছেঁড়া কাপড় আর সঙ্গে ১০ টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমার ছেলের পরনে শুধু মাত্র একটা প্যান্ট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। পরে হাঁটতে হাঁটতে ভারতের সীমানার পাশে আমার বোনের দেয়া সেই ঠিকানা খুঁজতে লাগলাম।
যেখান থেকে আমাকে ভারত যাবার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সেই ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছালাম। হাঁস-মুরগির খাবারের প্লেটে তারা অল্প কিছু ভাত আর তরকারি দেন। তারপর শীতের রাতে ঘুমানোর জন্য বারান্দায় ছোট একটি কাঁথা দেয়া হয় আমাদের। কাঁথাটি এতো ছোট ছিল দুজন ঘুমানো কষ্টকর ছিল। সকাল বেলা একটি গ্রামের রাস্তা ধরে ভারতে প্রবেশ করি। ক্ষুধার্ত পেটে সারাদিন হাঁটার পর দিদির বাসায় যাই। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর মনটা খারাপ হয়ে যায়। বাড়িতে আমার ছেলে আর স্বামীর কথা খুব বেশি মনে পড়ে। আমার আর কোনো কিছুই যেন ভালো লাগছিলো না।
পরদিন আমার স্বামী এবং বড় ছেলে আমাকে খুঁজতে সেখানে যায়। তাদেরকে দেখে আমার মনে অনেক সাহস জন্মায়। পরে দিদি আমাদেরকে ১টি ফুল বাগানে কাজে লাগিয়ে দেন। সারা দিন কাজ করতাম আমাদেরকে দেয়া হতো ১২ টাকা। দুজনের টাকায় খুব ভালো করে চলে যেতো। বেশি কাজ আর বিশ্বস্ততার কারণে বাগানের মালিকও আমাদের পছন্দ করতেন। ততোদিনে ফুল চাষের সব কলা কৌশল আয়ত্ত করে ফেলি। কিছুদিন যাওয়ার পর বাংলাদেশের ঘটকালীর পটুপাড়ার কানাই নামের এক ফুল ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি ভারত থেকে ফুল এবং চারা নিতে আসতেন।
তিনি আমাকে বলেন, তুমি বাংলাদেশে এসে ফুলের চাষ করো আমি তোমাকে সাহায্য করবো। এরপর একদিন আমি কিছু ফুলের বীজ আর স্বামী-সন্তানকে নিয়ে দেশে ফিরে আসি। তারপর আবার শুরু হয় আমার জীবন যুদ্ধ। একদিকে যেমন খাবারের টাকা নেই। অন্যদিকে ফুলের বীজ বপন করার মতো আমার কোনো জায়গা নেই। কেউ আমার উপর ভরসা করতে পারে না। সারাদিন আশেপাশের বাড়িতে ঘুরে বেড়াতাম খাবারের জন্য। অনেকেই তাড়িয়ে দিতো। মানুষ আমাকে নিয়ে নানা সমালোচনা করতো। আমি কিছুই বলতাম না। সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করতাম।
প্রতিবেশী এক কাকার পরিত্যক্ত একটি জমি চেয়ে নেই। সেখানেই প্রথম আমি কিছু চারা লাগাই। মানুষের বাসায় কাজ করার পাশাপাশি ফুলের চাষ করতাম। একদিন ঘরে খাবার নেই। বাচ্চারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করছিলো। প্রতিবেশী কাকার কাছে এক কেজি চাল আনতে যাই। তিনি আমাকে এক কেজি চাল দেন। ঠিক তখনই ওনার স্ত্রী এসে আমার শাড়ির আঁচল থেকে চাল নিয়ে যান। সেদিন কষ্ট পেয়ে অনেক কেঁদেছিলাম। আমার কান্না দেখে পাশের ঘরের একজন এসে চাল দেন। একটু একটু করে যখন আমার চারা গাছগুলো বড় হতে থাকে তখন সাহস বাড়ে।
কিছু দিন পর আমি কিছু চারা গাছ তুলে কলা পাতায় মুড়িয়ে কানাইদার কাছে নিয়ে যাই। কানাইদা আমাকে দেখে খুব খুশি হোন। আমাকে তিনি আশ্বাস দেন চারা বিক্রিতে আমাকে সাহায্য করবেন। পরে তিনি ১ হাজার চারার জন্য অর্ডার দেন। সেই থেকে আমার আয় শুরু হয়। আমি প্রায়ই ঘটকালিতে যেতাম। ফুলের দোকান থেকে ফুল কিনে এনে কেশবপুর বাজারে দোকানে, গাড়িতে হেঁটে হেঁটে ফুল বিক্রি করতাম। কেউ ফুল কিনতো না। এক সময় আমি মানুষকে ফ্রি ফুল দেয়া শুরু করি। দোকানে দোকানে গিয়ে বলতাম কয়েকটা ফুল রাখবেন। আর আমাকে ২ টাকা দেন। আমি সুন্দর করে ফুলের টব সাজিয়ে দিতাম। খুশি হয়ে অনেকে আমাকে টাকা দিতো।
আস্তে আস্তে এলাকায় আমার পরিচিতি বেড়ে যায়। বিভিন্ন অনুষ্ঠান ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিতাম। সরকারি বেসরকারি অফিসে কোনো অনুষ্ঠান হলে আমাকে কাজ দেয়া হতো। পরিচিত অনেকে ১টি দোকান নেয়ার পরামর্শ দেন। তখন ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি। আমি অনেক ফুল বিক্রি করি। কেশবপুর থানার ওসি গাড়ি নিয়ে আমার কাছে চলে আসেন ফুল নিতে। আমার কাজ দেখে খুশি হয়ে তিনি আমাকে দিয়ে ফুলের বাগান তৈরির কথা বলেন। আমার বাড়িতে লোক পাঠিয়ে দেন তিনি। কিন্তু আমি যেতে চাইনি। ভয় কাজ করে আমার মনে। পরে আমার স্বামী আমাকে সাহস দেন।
সাহস করে একদিন গিয়ে দেখি থানার সীমানার ভেতরে অনেক জায়গা। আমার অনেক ভালো লাগে। কাজ শুরু করে দেই। ওসির সাহায্যে একটি দোকান দেই আমি। এভাবেই আমার ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। ব্যবসা বাড়ানোর জন্য লোন দরকার হয়। কিন্তু কেউ আমাকে বিশ্বাস করে লোন দিতো না। শুধু প্রথমদিকে একবার আহসানিয়া মিশন থেকে ২৫ হাজার টাকা লোন পাই। পরে আয়ের টাকা দিয়ে তা পরিশোধ করে দেই। আজ আমাকে সব ব্যাংক লোন দিতে চায়। এখন আমার ৭ বিঘা জমির উপর ফুলের বাগান ও ৬টি দোকান আছে।
বাগানে এবং দোকানে ৮০ জন কর্মচারী কাজ করে। আমার ১টি পিকআপ ও কার আছে। যখন কোথাও ফুলের দরকার হয় সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি দিয়ে পাঠাতে পারি। শহরে বাসা তৈরির জন্য আমার ১০ কাঠা জায়গা কেনা হয়েছে। বড় ছেলে এখন আমার ফুলের ব্যবসা দেখে আর ছোট ছেলে কুয়েতে থাকে। আজ আর আমার কোনো দুঃখ নেই।
অঞ্জু সরকার নামে কেউ আমাকে চিনে না। এক সময় যারা আমাকে নিয়ে সমালোচনা করেছে তারাই আজ আমার সাহায্য নিতে আসে। আমার এখন একটাই স্বপ্ন। দেশের ফুলের চাহিদা পূরণ করে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা। এবং আমি যে কঠিন অধ্যায় পার করে আসছি এরকম আর কারো জীবনে যেন না হয়। সেজন্য কাজ করছি। অসহায় মহিলাদের ভালো অবস্থানে আনার জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার মূলগ্রাম থেকেই শুরু। এখন কেশবপুর থানার সামনে তার ফুলের দোকান। প্রায় সময়ই তাকে দেখা যায় সেই দোকানে। আট থেকে আশি সবার কাছেই তিনি ফুল বৌদি নামে পরিচিত। আজ তার কোনো কিছুর অভাব নাই। তার সাফল্যগাঁথার স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় কৃষি পদক। হয়েছেন শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা। তার ঝুলিতে জমা হয়েছে জয়ীতা সম্মাননাও।
০৩ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসবি