মোঃ রুহুল আমিন : ‘ঐতিহ্য’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরম্পরাগত কথা, পরম্পরাগত উপদেশ পুরুষানুক্রমিক ধারা, ঐতিহাসিক কথা, কিবংবদন্তী, বিশ্রুতি, লোক প্রসিদ্ধ। পাঁজিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ যাতে বার, তিথি, নক্ষত্র প্রভৃতি নিরুপিত থাকে, অর্থাৎ ‘পঞ্জিকা’। আবার পাঁজিয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘পদচিহ্ন দেখিয়া’।
তাই ঐতিহ্যবাহী পাঁজিয়ার পারিভাষিক অর্থ হল ‘পরম্পরাগত ঐতিহাসিক ও কিংবদন্তী পদচিহ্ন গ্রথিত স্থানের নামই ‘পাঁজিয়া’। পাঁজিয়া একটি গ্রামের নাম, একটি ইউনিয়নের নাম, একটি ঐতিহ্যবাহী জনপদের নাম। ঐতিহ্যবাহী পাঁজিয়াকে তুলে আনতে পালে একটি পৃথক পুস্তক হয়ে যাবে। স্বল্প পরিসরে এটা তুলে ধরা সম্ভব নয়। এর পরও খুবই সংক্ষিপ্ত ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সে কারণে সকল বর্ণনার খন্ডিত চিত্র তৈরী হওয়ায় তার সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয়েছে। এই অনিচ্ছাকৃত ক্রটির জন্য পাঠকের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
‘পাঁজিয়া’ নামকরণ সম্পর্কে একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে। পাঁজিয়া অঞ্চলে প্রথম বসতি গড়ে ওঠার সময় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভাগের জনৈক ছাত্র কিছু পন্ডিতদের তত্ত্বাবধানে পাঁজি (পঞ্জিকা) লিখতেন। তার পাঁজি লেখাকে কেন্দ্র করে ‘পাঁজিয়া’ নামকরণ হয়েছে। বিষয়টি গবেষণার দাবী রাখে।
বাংলাদেশের যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ৭নং ইউনিয়নের একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রামের নাম ‘পাঁজিয়া’। উপমহাদেশের বৃটিশ রাজত্বের পুরাতন জেলা যশোর। যশোর সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে কেশবপুর উপজেলা সদর। উপজেলা সদর থেকে পূর্বে ৯ কিলোমিটার গেলেই পাঁজিয়া বাজার ও পাঁজিয়া ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। নামকরণ ‘পাঁজিয়া’ হলেও ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও বাজার মাদারডাঙ্গা মৌজায় অবস্থিত।
এছাড়াও স্কুল, কলেজ, পোষ্ট অফিস, দাতব্য চিকিৎসালয়, মন্দির, মসজিদ, ব্যাংক, কৃষি ভবন, তহশীল অফিসসহ যাবতীয় পাবলিক প্রতিষ্ঠান মাদারডাঙ্গা মৌজায় অবস্থিত হলেও নাম ‘পাঁজিয়া’। পাঁজিয়া, মাদারডাঙ্গা ও মনোহরনগর এই তিন গ্রামের লোকেরা তাদের গ্রামের মৌখিক পরিচয়ে পাঁজিয়া পরিচয় দিয়ে থাকে। সুদূর অতীত থেকে গ্রামটির গুরুত্ব অপরিসীম। বহু ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক পাঁজিয়া গ্রাম।
নবাবী ও ইংরেজ আমল থেকে পাঁজিয়ার সংগে কলকাতার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। পাঁজিয়ার প্রায় সকল সম্ভ্রান্ত পরিবারের নিকটজন কেউ না কেউ কলকাতায় অবস্থান করত। এছাড়া রেল যোগাযোগের মাধ্যমে পাঁজিয়ার লোক ৪/৫ থেকে ঘন্টার মধ্যে কলকাতায় পৌঁছে যেতে পারত। সে সময় অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে কলকাতায় যাতায়াত করত।
পাঁজিয়া জনপদটি বহু পুরাতন নয়। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে ধারণা করা হয় এই জনপদটির বয়স ‘তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ’ বছর হতে পারে। সমগ্র কেশবপুর উপজেলাটি কপোতাক্ষ, হরিহর ও ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা গঠিত। হরিহর কপোতাক্ষের শাখা নদী।
এই হরিহরই পাঁজিয়া অঞ্চলের ভূমি গঠনের কাজটি সম্পন্ন করে। ধারণা করা হয় প্রায় দু’শ পঞ্চাশ বছর পূর্বে হরিহর (বর্তমান নাম সাতনল) নদীর নাব্যতা ছিল। তখন এই নদীপথে নৌকা চলাচল করত। জনশ্রুতি আছে এই নদী দিয়ে যাতায়াতকারী নাবিকরা (মাঝিরা) আড়ুয়ার বর্তমান খলিল মেম্বারদের বাড়ীর দক্ষিণ পাশে নদীর তীরে পুরাতন তেঁতুল গাছে নৌকা বেঁধে বিশ্রাম নিত।
এখানে গোসল রান্না ও খাওয়া দাওয়ার পর পরবর্তী গন্তব্যে জোয়ার বা ভাঁটায় নাবিকরা নৌকা ছেড়ে দিত। পাঁজিয়া গ্রামটি হরিহর নদীর দক্ষিণ পাশে অবস্থিত। সাতাশকাটি থেকে বড়বাগ পর্যন্ত নদীর দক্ষিণ পাড়ের গ্রামের নাম পাঁজিয়া। উত্তর পাড়ের গ্রামটির নাম মাদারডাঙ্গা। দক্ষিণ ও উত্তর পাড়ের গ্রামের নাম মৌজা অনুযায়ী যথাক্রমে পাঁজিয়া ও মাদারডাঙ্গা হলেও উভয় পাড়ের গ্রাম পাঁজিয়া গ্রাম হিসেবে পরিচিত।
পাঁজিয়া মৌজার দক্ষিণাংশের নিচু ভূমির গঠন প্রক্রিয়া চলছিল ভদ্রা নদীর পলি দ্বারা।
বিগত ষাটের দশকে ওয়াপদার নদী শাসনের আওতায় পড়ে এই অঞ্চলের ভূমি গঠন প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে নিচু অঞ্চলটি স্থায়ী জলাবদ্ধতায় রূপ নিয়েছে। পাঁজিয়া মৌজার এই অংশে (২৩২১ দাগে) আমার বাড়ী। মৌজা অনুযায়ী পাঁজিয়া মৌজার উঁচু ও নিচু জমির পরিমাণ সমান। তবে কথিত পাঁজিয়া গ্রামের (পাঁজিয়া ও মাদারডাঙ্গা) উঁচু ভূমির পরিমাণ বেশী। এই অঞ্চলটি সুন্দরবনের অংশ ছিল। ১০/১২ ফুট মাটি খুড়লেই এর প্রমাণ মেলে।
পাঁজিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তেমন কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। কেউ কেউ আশুতোষ দেবনাথের কবিতার পান্ডুলিপিকে পাঁজিয়ার ইতিহাস মনে করেন। যারা এটা মনে করেন তারা স্মৃতিকথা ও ইতিহাসকে গুলিয়ে ফেলেছেন বলে আমার মনে হয়। তার হাতে লেখা পান্ডুলিপিতে পুরানো দিনের কিছু সত্য ঘটনা পাওয়া যাবে; তবে সেটার পরিমাণ খুবই সামান্য।
তাতে অধিকাংশ শ্রুতিকথা, কবিকল্পনা ও আবেগ মিশ্রিত ঘটনার বর্ণনা। তিনি সত্য উৎঘাটনে আদ্যে সচেষ্টা ছিলেন বলে মনে হয়নি। তবে তিনি চারণ কবি ছিলেন। কাব্য বিচারে তিনি কোন মাপের কবি ছিলেন সময় ও সুযোগ এলে তা বিচার করা যেতে পারে। তার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। তার লেখার মাধ্যমে পুরোনো কিছু কথা সংরক্ষিত হয়েছে।
এছাড়া ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে গণউদ্যোগ ফোরামের সহযোগিতায় পাঁজিয়ার ইতিহাস ঐতিহ্যের চর্চা কেন্দ্র থেকে ‘পাঁজিয়া’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। সেই পত্রিকায় ইতিহাসের প্রেক্ষাপট যেখানে এসেছে; সেখানেও আশুতোষ দেবনাথের স্মৃতিকথাটির উপর নির্ভর করা হয়েছে। সেখানেও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়েছে বলে মনে হয়নি।
তারপরও ধন্যবাদ জানাই ‘পাঁজিয়া’ পত্রিকার সংগে সংশ্লিষ্ট সমকলকে পাঁজিয়ার ইতিহাসকে ধরে রাখার চেষ্টা করার জন্য, আমি বিশ্বাস করি কোথাও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে থমকে না দিয়ে হাতড়ানোর সুযোগ করে দেওয়াও ভাল। হাতড়াতে হাতড়াতে কেউ সঠিক স্থানে একসময় ঠিকই পৌঁছে যাবে। আমাদের উচিৎ হবে, যে বা যারা অনুসন্ধানের পথে চলবে, তাদের যে যতটুকু পারি সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করা। না পারলে বিনয়ের সাথে ক্ষমা চাওয়া।
তবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করলেল হয়তো সঠিক ইতিহাস বেরিয়ে আসতে অধিক বিলম্ব হবে। পাশাপাশি যে যতটুকু জানি তা প্রকাশ করা। হয়ত এমন হতে পারে কোন একটা ছোট তথ্য সঠিক ইতিহাস নির্বাচনে সহায়ক হতে পারে। ধন্যবাদ জানাই সাহিত্যের ভ্রমণ পরিষদকে তাদের শুভ উদ্যোগে পাঁজিয়াতে সম্মেলন হতে যাচ্ছে। আসন্ন সম্মেলনে পত্রিকা প্রকাশ করে সেখানে পাঁজিয়ার উপর লেখা তৈরীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
পাঁজিয়ার প্রথম বসতি স্থাপনকারী কারা এটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কেউ বলেছে বসুরা, কেউ বলেছে সরকাররা, কেউ বলেছে মজুমদাররা, আবার কেউ বলেছে জমাদ্দার বংশীয়রা। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র থেকে জানা যায় বোসদের পূর্বে সরকার মজুমদাররা এখানে বসতি স্থাপন করে। বাণিজ্যিক কারণে বোসরা এখানে আসে।
পরে সরকার বংশীয় মেয়ে বোসরা বিয়ে করে। এ কারণে বোসরা কুল হারায়। ধারণা করা হয় বোসদের পূর্বে সরকার ও মজুমদাররা তৎকালীন জমিদারদের প্রজা ছিল। পরে বোসরা এখানকার জমিদারী কিনে নেয়। যে যাই বলুক না কেন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিচারে প্রথমে বোস, পরে সরকারদের অবদান অনস্বীকার্য।
বোসরা প্রথম বসতি স্থাপন করে পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে হরিহর নদীর (সাতনলের) উত্তর পাড়ে। অপরদিকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে সরকার বংশীয়দের বসতি ছিল। বোসদের অর্থবিত্ত, শিক্ষা-দীক্ষা, মান-সম্মান ও সর্বোপরি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে এদের একটি শাখা পূর্ব পাড়ায় বসতি স্থাপন করে। অন্য শাখাটি কালীবাড়ীর উত্তর পাশে বর্তমান পাঁজিয়া মহাবিদ্যালয়ের স্থানে বসতি গড়ে তোলে।
পুরাতন বাড়ীর একই পরিবার দু’ভাগ হওয়ার কারণে পূর্ব পাড়ায় বসবাসকারীদের ‘পূর্বের বাড়ী’ এবং কলেজের স্থানে বসবাসকারীদের ‘নূতনবাড়ী’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। পুরাতন বাড়ী হলো প্রথমেই বসতিবাড়ী (চকের বাড়ী) পূর্বের বাড়ী ও নূতন বাড়ীর স্বনামধ্যন্য ব্যক্তিদ্বয় হলেন যথাক্রমে রুকিণী কান্ত বোস ও পরেশ নাথ বোস, এরা উভয়ে মুর্শিদাবাদের নবাব কর্তৃক ‘দেওয়ান’ ও ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। এরা উভয়ে জমিদার ছিলেন। রাজা পরেশ নাথ সিলিমাবাদ পরগণার ও দেওয়ান রুকিণী কান্ত চেঙ্গুটিয়া স্টেটের। বর্তমান পাঁজিয়া হাইস্কুল ও মনোহরপুর কাছারীবাড়ী পরেশ নাথের কাছারী ছিল।
অন্যান্য জমিদারদের ন্যায় এই জমিদারদের সদর মহল, অন্দর মহল, নাচমহল, নাট মন্দির, তহশীল ও কাছারী ছিল। প্রয়োজনীয় লোকবলও ছিল। দু’বাড়ীর দুই কর্তা ব্যক্তিকে ঘিরে পাঁজিয়ায়তাদের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজা পরেশ নাথ বসুর জমিদারীর গল্প আজও পাঁজিয়া ও তৎসংলগ্ন এলাকার মানুষের মুখে-মুখে। মূলত পাঁজিয়ার যে ঐতিহ্য তার সিংহ ভাগই বোস পরিবার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। তন্মধ্যে নতুন বাড়ীর গুরুত্ব অপরিসীম। বোসরা পাঁজিয়া এলাকার উন্নয়নের জন্য বেশ কিছু জনকল্যাণ মূলক কাজ করে তারা অমর হয়ে রয়েছেন। জমিদার ও তার সহযোগীতায় সে সকল জনকল্যাণমূলক কাজ করেন, সংক্ষিপ্ত আকারে নিন্মে প্রদত্ত হল।
পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: পাঁজিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষা বিস্তারের জন্য শ্রীনাথ বসু ও যোগেন্দ্র নাথ বসু কর্তৃক পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রাম, পাড়া, মহল্লায় অপ্রাতিষ্ঠানিক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থাকলেও পাঁজিয়া ২০ কিলোমিটার ভিতর উচ্চ শিক্ষার সুযোগ ছিলনা। ১৮৯৭ সালের ৪ জানুয়ারী এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে বোসেরাই প্রথম উচ্চ শিক্ষার দ্বারা উন্মোচন করে।
তাদের চেষ্টায় ১৮৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলটিকে স্থায়ী স্বীকৃতি দান করে যা আজও বলবৎ আছে। এই স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাগের হাটের প্রফুল্ল বাবু, দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক যোগেন্দ্রনাথ বসুর পুত্র অনুকূল চন্দ্র বসু। স্বাধীনতা উত্তর এই প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ শিক্ষক মণ্ডলী ছিল। এরা সকলেই আমার শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষক বিষ্ণুপদ ঘোষ, সহকারী প্রধান শিক্ষক কানাই লাল পাল, ফজলুল করিম, আব্দুল মালেক, বলাই কবিরত্ন, গোপাল চন্দ্র দে, আমজাদ হোসেন, সুনিল কুমার পাল, দীপক মজুমদার, অশোক কুমার বিশ্বাস, মশিয়ার রহমান প্রমুখ। বর্তমানে এই বিদ্যালয়ে কেশবপুরের পূর্বাঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয়ে কেশবপুরের পূর্বাঞ্চলের মাধ্যমিক পর্যায়ের সকল পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত। এই বিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র মন্ত্রী শরৎ চন্দ্র মজুমদার, সাহিত্যিক মনোজ বসু ও সাহিত্যিক ও চিত্রাভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য, জগন্নাথ বসু প্রমুখ।
পাঁজিয়া দাতব্য চিকিৎসালয়: পাঁজিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের চিকিৎসা সুবিধার জন্য ১৯২৫ সালে বিজয় গোপাল বোস, বিনয় বোস প্রমুখের চেষ্টায় পাঁজিয়ার পূর্ববাড়ীতে উপেন্দ্র কৃষ্ণ দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কুসংস্কারের বেড়াজালে আবন্ধ মানুষ যখন ভূত-প্রেত-দেও-দানবের আছরকে অসুস্থতার কারণ বলে জানত, তখন কয়েকন মহৎ ব্যক্তির চেষ্টায় দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। বর্তমানে দাতব্য চিকিৎসালয়টি পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সেবার অন্তর্ভুক্ত হয়ে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ক্লিনিকের সংগে একিভূত হয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেন্টার হিসাবে কার্যক্রম পরিচালতি করে যাচ্ছে।
পাঁজিয়া পোষ্ট অফিস: পাঁজিয়া অঞ্চলের মানুষের সংবাদ আদান-প্রদানে মাধ্যম হিসেবে পোষ্ট অফিসের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে ইংরেজ আমলে যোগাযোগের সর্ব উৎকৃষ্ট মাধ্যম পোষ্ট অফিস। পাঁজিয়ার পূর্ব পাড়ার জমিদার বোসদের চেষ্টায় পোষ্ট অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালিন পাঁজিয়ার সংঙ্গে কোলকাতার নিবিড় যোগাযোগ ছিল।
এই যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পোষ্ট অফিস। তখন পাঁজিয়ার শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল শ্রেণী পেশার মানুষ এই পোষ্ট অফিসের মধ্যমে উপকৃত হত। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে পোষ্ট অফিসটি পূর্বপাড়া থেকে ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে স্থানান্তরিত হয়। বর্তমান মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ফলে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ডাকঘরের গুরুত্ব কমে এসেছে। শুধু অফিস-আদালতের চিঠিপত্র ডাকঘরের মাধ্যমে বিলি বন্টন হচ্ছে।
পাঁজিয়া বাজার প্রতিষ্ঠা: জমিদারদের জমিদারীর প্রয়োজনে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ পাঁজিয়া অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। জমিদারদ্বয় সকল শ্রেণী পেশার মানুষের সুবিধার জন্য বাজারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যতদূর জানা যায় দ্রব্য বিনিময়ই বাজার ব্যবস্থার প্রথম সোপান। মানুষের বসবাসের এলাকায় দূরত্বে হলেও বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। পাঁজিয়ায়ও বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে এলাকার প্রয়োজনে। গ্রাম বাংলায় গড়ে ওঠা অন্যান্য বাজারের তুলনায় পাঁজিয়া বাজারের বৈশিষ্ট্য ভিন্নতর।
প্রতিদিন সকালের বাজার পাঁজিয়া বাজারের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। জনশ্রতি আছে জমিদার ও জমিদারীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা টাটকা বাজার সওদার প্রয়োজনে প্রতিদিন সকালের বাজার প্রয়োজন হয়। এখনও সেই ব্যবস্থার ব্যত্যয় ঘটেনি। বর্তমান সময়ও গ্রাম ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এমন বাজার ব্যবস্থা বিরল। এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই বাজারের গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমানে পাঁজিয়ার তরকারী বাজারের মালামাল পাঁজিয়া থেকে সরাসরি রাজধানীতে পাঠিয়ে ব্যবসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
পাঁজিয়ার পাঠাগার: মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর পাঁজিয়া ও পার্শ্ববর্তী এলাকার শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পায়। মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্য শ্রেণীর শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য বই পুস্তক পাঠের আবশ্যকতা অনুভব করে। বিগত শতাব্দীর বিশের দশকে সুনিল কুমার বোসের প্রচেষ্টায় পাঁজিয়ায় লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠিত হয়। জনশ্রুতি আছে জমিদারদের অন্দরমহলের বিনোদনের জন্য নাচমহল ছিল। লক্ষ্মৌ থেকে আনা নর্তকীরা সেখানে নাচ-গান করত।
পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পর এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পঠন পাঠনের পাশাপাশি সাংস্কৃতি চর্চা ও শরীর চর্চামূলক ক্রীড়াদিও অনুষ্ঠিত হত। ১৯২৮ সালে পরিবর্ধিত হয়ে চারুচন্দ্র পাঠাগার নামকরণ করা হয়। বর্তমানে পাঠাগারের একটি ভবন ছাড়া আর কিছুই নেই। এই ভবনটি ঐতিহ্যের স্বাক্ষী হিসেবে আজও খাড়া হয়ে আছে। আর একটি সূত্র থেকে জানা যায় পাঁজিয়াতে নেতাজী সুভাষ পাঠাগার ছিল। গোল টেবিলের উত্তর পার্শ্বে উঁচু ভিটাটি ছাড়া তার আর কিছুই নেই।
এই পাঠাগারের সংগে বিগত শতাব্দির চল্লিশের দশকে পাঁজিয়া সাহিত্য-সাংস্কৃতির আন্দোলন নামে একটি সংগঠন ছিল। যাদের প্রতি পূর্ণিমায় আসর বসত। আসর শেষে পরবর্তী আসরের বিষয় নির্ধারণ করা হত। ফজলুল করিম ও আবন্দুল মালেক সেই সংগঠনের সভ্য ছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে ‘প্রগতি’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত। ব্যক্তি উদ্যোগে পাঁজিয়ায় ১৯৮৫ সালে সাতনল পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্য সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
মূলত রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁজিয়ার সাহিত্য সংগঠন গতি পায়। তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা ছাড়া বিগত দিনে পাঁজিয়া অঞ্চলে কোন সাহিত্যকর্ম দৃশ্যমান হয়নি। বিগত শতাব্দী থেকে অদ্যাবধি তার সাহিত্য সংগ্রহশালা হতে সমৃদ্ধ ও আর কারো দেখা যায়নি। বর্তমানে পাঁজিয়া অঞ্চলে প্রায় ডজন খানেক সাহিত্য সংগঠন কাজ করছে। এখনও পাঁজিয়াতে প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য বাসর বসে।
গোল টেবিল: পাঁজিয়ার গোল টেবিল পাঁজিয়ার ঐতিহ্যের একটি বড় উদাহরণ। এমন গোল টেবিল সমগ্র বাংলাদেশের গ্রাম পর্যায়ে দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। এই গোল টেবিলে বসে সামাজিক, রাজনৈতিক, ক্রীড়া ও সংস্কৃতির প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করে সিন্ধান্ত নেওয়া হত।
পাঁজিয়ার কংগ্রেস নেতা ও কৃষক নেতারা নিয়মিত এখানে বসে তাদের কর্মসূচী নির্ধারণ করতেন। এখনও ভগ্ন ও জরাজীর্ণ অবস্থায় গোলটেবিলটি তার অতীত ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে। নেতাজী সুভাষ পাঠাগারের সংশ্লিষ্ট ‘পাঁজিয়া’ সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলন’ সংগঠনের সভ্যগণ গরমের দিনে এই গোল টেবিলে বসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে আলোচনা করতেন।
কালী মন্দির: নূতন বাড়ীর জমিদার রাজা পরেশ নাথ বসুর পিতা তারিণীকান্ত বসু তৎকালীন পাঁজিয়া পুরাতন বাজার সংলগ্ন পূর্ব-উত্তর কোণে কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালিন সকল হিন্দু রাজা ও জমিদারগণ বাড়ীর সন্নিকটে সার্বজনীন মন্দির প্রতিষ্ঠা করতেন। এটা তাদের রীতি ও ঐতিহ্যের বাহক। মন্দিরের সেবায়েতদের জন্য তারা পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধাও প্রদান করেন। বর্তমানে এই মন্দিরে প্রতিদিন শ্যামাপূজার পাশাপাশি নারায়ণ ও শিবপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
পাঁজিয়া বাজার দীঘি: সামন্ত প্রভুরা বিভিন্ন কারণে প্রজাদের উপর অত্যাচার করত। কিন্তু তারা প্রজাসাধারণের জন্য কিছু কিছু জনকল্যাণ মূলক কাজও করত। এই জনকল্যাণমুলক কাজের প্রথমেই প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট নিবারণের জন্য বড় পুকুর বা দীঘি খনন করত।
এটা তাদের ঐতিহ্যের একটা অংশ। নূতন বাড়ীর কর্তা ব্যক্তি তারিণী কান্ত বসু সেই ভাবনায় পাঁজিয়া বাজার সংলগ্ন একটি বড় দীঘি খনন করেন। এই দীঘির উত্তর পাড়ে বিরাট শান বাঁধানো ঘাট ছিল। ঘাটের উপর জমিদারদের হাতি বাঁধা থাকত। দীঘিটি আজ হাজামজা হয়ে কালের স্বাক্ষী বহন করছে।
কংগ্রেস অফিস: ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতবর্ষ কোম্পানীর শাসন থেকে সরাসরি ইংল্যান্ডের শাসনের অধীনে চলে যায়। ইংরেজরা ভারতবাসীর মনোভাব জানার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা অনুভবন করে। ইংরেজদের এই ভাবনাটিকে ভারতবাসী ইতিবাচক মনে করে এবং তারা রাজণৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনা করতে থাকে।
এ সময় ১৮৮৫ সালে অক্টোভিয়ান হিউম ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাঁজিয়াতেও কংগ্রেস অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমান তহশীল অফিসের স্থানে পাঁজিয়া কংগ্রেস অফিস ছিল। পাঁজিয়ার কংগ্রেস নেতাদের ভিতর প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রভাবশালী সদস্য প্রমোদ বসু ওরফে বিল্লে বসু, অধীর বসু, বিনোদরিহারী গাঙ্গুলী, সুবোধ ঘোষ, কমলা ত্রিম, মাদারী ঘোষ, বৌদি ঠাকুরূপ, কুসুম কুমারী, হরিপদ বোস প্রমুখ।
এই কংগ্রেম অফিসের উদ্যোগে একটি অনাথ আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অনাথ আশ্রমের সংগে দরিদ্র ভান্ডার খোলা হয়। উল্লেখিত কংগ্রেস নেতাদের তত্ত্বাবধানে চরকা, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, আইন অমান্য, ইংরেজ ভারত ছাড়, বঙ্গভঙ্গরদ প্রভৃতি আন্দোলনের কর্মসূচী এই পাঁজিয়ায় পালিত হত। বর্তমানে কংগ্রেস অফিসের অস্তিত্ব আর নেই।
দূর্গা ও বাসন্তিপূজা উৎযাপন: দেশ বিভাগের পূর্বে পাঁজিয়ায় ১ কিলোমিটারের ভিতর বাড়ী বা পাড়ায় ১৩/১৪ খানা দূর্গা প্রতিমা তুলে পূজা উৎযাপন করা হত। তৎকালিন এত অল্প জায়গায় এমন সাড়ম্বরপূর্ণ দূর্গাপূজা উৎযাপন বিরল দৃষ্টান্ত। এ সময় পাঁজিয়া অঞ্চলের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আনন্দ উপভোগ করত। জমিদার বাড়ীর পূজায় মুসলিম প্রজাদেরও পাঁঠা প্রদানের রেওয়াজ ছিল বলে শোনা যায়।
দেশ বিভাগের পর পাঁজিয়ায় ৩ খানা দূর্গা প্রতিমা তুলে দূর্গাপূজা উৎযাপিত হত। রবি কুমার সরকারের বাড়ী সংলগ্ন পাঁজিয়া সার্বজনীন দূর্গা মন্দির, ডাক্তার সুশীল কুমার বোস ও পূর্ব পাড়ার বোস বাড়ীর পুরানো মন্দিরে। বর্তমানেও প্রতিবছর ৩ খানা দূর্গা প্রতিমা তুলে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। ডাক্তার সুশীল কুমার বোসের বাড়ী হাত বদল হয়ে পাঁজিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ইন্তাজ আলী গাজী বাস করছেন।
ডাঃ সুশীল বাবুর বাড়ীর পূজা বন্ধ হলেও পাঁজিয়া কালী মন্দিরে নূতন করে দূর্গা পূজা হওয়ায় ৩ খানা দূর্গা প্রতিমা পূজা অনুষ্ঠিত হয়। জমিদারী আমলে নূতন বাড়ীতে ধূমধামের সাথে বাসন্তি পূজা অনুষ্ঠিত হত। নূতন বাড়ীর প্রতিমা বড়েঙ্গা খেয়াঘাটের স্থানে নদীতে বিসর্জন দেওয়া হত।
নাট্য সমাজ : ১৩১৪ সালে পাঁজিয়ার নাট্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় নেপাল চন্দ্র মিত্রের নেতৃত্বে। জমিদারী আমলে জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় নাট্য সমাজ সক্রিয় ছিল। বিশেষ করে প্রতিবছর দূর্গাপূজার সময় যাত্রাপালা, নাটক, কীর্তন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে মঞ্জায়িত হত। পাঁজিয়ার চতুর্পার্শ্বের গ্রাম থেকে অসংখ্যা নাটক ও যাত্রাপালা উপভোগ করার জন্য আসত।
উভয় জমিদার বাড়ীর সংশ্লিষ্ট সহায়তায় নাট্য সমাজ পরিচালিত হত। এক সময় পাঁজিয়ার নাট্যসমাজ ধীরাজ ভট্টাচার্যের সংস্পর্শে এলে নাটকের পালে হাওয়া লাগে। প্রতি বছর ধীরাজ পূজার সময় পাঁজিয়াতে এসে কোলকাতা কেন্দ্রিক গঠিত নাট্য সমাজের সক্রিয় সহযোগীতায় যাত্রাপালা, নাটক মঞ্চায়িত করতেন। কলিকাতায় ধীরাজ তখন নামী-দামী অভিনেতা। সিনেমার নায়ক হিসবে ধীরাজের নাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। এ সময় পাঁজিয়ার নাট্যমঞ্চে ধীরাজকে অভিনেতা হিসেবে স্বশরীরে দেখা লোকে সৌভাগ্যের বিষয় মনে করত। ধীরাজ পাঁজিয়ায় আসলে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। ধীরাজ আসা বন্ধ করলে পাঁজিয়ার নাট্যসমাজও ঝিমিয়ে পড়ে। পশুপতি বসুর দাদা পূর্ণচন্দ্র বসু মারা গেলে পাঁজিয়ার নাট্যসমাজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। এসময় নাট্য সমাজের সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন গোপাল ঘোষ (হৃদ), রবি কুমার দাস, দীপক মজুমদার, প্রনব চৌধুরী (কাজল)।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর পাঁজিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক আব্দুল মালেকের অনুপ্রেরণায় পাঁজিয়ার নাট্যসমাজ আর একবার ক্ষণিকের জন্য হলেও কিছুটা উজ্জীবিত হয়েছিল শের আলীর অভিনয়কে ঘিরে। ধীরাজের মত পেশাদার অভিনেতা না হলেও শের আলীর অভিনয় ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। তিনিও বেশ কিছুদিন পাঁজিয়ার নাট্য সমাজের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সে সময় সুঅভিনেতা মৃণাল কান্তি রায়, সোহরাব হোসেন, দেবাশীষ চক্রবর্তী, বসুদেব দেবনাথ, আনন্দ মোহন বসু, আফছার উদ্দীন (ঘাঘা), ইমদাদ হোসেন (ঘাঘা), পাঁজিয়ার মিলন বসু, তাপস বসু, শম্ভুনাথ বসু, সুব্রত বসু, ইয়ার মাহমুদ, সমির দাস, রানজিৎ দেবনাথ, জয়দেব চক্রবর্তী, দীপক বসু প্রমুখ অভিনয় করতেন। শের আলীর অভিনয় ছাড়ার পর থেকে অদ্যাবধি তেমন কোন ভাল নাট্যকর্মী পাঁজিয়া কেন্দ্রিক দেখা যায় না। আটচালা নাট্যমঞ্চটি এখন ধ্বংসের শেষ প্রান্তে উপনীত।
পাঁজিয়া কালীবাড়ী মাঠ : পাঁজিয়া কালীবাড়ীর উত্তর পার্শ্বে বিশাল মাঠটি কালীবাড়ী মাঠ নামে পরিচিত। বহুকালের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার স্বাক্ষী এই মাঠ। এই মাঠে খেলা-ধুলা, সংস্কৃতি চর্চ্চার পাশাপাশি অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা, জনসভা ও গণ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৪০ সালে ৪র্থ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন এই মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। পাঁজিয়ার কৃষকনেতা সুনীল বোস ও তার সহকর্মী সুধীর মিত্র, অধীর ঘোষ, অধীর ধর, প্রমুখের নেতৃত্বে এই কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেচ্ছাসেবক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন শম্ভু বসু ও সহ অধিনায়ক অনন্ত মিত্র।
এই সম্মেলনে প্রায় ৫০ হাজার কৃষক অংশগ্রহণ করেছিল। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সর্বভারতীয় কৃষক নেতা, পি সি যোশী, হক সাহেব, ভবানী সেন, মোঃ ইসমাইল, মহিতোষ চৌধুরী, নওশের আলী প্রমুখ। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনেও পাঁজিয়া ও কালীবাড়ীর মাঠের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। দেশবিভাগের পূর্বে পাঁজিয়ার কংগ্রেসের নেতৃত্বে এই মাঠে চরকা আন্দোলন, ইংরেজ ভারত ছাড়, বঙ্গভঙ্গ রদ প্রভৃতি আন্দোলনে পিকেটাররা পিকেটিং করত।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনেটর নির্দেশক্রমে সার্ভেয়ার র্যাডক্লিফ দেশ ভাগের যে সিমানা নির্ধারণ করেন প্রথম দিকে পাঁজিয়া অঞ্চল হিন্দু স্থানের ভাগে পড়েছে জেনে স্থানীয় পাঁজিয়ার শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবি মহলের অনেকে এই মাঠে খোলা ছাতা উপরে ছুড়ে আনন্দ প্রকাশ করে। পরে খবর আসে পাঁজিয়া অঞ্চল পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে, তখন তারা মর্মাহত হন। কেউ কেউ দু’একদিনের ভিতর পাঁজিয়া অঞ্চল ত্যাগ করে হিন্দুস্থান অংশে চলে যান।
এই মাঠে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় টিমের সংগে পাঁজিয়া টিমের খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ খেলায় পূর্ব পাকিস্তান টিমের দ্বিতীয় গোলরক্ষক অনাথ পাঁজিয়া টিমের পক্ষে খেলেছিলেন। অমলেন্দু বিশ্বাস রচিত চেনা মুখ অচেনা মানুষ গ্রন্থ থেকে জানা যায় এই মাঠে কলকাতার মোহন বাগান ফুটবল টিমের সংগে মশিহাটী ফুটবল টিমের খেলা হয়েছিল। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এই মাঠে ক্রিকেট খেলা হত।
১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুজ পাঁজিয়ার এই মাঠে বিশাল জনসভা করেন। ১৯৭১ সালে পাঁজিয়া অঞ্চলের শতাধিক যুবক এই মাঠে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই মুক্তি বাহিনীর প্রশিক্ষণ দানের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য হাবিলদার ক্লার্ক চাঁদের আলী মহালদার। যার বাড়ীছিল মাদারডাঙ্গা গ্রামের বর্তমান ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পূর্ব-দক্ষিণ পাশে। তার জন্ম ১৯২২, মৃত্যু ১৪/৬/১৯৮৫।
১৯৭১ সালে তিনি তার বাড়ীতেই অবসর জীবন-যাপন করছিলেন। ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তানের লাহোরের খাড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে অবসর নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন গ্রামের কয়েকশত তরুণ এই প্রশিক্ষণে যোগদান করে। তকে সহয়তা করেন ল্যান্সনায়েক আব্দুল মবিন। তার বাড়ী কুমিল্লা জেলার বরুরা থানায়। কিন্তু যুদ্ধে যাবার সময় অর্থাৎ আব্দুল মবিনের নেতৃত্বে মাত্র ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা যাত্রা করে। এটাই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাঁজিয়া মুক্তিযুদ্ধের।
১৯৭৫ সালে প্রথম বিভাগীয় স্ব-নির্ভর অনুষ্ঠান পাঁজিয়াতে অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সময় মাহাবুবুল আলম চাষী ও তার সফর সঙ্গীরা ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে এসে এই মাঠে অবতরণ করে। ৩ দিন ব্যাপী ঐ অনুষ্ঠান সফল করার জন্য তৎকালিন কেশবপুর কলেজের অর্থনীতির প্রভাষক নাসির উদ্দীন ও পাঁজিয়ার প্রণব চৌধুরী (কাজল) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ঐ কর্মযজ্ঞে বিভাগীয় পর্যায়ের সকল দায়িত্বপূর্ণ কর্মকর্তা অংশ গ্রহণ করে।
পাঁজিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ: দেশবিভাগের পূর্বে পাঁজিয়ার প্রায় সকল ঐতিহ্য গড়ে ওঠে নূতন ও পূর্বের বাড়ী ঘিরে। জমিদার ও পূর্বে আলোচিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও পাঁজিয়ার যে সকল ব্যক্তি তাদের কর্মকান্ডের জন্য মানুষের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন তারা হলেন নারায়ণপুর হাইস্কুল প্রতিষ্ঠাতা জমিদাতা হরিপ্রসসন্ন বসু, কাটাখালি হাটের প্রতিষ্ঠাতা অম্বিকা চরণ বসু, পাঁজিয়া নাট্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা নেপাল চন্দ্র মিত্র, পাঁজিয়া ইউনিয়ন বোর্ডের প্রথম প্রেসিডেন্ট যতীন্দ্র নাথ মিত্র, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট ললিত মোহন ঘোষ, যামিনী সরকার, আওয়াল সরদার, ইউসুফ সরদার ও রবি কুমার সরকার। আরও যে সকল মানুষ মানুষের ভালবাসা অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে উকিল বিনয় বসু, চারুচন্দ্র মিত্র, অনারারি ম্যাজিষ্ট্রেট বিজয় কৃষ্ণ সরকার, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী ক্যাপটেন ডা: কে কে সরকার।
চিত্র অভিনেতা ও সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্য, লেখায় পাঁজিয়াকে তুলে ধরেছেন মনোজ বসু; ডা. হিমাংসু বসু, পশুপতি বসু, জিনিতুল্য বিশ্বাস প্রমুখ। বৃটিশ আমলের শেষ দিকে জমিদারী অধিগ্রহণের পর জমিদারদের মর্যাদা ফিকে হয়ে আসে। ১৯৫০ সালে প্রজাস্বত্ব আইন পাশ হলে জমিদারী প্রথার বিলোপ হয়। এ সময় এদেশের প্রায় সকল হিন্দু জমিদাররা দেশ ত্যাগ করে হিন্দুস্থান ভাগে চলে যায়। পাঁজিয়াও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। নূতন বাড়ীর জমিদারদের প্রসঙ্গে একটা ঘটনা আমাদের জানিয়েছিলেন পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মরহুম ফজলুল করিম সাহেব।
তিনি বলেছিলেন পাঁজিয়ার বাবুদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন পাশ্চিম সারুটিয়া গ্রামের (কৃষ্ণনগর) কাজেম আলী সরদার ওরফে কাজেম গুরু। কাজের গুরু সম্পর্কে তিনি একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। ঘটনাটি হল প্রতি বছর পূজার সময় জস্টিস রমেশ চন্দ্র বসু কাজেম গুরুকে ধূতি গেঞ্জি উপহার দিতেন। তাই বাবুর (রমেশ চন্দ্র বসু) নায়েব বাবুর কাছে কারণ জানতে চাইলে বাবু নায়েবকে তার পায়ের পিছনের হাঁটুর নিচে একটি কাটা দাগ দিখিয়ে বলেছিলেন, ঐ কাটা দাগটি কাজেম গুরুর লাটির আঘাটেতর চিহ্ন। তিনি তার নায়েবকে আর বলেছিলেন, গুরুর লাঠির দাগ থাকার জন্য তিনি বিচারক হতে পেরেছেন।
তাই তিনি গুরুভক্তির নিদর্শন হিসেবে কাজেম গুরুকে প্রতি বছর পূজার সময় ধূতি-গেঞ্জি উপহার দেন। পাঁজিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে কাজেম গুরু পাঁজিয়ার বিভিন্ন পাড়া ও মহল্লায় বিভিন্ন ব্যক্তিকে শিক্ষাদান করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে ফজলুল করিম সাহেব জানিয়েছিলেন, তার পিতাও কাজেম গুরুর ছাত্র ছিলেন। সাহিত্যিক মনোজ বসুর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘সেই গ্রাম সেই সব মানুষ’ গ্রন্থেও কাজেম গুরুর পাঠশালার কথা উল্লেখ আছে। তৎকালিন আইন-আদালতের ভাষা ছিল ফার্সী। ধারণা করা হয় পাঁজিয়া সে সকল ব্যক্তি কোর্ট কাছারী, আইন-আদালতের সংঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন তারা ফার্মী শেখার জন্য কাজেম গুরুর কাছে লেখাপড়া করত। কাজেম গুরু ফার্সী ছাড়া বাংলা, ইংরেজি অংক জানতেন বলে তার উত্তর পুরুষদের কাছ থেকে জেনেছি।
বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে পাঁজিয়ার মাটিতে অনেক নামী-দামী লোকের পদচারণা ছিল। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে কেশবপুর থেকে বাই-সাইকেল যোগে পাঁজিয়াতে আসেন। পাঁজিয়ার পশুপতি বোসের সংগে তার খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল। রবি কুমার সরকারের সঙ্গেও তার পরিচয় ছিল।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য কয়েকবার পাঁজিয়াতে এসেছেন। একটি বর্ণনায় ১৯৭৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমান পাঁজিয়ার আসেন বলে উল্লেখ থাকলেও নিরপেক্ষ সূত্র থেকে তা সমর্থিত হয়নি। দেশ বিভাগের পর পাঁজিয়া তার অতীত ঐতিহ্য হারাতে থাকে। পাকিস্তান আমলে রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসু যথেষ্ট আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
যশোরের মাইকেল মধুসূদন কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের ভিতর পশুপতি বসু ছিলেন অন্যতম। শ্রদ্ধার সাথে আজও কলেজ লাইব্রেরীতে তার ছবি বাঁধানো আছে। কেশবপুর থানা ও জেলা সদরে সকল অফিস আদালতে রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসুকে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হত। রবি কুমার সরকার ও পশুপতি বসু সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। রবি কুমার সরকারকে আধুনিক পাঁজিয়ার রূপকার বল্লেও অত্যুক্তি হয় না। ১৯৬৫ সালে তিনি পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তার চেষ্টায় পাঁজিয়াতে অনেক উন্নতি সাধিত হয়। তিনি পাঁজিয়া সবুজ বিপ্লবের প্রাণ পুরুষ।
তিনি পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ীর (নূতন বাড়ী) ইট দিয়ে পাঁজিয়া কেশবপুর রাস্তা পাকা করেন। এছাড়া পাঁজিয়া গ্রামের অলিগলি রাস্তা তার সময় পাকা হয়। তার নেতৃত্বে নূতন বাড়ীতে ১৯৬৪ সালে হাইস্কুল নির্মাণের জন্য ভবন নির্মাণ করা হয়। যশোর জেলার প্রায় সকল বিশিষ্টজনরা চেয়ারম্যান রবি কুমার সরকারকে চিনত। আজও এলাকার সিংগভাগ লোক শ্রদ্ধার সংগে রবি কুমার সরকারের কর্মকাণ্ডকে স্মরণ করে। ১৯৬৫ সাল হতে ১৯৭৭ সাল প্রায় এক যুগ ধরে রবি কুমার সরকার পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৭৭ সালে পাঁজিয়া হাইস্কুলের শিক্ষক ফজলুল করিম পাঁজিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রবি কুমার সরকারের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। যুদ্ধোত্তর স্ব