চৌগাছা (যশোর): যশোরের চৌগাছায় দুর্নীতিবাজ, অনিয়মকারী সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের কাছে আতঙ্কের নাম আশারফ হোসেন (৫০)। যেখানে অনিয়ম ও দুর্নীতি, সেখানেই তিনি তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে তথ্য চেয়ে আবেদন করে তটস্থ্য রাখছেন কর্মকর্তাদের। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যারা তথ্য দিতে চাননি, তাদেরকে তথ্য কমিশনের নিকট পর্যন্ত মুখোমুখি করেছেন।
শুধু তাই নয়, এই আইনটি তারা মানতে বাধ্য সেই অঙ্গিকারও কমিশনের শুনানিতে আদায় করেছেন তিনি। বে-সরকারি সংগঠন এমআরডিআই এর পৃষ্টপোষকতা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সচেষ্ট হয়েছেন বলে জানা গেছে। জনগণের সরকারি-বেসরকারি সেবা পেতে তিনি জনগনকে সহায়তা করছেন। তথ্য সৈনিক হিসাবে এলাকায় তিনি এখন দৃষ্টান্ত।
আশরাফ হোসেন (৫০) উপজেলার জামলতা গ্রামের মৃত আব্দুল খালেকের ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয় সন্তান। বর্তমানে এলাকায় তিনি কাঠ ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচিত।
আশারফ হোসেন জানান, দীর্ঘদিন ধরে চলার পথে তার মনে প্রশ্নের জন্ম নিত। ইউনিয়ন পরিষদে প্রত্যেক বছরে বিভিন্ন প্রকল্পে টাকার বরাদ্দ, হাসপাতালে প্রতি বছর সরকারি ওষুদের পরিমাণ, ভূমি অফিসে জমির নামপত্তন করতে সরকারি টাকার পরিমাণ জানার আগ্রহ ছিল তাঁর। ইতোপূর্বে সরকারি অফিসে তথ্য চেয়েও তিনি তথ্য পাননি। বরং তাকে তথ্য চাওয়ার কারণে নানা কথা শুনতে হয়েছে। তুচ্ছ এবং তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন।
জানা গেছে, তিনি এমআরডিআই নামের বে-সরকারি একটি সংগঠন থেকে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৫ সালের ২২ আগষ্ট বিশাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের উদ্বোধন করা হয়।
তিনি বলেন, আমি এত সুন্দর অনুষ্ঠানে আগে কখনো উপস্থিত হয়নি। তথ্য অধিকার ক্যাম্পের মাধ্যমে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে আমি অনেক কিছু জানতে পারি। এই ক্যাম্পে প্রত্যেক সরকারি অফিসে কি ধরনের সেবা দেওয়া হয় তা জানতে পারি। কোন তথ্য জানা জনগণের অধিকার সেটা বুঝতে পারি।
আশারফ হোসেন আরো বলেন, ক্যাম্প শেষে ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত ৩০ জন মিলে বিভিন্ন সরকারি ও বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানে তথ্য চেয়ে ৩৯টি আবেদন করি। এই আবেদনের পর প্রত্যেক অফিসে হুলুস্থুল কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায়। বিষয়টি আমাকে আরো আগ্রহি করে তোলে। সে কারণে ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইনটি বাস্তবায়নে আমি নাগরিক হিসেবে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেই। জনগণের তথ্য জানার যে ভীতি ছিল সেই ভীতি আমি দূর করার চেষ্টা করছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কাঠ ব্যবসায়ী আশারফ হোসেন এখন উপজেলার দুর্নীতিবাজ, অনিয়মকারী সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের নিকট মূর্তিমান আতঙ্কের নাম।
ইতোমধ্যে উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতাল, বে-সরকারি সংস্থা শিশু নিলয়, সমাজসেবা অফিস, ধুলিয়ানী ইউনিয়ন সচিব, সিংহঝুলী ইউনিয়ন সচিবের কাছে তথ্য চেয়ে তিনি পাননি। তথ্য অধিকার আইনে আপিল করলেও নির্ধারিত সময়ে তথ্য না পেয়ে হতাশ হন আশারফ হোসেন। ফলে আইনের ২৫ এর ক ধারা মোতাবেক তিনি তথ্য কমিশনে ডাকযোগে অভিযোগ পাঠান। পরবর্তীতে কমিশনে শুনানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের হাজির করে ভৎসনা করা হয়। একই সাথে তথ্য দিতে তারা বাধ্য হন।
তথ্য অফিস সূত্রে আরো জানা গেছে, যেখানে তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখেন, সেখানেই তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে তথ্য চান আশারফ হোসেন। পাশাপাশি তিনি তথ্য জানার জন্যও তথ্য চেয়ে আবেদন করেন।
চৌগাছার পল্লী বিদ্যুৎ অফিস, ৫০ শয্যা হাসপাতাল, নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস, প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তর, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের অফিস, বে-সরকারি সংগঠন আশা, ব্রাক, শিশু নিলয়, সিংহঝুলী ইউনিয়ন পরিষদ, জেলা ভূমি অফিস, ধুলিয়ানী ইউনিয়ন পরিষদ, উজিরপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, সিভিল সার্জন অফিস, জেলা পরিষদসহ তথ্য চেয়ে ৪০টি আবেদন করেন। আইনটি যারা বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়েছে, তাদেরকে তিনি তথ্য কমিশনে হাজির করে তাদের জবাব নিতে বাধ্য করেছেন।
জানা গেছে, আশারফ হোসেন বে-সরকারি সংগঠন শিশু নিলয় চৌগাছা শাখা বরাবর ঋণ বিতরণ কর্মসূচির তথ্য চেয়ে আবেদনের কপি নিয়ে সংশ্লিষ্ট অফিসে জমা দিতে যান। কিন্তু অফিস কর্তৃপক্ষ তার আবেদন জমা নেননি। কেন জমা নেওয়া হবে না জানতে চাইলে উল্টা তাকে ভৎসনা করা হয়। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে তথ্য অধিকার আইনের ২৫ এর ক ধারা অনুযায়ী ডাকযোগে তথ্য কমিশনের অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে শিশু নিলয় কর্তৃপক্ষ কমিশনের শুনানিতে হাজির হয়ে ক্ষমা চান।
একইসঙ্গে ভবিষ্যতে কেউ তথ্য চাইলে হয়রানি করা হবে না-এ মর্মে সতর্ক করে দেন কমিশন। এছাড়া তিনি জেলা ভূমি অফিসে খ তফসিল বর্ণিত একটি জমির বিষয়ে তথ্য চেয়ে আবেদন করলে জানানো হয় এই তথ্য তাদের কাছে নেই। এতে তিনি হতাশ হয়ে পুনরায় একই তথ্য চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। এরপর ২০ কার্যদিবসের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে তার কাছে চিঠি আসে। এর প্রেক্ষিতে তিনি মন্ত্রণালয়ে গেলে ওই তথ্যের বিষয়ে অভিযোগের সুষ্ঠু নিস্পত্তি হয়। এভাবে তিনি এমআরডিআই এর সহযোগিতায় তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে আশারফ হোসেন বলেন, কাউকে হয়রানি করার জন্য নয়, জনগণ তথ্য চাইলে তথ্য অধিকার আইনের আওতায় তথ্য দিতে হবে। আমি গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ। আমি বুঝি, জনগণ যদি তথ্য জানতে পারে তাহলে অনিয়ম ও দুর্নীতি কম হবে। বিভিন্ন অফিসে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে আশারফ হোসেন প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন তা এখন সিংহঝুলী ইউনিয়নসহ চৌগাছার অনেকে জানতে পেরেছেন। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের তার নাম মুখস্ত। তার এই কাজে জনগণের বেশ উপকার হচ্ছে বলেও জানান অনেকে।
এও জানা গেছে, রোগীরা হাসপাতালে গিয়ে আশারফ হোসেনের নাম বললে চিকিৎসকরা দ্রুত চিকিৎসাসেবা দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বেশ কয়েকজন রোগীর সাথে কথা বললে এর সত্যতা পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে লস্কারপুরের আহাদ আলী (৫৫), জামলতার খাইরুল হোসেন (৫০), নারায়নপুরের সাহারবানুর (৬৫) কাছে জানতে চাই তারা জানান, আশারফ হোসেনের পরামর্শে আমরা হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলাম। হাসপাতালে গিয়ে তার নাম বলা হলে আমাদের তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ভালোভাবে দেখে চিকিৎসাপত্রসহ ফ্রি ওষুধও দিয়ে দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে বে-সরকারি সংগঠন এমআরডিআই এর নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান মুকুর কালের কণ্ঠকে বলেন, তথ্যের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষে সাধারণ, প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে এমআরডিআই কাজ করে। সেই কাজের ফলাফল হচ্ছে আশারফ হোসেন। তিনি এখন ওই অঞ্চলের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন।
আইনের উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি বা বে-সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। এমআরডিআই এর মাধ্যমে ওই অঞ্চলের মানুষ এখন তথ্য অধিকার আইন বিষয়ে জানতে পেরেছেন। তারা এখন প্রাপ্ত সেবা নিয়ে প্রতিনিয়ত জানতে চাই। আশারফ হোসেন এখন দৃষ্টান্ত।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইবাদত হোসেন বলেন, আশারফ হোসেন যে কাজটি করছেন তা সত্যি ভালো লাগার বিষয়। প্রত্যেক জনগণকে সচেতন হতে হবে। তাহলে আমারদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।-কালের কণ্ঠ