বুধবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪, ০২:১৯:৪৯

কুঁড়েঘরেই সুখী ১১৪ বছরের জাহেরা, যেতে চান না ছেলেদের পাকা ঘরে

কুঁড়েঘরেই সুখী ১১৪ বছরের জাহেরা, যেতে চান না ছেলেদের পাকা ঘরে

আকতারুজ্জামান, মেহেরপুর: ‘যে ঘরে স্বামীর সঙ্গে সত্তর বছর কাটিয়েছি, জন্ম দিয়েছি চৌদ্দটি সন্তান। সেই স্মৃতি আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই সারাজীবন। যদিও স্বামী গত হয়েছেন ত্রিশ বছর। তবে এখনও মনে হয় উনি এ ঘরেই আছেন।’— এমন নানা স্মৃতি বিজড়িত অভিমত ব্যক্ত করছিলেন ১১৪ বছরের বৃদ্ধা জাহেরা বেগম।

জাহেরা বেগম মেহেরপুর গাংনী উপজেলার কচুইখালি গ্রামের মৃত আতর আলির স্ত্রী। তিনিই ওই গ্রামের একমাত্র শতবর্ষী বৃদ্ধা। বয়সের ভারে নুইয়ে পড়লেও রান্নাবান্নাসহ সংসারের সব কাজই করেন স্বাভাবিকভাবে। এই যুগে মাটির দেয়াল ও ঘরের চাউনির ঘর বিলুপ্তি হলেও এখনও বিভিন্ন এলাকার মানুষ দেখতে আসেন জাহেরা বেগমের মাটির দেয়াল আর আট চালা খড়ের ঘরটি। 

মাত্র ১৪ বছর বয়সে স্বামীর ঘরে আসেন জাহেরা বেগম। তখন স্বামীর যশ ছিল, খ্যাতি ছিল। সে সময় স্বামী তৈরি করেছিল ৮ চালা বিশিষ্ট একটি মাটির ঘর। সে ঘরেই শুরু হয় তাদের দাম্পত্য জীবন। তিনি সংসার জীবনে মা হন ১৪টি সন্তানের। তার ৮ ছেলে ও ৫ মেয়ে রয়েছে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে সবাই আছেন স্বামীর সংসারে। ছেলেরা সবাই স্বাবলম্বী। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে পাকা ঘর। সব ছেলেরা মা জাহেরা বেগমকে তাদের সঙ্গে থাকতে বললেও পাকা ঘরে থাকতে নারাজ বৃদ্ধা। স্বামীর স্মৃতি আকড়ে ধরে স্বামীর হাতের নির্মিত আট চালা চিলিকোঠা ঘরেই থাকতে চান তিনি।

বৃদ্ধা জাহেরা বেগম বলেন, ছেলেদের সবারই পাকা ঘর হয়েছে। আমাকে তারা তাদের পাকা ঘরে রাখতে চায়। আমি সেখানে থাকতে চাই না। স্বামীর তৈরি ঘরটাকেই আমার স্বর্গ মনে হয়। স্বামীর সঙ্গে সংসারের অনেক স্মৃতিই জড়িয়ে আছে এই মাটির ঘরে। ঘরে ঢুকলেই মনে পড়ে স্বামী-সন্তানের হাজারও স্মৃতি। বয়স হলেও এখনও সংসারের কাজ করতে ভালো লাগে। এখনও স্বাভাবিকভাবেই চলতে পারি। যতদিন বেঁচে আছি এখানেই থাকতে চাই।

তিরি আরও বলেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচারে সন্তানদের বাঁচাতে এবং নিজের জীবন বাঁচাতে ভারতে পালিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীন হলে আবারও ফিরে আসি আপন ঘরে। ১৪ সন্তানের মধ্যে ৪ ছেলে মারা গেছে। এখনও বেঁচে আছে ১০ ছেলে মেয়ে।

জাহেরা বেগমের বড় ছেলে নুর ইসলাম বলেন, আমার মায়ের অনেক বয়স হয়েছে। আমরা চেষ্টা করেছি তাকে আমাদের সংসারে রাখতে। কিন্তু কোনোভাবেই তাকে বোঝাতে পারি না। সে মাটির ঘরেই থাকতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমরাও আমার বৃদ্ধা মায়ের যত্ন নিয়ে থাকি। মা বলে পাকা ঘরে শীতের সময় বেশি শীত। আর গরমকালে বেশি গরম।

ছোট ছেলে তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মাকে বুঝিয়ে যখন মাটির ঘর থেকে সরাতে পারিনি তখন সে ঘরের পাশেই আমি পাকা ঘর নির্মাণ করেছি। যাতে আপদে বিপদে আমিও মায়ের পাশে থাকতে পারি। আশপাশের গ্রামে আর এতবড় মাটির ঘর নেই। অনেক মানুষই আমাদের মাটির ঘরটি এখনও দেখতে আসে। ঘর দেখতে এসে অনেকেই আবেগ আপ্লুত হন। 

ঘর দেখতে আসা গাংনী শহরের সিদ্দিকী শাহিন জানান, একসময় জীবন ধারনের একমাত্র বাসস্থান মাটির দেয়াল আর খড়ের ছাউনি। এখন আর চোখে পড়ে না। তাই বৃদ্ধা জাহেরার মাটির ঘরটি দেখতে এসেছি। ব্দ্ধৃা বয়সেও মাটির ঘরটি অনেক যত্ন করে রাখেন জাহেরা বেগম।

স্থানীয় ইউপি সদস্য খোকন মিয়া বলেন, খুব বেশি দিনের কথা নয়, যেখানে প্রতিটি গ্রামেই চোখে পড়তো প্রায় এক তৃতীয়াংশ মাটির বাড়ি। অনেকেই মাটির দেয়াল আর খড়ের ঘরকে আরও দৃষ্টিনন্দন আর পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী আট চালা ঘর তৈরি করে বসবাস করতেন। সে ঘরকে আমরা চিলিকোঠা বলে থাকি। ইদানিং সেসব ঘর আর চোখে পড়ে না। জাহেরা বেগম তার নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় আজও মাটির ঘরটিকে সুন্দর করে রেখেছেন। তাছাড়া যারা মাটির তৈরি ঘর নির্মাণকাজে যেসব কারিগররা নিয়োজিত ছিল তারাও  পেশা পরিবর্তন করেছেন। যার ফলে মাটির ঘর আর কেও নির্মাণ করছেন না।

প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করা পিএসকেএস এর নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসেন বলেন, এখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু তুলনামুলক অনেক কম। সেখানে ১১৪ বছরের বৃদ্ধা জাহেরা বেগম এখনও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করেন। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে তার স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যাবতীয় সহযোগিতা করব।

ধানখোলা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমার ইউনিয়নের কচুইখালি গ্রামের জাহেরা বেগমকে চিনি। তার বয়স প্রায় ১১৪ বছর। 

তিনি জন্ম দিয়েছেন ১৪টি সন্তান। আশপাশের গ্রামের তিনিই একমাত্র বয়স্কো নারী। আমরাও চেষ্টা করেছি তাকে সরকারি ‘‘জমি আছে ঘর নাই ’’ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি নিতে চাননি। স্বামীর তৈরী মাটির ঘরেই তিনি বাকি জীবন কাটাতে চান। প্রবীণ ব্যক্তি হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সরকারি সুবিধা দেয়া হয় বৃদ্ধা জাহেরা বেগমকে।-ঢাকা পোস্ট

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে