ইমাদ উদ দীন ও সাজিদুর রহমান সাজু : ডিসেম্বরে দেশে আসার টিকিট বুকিং ছিল। স্বামীর ছুটির তিনমাস দেশে কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু এর আগেই ৪ সন্তানসহ লাশ হয়ে দেশে আসছেন মৌলভীবাজারের রোকেয়া (৩৪)। আহাজারি আর শোকের মাতম চলছে তার পরিবারে।
স্বজন হারানোর বেদনায় রোকেয়ার শ্বশুরালয় কমলগঞ্জ ও বাবার বাড়ি মৌলভীবাজারে চলছে শোকের মাতম। গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামে গেলে কথা হয় নিহত রোকেয়া বেগমের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।
সোমবার রাত থেকেই তাদের মতো পাড়া-প্রতিবেশীরাও এই দুর্ঘটনার খবরে শোকাচ্ছন্ন। গুজারাই গ্রামের হাফিজ মাওলানা মো. আব্দুল জব্বার (৭৮) এর কনিষ্ঠ মেয়ে রোকেয়া বেগম (৩৪)। ২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
১৯৯৯ সালে পারিবারিক সম্মতিতে কমলগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামের কুয়েতি বাড়ির তজ্জমুল আলীর ২য় পুত্র জুনেদ আহমদের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। জুনেদ কুয়েত সেনাবাহিনীর (সিভিল) অধীনে চাকরি করতেন। তাই বিয়ের ৫-৬ মাস পর জুনেদ আহমদ তার স্ত্রীকে কুয়েতে নিয়ে যান। প্রায় ১৭ বছর থেকেই তারা কুয়েতে বসবাস করছেন। এই দম্পতির ৪ সন্তান রয়েছেন।
জামিলা জান্নাত (১৫), ইমাদ আহমদ (১২), নাবিলা জান্নাত (১০) ও ফাহাদ আহমদ (৬)। নিহত ৪ শিশু ও কিশোর সবাই সেদেশে লেখাপড়া করতেন। রোকেয়া বেগম (৩৪) এর বড় ভাই মো. জাকারিয়া জানান রোকেয়া ছোট বেলা থেকে ছিলেন খুবই ধার্মিক ও অতিথি পরায়ন। কুয়েতে যাওয়ার পরও শ্বশুর বাড়ি ও বাবার বাড়ির স্বজনদের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
অনেক অসহায় পরিবারকে গোপনে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে জানান, আজ প্রিয় বোনটি ৪টি সন্তানসহ আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আমি আমার পরিবারের পক্ষ থেকে সবার কাছে তাদের নাজাতের জন্য দোয়া চাই।
জাকারিয়া আহমদের বড় ছেলে মো. ইয়াহইয়া সিদ্দিকী বলেন, সোমবার রাতে তার সঙ্গে তার ছোট ফুফু রোকেয়া বেগমের কথা হয়েছে। সে এ বছর বরিশাল সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিএসএ ভর্তির সুযোগ পাওয়ায় তিনি অনেক খুশি ছিলেন। আর তাকে আশ্বস্ত করে বলছিলেন, আমি তো ডিসেম্বরে দেশে আসছি। বাবা তুমি ঠিকমতো পড়ালেখা চালিয়ে যাও।
ইয়াহইয়া জানালেন, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও তার ফুফু পড়ালেখার খোঁজখবর নিয়ে তাদের নানাভাবে অনুপ্রাণিত করতেন। রোকেয়া বেগমের বাবা হাফিজ মাওলানা আব্দুল জব্বার বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, সোমবার রাতেই মারা যাওয়ার কিছু আগেই তার সঙ্গে আমার ও তার মায়ের কথা হয়েছে। ফোন দিয়েই সে সবার আগে আমাদের শরীরের খোঁজ খবর নিত। গতকালও ফোন দিয়ে শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেয়ার পর বলেছিল, আব্বা আমি তো ডিসেম্বরে আসছি। ৩ মাসের ছুটি পেয়েছি। টিকিটও কনর্ফাম করেছি। ইনশাআল্লাহ পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা হবে।
তিনি বলেন, আমার মেয়েটি বিদেশে থাকলেও তার মন পড়ে থাকত দেশে। তাই সুযোগ পেলেই পরিবারের সদস্যসহ সব আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখত। আমার মেয়ের সঙ্গে আর কোনোদিনও কথা হবে না, দেখা হবে না। আর আমার শরীরেরও খোঁজ খবর নেবে না। আল্লাহ আমার মেয়েকে তুমি জান্নাতবাসী কর।
রোকেয়ার বড় বোনের জামাই নাজিম উদ্দিন জানান, গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত প্রায় ৯টার দিকে সর্বশেষ তার শাশুড়ির সঙ্গে কথা চলাকালীন সময়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন রোকেয়া বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ি সবারই খুব প্রিয় ছিল। ডিসেম্বরে সপরিবারে দেশে আসার কথা থাকলেও এখন সে ও তার সন্তানরা আসছে লাশ হয়ে।
এদিকে একই অবস্থা চলছে কমলগঞ্জের সদর ইউনিয়নের কান্দিগাঁও গ্রামে। পুরো গ্রামজুড়ে চলছে শোকের মাতম। কারণ গ্রামের সবার সঙ্গে জুনেদ আহমদের পরিবারের রয়েছে সুসম্পর্ক। এলাকায় তাদের বাড়ি কুয়েতি বাড়ি হিসেবে পরিচিত। জুনেদের পিতা মৃত তজ্জমুল আলী দীর্ঘদিন কুয়েত প্রবাসী ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় জুনেদও কুয়েত প্রবাসী হন।
জুনেদ আহমদের ২ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে দুই ভাই জুবের আহমদ সপরিবারে থাকেন আমেরিকায় ও শোয়েব আহমদ সপরিবারে থাকেন লন্ডনে। গ্রামের বাড়িতে থাকা জুনেদ আহমদের মা মরিয়ম বেগমের কান্না কিছুতেই থামাতে পারছেন না স্বজন ও প্রতিবেশীরা। ছেলে বউ আর নাতি নাতনির কথা স্মরণ করে বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মরিয়ম বেগম জানালেন, ডিসেম্বর আসার আগেই আমার সবই শেষ। আর কোনোদিন আমি ওদের কথা আর শুনব না। এই বলে কিছুতেই আর তার কান্না থামানো যাচ্ছিল না। জুনেদ আহমদের প্রতিবেশী মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন ও তার স্ত্রী জানান, এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের গ্রামের মানুষের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। তাদের পরিবারের এই দুর্ঘটনায় পুরো গ্রামের মানুষ শোকাহত।
ইউপি সদস্য সুন্দর আলী জানান, এই মর্মান্তিক ঘটনা জানার পর থেকে পুরো ইউনিয়ন ও উপজেলাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমেছে। মর্মান্তিক ঘটনার খবর পেয়ে পরিবারটির প্রতি সমবেদনা জানাতে গ্রামের বাড়িতে আসেন কমলগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহমুদুল হক।
জুনেদ আহমদের খালাত ভাই খিজির আহমদ ও রোকেয়া বেগমের বড় ভাই মো. জাকারিয়া জানান, জুনেদ আহমদ কুয়েত সিটির সালমিয়াত এলাকার একটি ৫তলা ভবনে সপরিবারে থাকতেন। জুনেদ ও রোকেয়া দম্পতি তাদের ৪ সন্তানসহ ওই ভাড়া নেয়া বাসার ৫ম তলায় থাকতেন। আর ৫ম তলা পুরোটাই তারা ব্যবহার করতেন।
ওইদিন ৩য় তলায় এসির কম্প্রেসার বিস্ফোরণের পর গ্যাস সিলিন্ডারও বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বাসার বারান্দাগুলোতে সোফা থাকায় আগুন ও ধোঁয়া দ্রুত পুরো বাসায় ছড়ায়। এ সময় ৫ তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসার সময় তারা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যান। ঘটনাটি ঘটে সোমবার কুয়েত সময় বিকাল ৫টার দিকে। এ সময় জুনেদ আহমদ বাইরে থাকায় তিনি বেঁচে যান।
খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনিও সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। বর্তমানে চিকিৎসা নেয়ার পর তিনি সুস্থ আছেন এবং উভয় পরিবারের সঙ্গে কথাও বলেছেন বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন। নিহতদের লাশ আল কবির হাসপাতালে রাখা হয়েছে। লাশ দেশে আসার কার্যক্রমও চলছে। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি