মৌলভীবাজার থেকে : ৪ বছর পর জেলার আলোচিত চা শ্রমিক অবনী বাকতি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে পিবিআই পুলিশ। তদন্তে পরকীয়ার কারণে অবনী বাকতি হত্যাকাণ্ডের বিষয় নিশ্চিত হয়েছে পিবিআই। গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার জেলা পিবিআই পুলিশ কার্যালয়ে প্রেস বিফিংয়ে লিখিত বক্তব্যে এই মামলার আদ্যোপান্ত ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
প্রেস বিফিংয়ে এ বিষয়টি তুলে ধরেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক তরিকুল ইসলামসহ অন্যরা।
জানা যায় একাধিক তদন্তের পরও মামলার রহস্য উদঘাটন না হওয়ায় বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশে মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিবিআই পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়। পিবিআই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ পরিদর্শক, সুমন কুমার চৌধুরী গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৭ সালে মামলাটির তদন্ত শুরু করেন।
তিনি মামলাটি তদন্তকালীন জানতে পারেন অবনী বাকতি (লব) তার প্রতিবেশী জেলার কমলগঞ্জ থানার ফুলবাড়ি চা বাগানের ৭নং লাইনের বাসিন্দা মৃত অনন্ত বাকতির পুত্র রদিপ বাকতি (২৬), মৃত রতি তন্তবাইর পুত্র দেবাশীষ তন্তবাই (২৭), সীতারাম, পিতা-অজ্ঞাত এদের সঙ্গে সে ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতো।
তারা সবাই একই স্থানে মদপান করতো। অবনী বাকতি তাদের সঙ্গে চলাফেরার কারণে সে তার প্রতিবেশী ও বন্ধু রদিপ বাকতির বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। অবনী বাকতি রদিপ বাকতির বাড়িতে আসা-যাওয়ার কারণে তার কাকীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। এই মামলার ঘটনার অনুমান ১ মাস পূর্বে এই সম্পর্কের বিষয়টি রদিপ বাকতি জানতে পারে। এরপর থেকে অবনী বাকতির সঙ্গে রদিপ বাকতির সম্পর্কের দূরত্ব ও মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়।
এই মনোমালিন্যের জের ধরে রদিপ বাকতি তার অপর দুই বন্ধুর সহযোগিতায় অবনীকে হত্যার পরিকল্পনা করে বলে তিনি অবগত হন। ২৬শে জানুয়ারি ২০১৮ পুলিশ পরিদর্শক সুমন কুমার চৌধুরী ইউএন মিশনের জন্য মনোনীত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মো. শিবিরুল ইসলাম, পুলিশ পরিদর্শক মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি গ্রহণ করার পর এই হত্যাকাণ্ডের একই কারণ খুঁজে পান।
প্রাপ্ত তথ্যের যাচাই-বাছাই শেষে গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি অবনী বাকতি হত্যায় মূল সন্দেহভাজন আসামি রদিপ বাকতিকে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয়। সে অবনী বাকতি হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়। জানা যায়, অবনী বাকতি ছিল তার পিতামাতার একমাত্র সন্তান। তার কোনো নিকটাত্মীয় ছিল না। এই মামলার বাদীর স্ত্রী অবনী বাকতির দুঃসম্পর্কের পিসাতো বোন ছিল।
অবনী বাকতি চুনারুঘাট থানাধীন দেউন্দি চা বাগানের পিতা-প্রসেন বাকতির মেয়ে জননী বাকতিকে বিয়ে করেছিল। পরস্পরের সহিত বনিবনা না হওয়ায় মাত্র ৩-৪ মাস সংসার করার পর তাদের দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ ঘটে। অবনী বাকতি নিঃসন্তান ছিল। বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে ঘটনার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ১ বছর অবনী বাকতি তার ঘরে একাকী বসবাস করতো। তার সঙ্গে শীতারাম, দেবাশীষ ও রদিপ বাকতির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।
তারা প্রায়ই একসঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরা করতো। অবনী বাকতি প্রায়ই রদিপ বাকতির বাড়িতে আসা যাওয়া করতো। রদিপ বাকতির চাচা অসুস্থ থাকায় ও অবনী বাকতি ওই বাড়িতে যাওয়া আসায় তার কাকীমার সঙ্গে অবনী বাকতি প্রথমে প্রেম, পরবর্তীতে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আসামি রদিপ বাকতি ওই সম্পর্কের বিষয়টি শুনে শীতারাম ও দেবাশীষকে জানায়। শীতারাম প্রথমে অবনী বাকতিকে এই সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তা ছিন্ন করে সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে।
এই ঘটনার প্রায় মাসখানেক পর ৩রা জানুয়ারি ২০১৪ সালে রদিপ বাকতি ও শীতারাম ওইদিন দুপুর ১২টার দিকে ফুলবাড়ি চা বাগানে বাঁশ কাটতে গেলে দেখতে পায় অবনী বাকতি ও তার কাকী অনৈতিক কাজে লিপ্ত। তখন তারা দুজনে মিলে অবনী বাকতিকে এই অনৈতিক কাজে বাধা দিলে সে ওদেরকে গালিগালাজ করে। একই সঙ্গে তাদের হুমুকিও দেয়।
ওইদিন সন্ধ্যার দিকে রদিপ বাকতি, দেবাশীষ দেব ও শীতারাম অবনী বাকতির বাড়িতে যায় এবং এ বিষয়ে পুনরায় ভিকটিমকে সতর্ক করলে সে তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। তার দুর্ব্যবহারের কারণে উপরোক্ত আসামিরা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন রাত অনুমানিক ৯টার দিকে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক শীতারাম (২৮) তার সঙ্গে বল্লম (পিকল) নিয়ে রদিপ বাকতি (২৭) ও দেবাশীষ (দেব)কে সঙ্গে নিয়ে পুনরায় অবনী বাকতির বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে।
রাত ১০টার দিকে তারা সুকৌশলে ফুলবাড়ি চা বাগানের ১০নং সেকশনে মন কুচি কুচি এলাকায় রাস্তার পাশে নিয়ে আসে। মন কুচি এলাকায় আসার পর তারা বিষয় অবনী বাকতির সঙ্গে পুনরায় তর্কে লিপ্ত হয়। তর্কের এক পর্যায়ে আসামিরা ভিকটিমকে মারধর করে। একপর্যায়ে ধস্তাধস্তি হয়।
ধস্তাধস্তিতে অবনী মাটিতে পড়ে গেলে দেবাশীষ দেব ও রদিপ বাকতি তার উপরে হাঁটু গেড়ে বসে এবং শীতারাম অবনী বাকতির মাথায় পিকল দিয়ে আঘাত করলে মাথার এক পাশ হতে অন্য পাশ দিয়ে ছিদ্র হয়ে যায়। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণেই ঘটনাস্থলেই অবনী বাকতি মারা যায়। এই হত্যার সঙ্গে জড়িত একজন আটক রয়েছে। পলাতক অন্য দুই আসামি শীতারাম (২৮), দেবাশীষ দেবকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে বলে জানায় পিবিআই পুলিশ। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসএস