মঙ্গলবার, ২৮ জুন, ২০১৬, ০৬:৫৭:৪৮

সেরা শিক্ষক এবং ভালো বন্ধু তিনি

সেরা শিক্ষক এবং ভালো বন্ধু তিনি

আকমল হোসেন: পড়াশোনা বিষয়টি বোঝার পর থেকে ইচ্ছা ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হওয়ার। শিক্ষক তিনি হয়েছেন, তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এতে কোনো খেদ নেই তাসনীম চৌধুরীর। তাঁর কথা ‘বরং ভালোই হয়েছে। একজন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হচ্ছে তাঁর শৈশব। মনোবিকাশের প্রাথমিক স্তর এটি। এই সময়ে শিশুদের কাছে থাকার সুযোগ পাওয়া গেছে।’ তাসনীম চৌধুরী মৌলভীবাজার সদর উপজেলার লামা কাগাবলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ২০১৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষায় জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা নির্বাচিত হয়েছেন। ৪ ফেব্রুয়ারি (২০১৬) জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খুশহালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। যদিও তাঁর কথায়, এই পেশায় বেশির ভাগ আসেন চাকরি করার মানসিকতা নিয়ে। কিন্তু শিক্ষকতা কোনো চাকরি নয়। সেবা এবং পেশা হিসেবে এটি মহান।

তাসনীম চৌধুরী বলেন, ‘আমি শিশুদের সঙ্গে শিশু হয়ে কাজ করি। তাদের মতো, তাদের সরলতার কাছাকাছি গিয়ে তাদের বন্ধু হলেই ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।’ অনেক শিশুই অপুষ্টিতে ভোগে। তাই তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত ‘খাদ্য, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য’ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করে একটি চার্ট তৈরি করেছেন। পুষ্টি নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের পারিবারিক বিভিন্ন বিষয় জানার চেষ্টা করেন। সমস্যা-সম্ভাবনার জায়গাটুকু বুঝে সেভাবে পরামর্শ দেন। তাতে সুফল পাওয়া যায়। পিছিয়ে পড়া, প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেন। পড়ালেখার বাইরে কাজের একটি নমুনা দিয়ে বলেন, তায়রা আক্তার নামে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রী শুধু লবণপানি দিয়ে ভাত খেত। ঝাল খেতে পারত না। এতে সে শারীরিক নানা সমস্যায় ভুগছিল। তার সঙ্গে মিশে ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে তার খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করেছেন। এখন সে সবকিছু খেতে পারে।

কাগাবলা গ্রামের অভিভাবক যমুনা আক্তার বলেন, ‘আমার মেয়ে এমেলি আক্তার আইএ পাস করেছে। এই মাস্টারনির সহযোগিতা না থাকলে এতদূর পড়া তার সম্ভব হতো না।’ মিলনপুর উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র সাগর দাস জানিয়েছে, সে ও তার এক বোন পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছে ম্যাডামের (তাসনীম চৌধুরী) কারণে। ম্যাডাম তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতেন। সব বিষয়ে উৎসাহ দিতেন। বাকপ্রতিবন্ধী পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রিজওয়ানা আক্তারসহ অনেক ছাত্রছাত্রী আছে। যারা আলাদা মনোযোগ দাবি করে। তাদের ‘কেস স্টাডি’ তৈরি করেছেন। যা অনুসরণ করে এই শিশুদের প্রতি যত্ন ও শিক্ষা দেওয়া হয়। এর বাইরেও তিনি গান গেয়ে থাকেন, ছবি আঁকেন, প্রবন্ধ-নিবন্ধসহ বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি করেন। সহজলভ্য জিনিস দিয়ে শিক্ষা উপকরণ তৈরি করে পাঠদান করেন। অর্ণবে অনন্তকাল নামে তাঁর একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। স্কুলে দেয়ালিকা প্রকাশ করেন।


দুই মেয়ে ও এক ছেলের মা তিনি। এদের সামলানোর দায়িত্ব পালন করছেন তাঁর মা বেগম নীহারিকা। মায়ের সহযোগিতা না থাকলে তাঁর পক্ষে স্কুল ও শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নশীল হওয়া সম্ভব হতো না। কাজের ক্ষেত্রে স্বামী শেখ বুরহান উদ্দিনেরও সমর্থন আছে। তিনিও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তাঁর শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করছে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে তাঁর কিছু চিন্তাভাবনাও আছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে আরও কার্যকর ও মানসম্মত করতে মনোবিজ্ঞানী দিয়ে শিক্ষকদের কাউন্সিলিং করা, পাঠ্যপুস্তকে নৈতিকতা-মানবিকতা ও সম্প্রীতিবিষয়ক উপভোগ্য রচনা সংযুক্ত করা, শিশুদের সৃজনশীলতা বাড়াতে শিশু একাডেমির শিশু পত্রিকা প্রতি বিদ্যালয়ে পাঠানো, পাঠাগার গড়ে তোলা, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, খাদ্যপুষ্টিবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য সরবরাহ ও অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, বাস্তবসম্মত ও কার্যকর মনিটরিং করা, শিক্ষার্থীদের একই পোশাক পরা ইত্যাদির ওপর জোর দিতে চান তিনি।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মারুফ আহমদ বলেন, ‘উপজেলার একটি প্রত্যন্ত স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তাঁকে নির্বাচন করা হয়েছিল। জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ হওয়ার মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়েছে, আমাদের নির্বাচন সঠিক ছিল। তাঁর অনেক এক্সট্রা কারিকুলাম আছে। তিনি গান পরিবেশন, ছবি আঁকা ও লেখালেখি করেন। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে ভাবেন। তাঁর এ সাফল্যে আমরা খুশি। তিনি জেলায় একটি মডেল। এতে অন্যরাও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হবেন।-প্রথম আলো

২৮ জুন,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে