নওগাঁ: নিঝুম গ্রামে রাত নামলে শুধুই মেশিনের শব্দ। দিনে প্রচণ্ড তাপ আর রাতে বেশ শীত শীত অনুভূত হয়। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া। এর মাঝেই কেটে যাচ্ছে তিনটি মাস। বাজার বলতে বালুভরা হাট। সেখানেই যা নাশতা-পানি জোটে। তাও অনেকটা দূর। তবু ভালো পাশ দিয়ে চলে গেছে পাকা একটি সড়ক। আর অনুসন্ধান এলাকায় দিন-রাত তিন শিফটে কাজ করে গেছেন তরুণ চার প্রকৌশলী ও চারজন ভূত্বত্ত্ববিদ। অবশেষে সাফল্য ধরা দিয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় চুনাপাথর খনির সন্ধান মিলেছে নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার তাজপুর মৌজায় তিলকপুর বেসিনে।
বাংলাদেশ ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তরের এই আট কর্মকর্তাকে অনুসন্ধানের এই কষ্টসাধ্য কাজে শুরু থেকেই অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক ড. মো. নিহাল উদ্দিন। আর নিরলস শ্রম দিয়ে প্রায় ৯ বছরের পুরনো একটি রিগ মেশিন দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তাঁরা। প্রাপ্তি আর সফলতায় তাঁদের মুখে এখন হাসি ফুটে উঠেছে। দেশ আজ চুনাপাথর নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য প্রাপ্ত চুনাপাথরের নমুনা পাঠানো হয়েছে পরীক্ষাগারে। চুনাপাথরের রিজার্ভ ও বিস্তৃতি জানতে আরো চার-পাঁচটি স্থানে অনুসন্ধান চালানো হবে।
গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থলে গিয়ে অনুসন্ধান দলের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে বিশাল এলাকাজুড়ে চুনাপাথরের মজুদ রয়েছে। ভূগর্ভের দুই হাজার ২১৪ ফুট গভীরে এর সন্ধান মিলেছে। এ পর্যন্ত দুই হাজার ২৮৫ ফুট পর্যন্ত খনন করা হয়েছে। তাতে চুনাপাথরের যে স্তর পাওয়া গেছে তার পুরুত্ব ৯১ ফুট। তবে এই পুরুত্বের পরিমাণ আরো বাড়তে পারে। তিলকপুর বেসিনকে কেন্দ্র ধরলে এর চারদিকে ৫০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত চুনাপাথরের বিস্তৃতি রয়েছে। বর্তমান যে রিগ মেশিনটি আছে তা দিয়ে সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার ফুট পর্যন্ত খননকাজ পরিচালনা করা যাবে। এরপর রয়েছে আদি শিলা, যারপর আর কোনো খনিজ সম্পদ থাকে না।
সূত্র জানায়, প্রায় ৫০ বছর আগে এ এলাকায় প্রাথমিকভাবে খনিজ সম্পদের ওপর জরিপ চালানো হয়েছিল। তখন চুনাপাথর অথবা কয়লা পাওয়া যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও এ নিয়ে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়নি। এবার দেশের অভিজ্ঞ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানী দল অসম্ভবকে সম্ভব করতে চলেছে। তারা আশা করছে, এখান থেকে যে পরিমাণ চুনাপাথর পাওয়া যাবে তা দিয়ে দেশের সিমেন্ট তৈরির বিশাল একটি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
বর্তমানে এখানে দায়িত্ব পালন করছেন ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ড্রিলিং প্রকৌশল) মহিরুল ইসলাম, মাসুদ রানা ও মঈন উদ্দিন আহমেদ, সহকারী পরিচালক (ড্রিলিং প্রকৌশল) মিনহাজুল ইসলাম, উপপরিচালক (ভূতত্ত্ব) হাসান শাহরিয়ার, সহকারী পরিচালক (ভূতত্ত্ব) মোহাম্মদ মাসুম, এ জে এম এমদাদুল হক ও জোবায়ের মাহমুদ।
ক্ষতিপূরণ নিয়ে সংশয়ে এলাকাবাসী : এদিকে চুনাপাথরে বিশাল খনি আবিষ্কারের খবরে নওগাঁর বদলগাছি উপজেলার বিলাসবাড়ী ইউনিয়নের তাজপুর মৌজাসহ আশপাশের এলাকার মানুষ উল্লসিত। এই খনিকে ঘিরে এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন হবে, নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এমন প্রত্যাশা তাদের। একই সঙ্গে বসতবাড়ি ও আবাদি জমি হারানো এবং যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার শঙ্কাও প্রকাশ করেছে তারা।
দৌলতপুর, তাজপুর, কটকবাড়ী, হাজীপুর, বারফলা, লক্ষ্মীপুর, ভগবানপুর গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের এমন শঙ্কার কথা জানা গেছে। তারা খনি পাওয়া নিয়ে যতটা উল্লসিত ঠিক ততটাই শঙ্কিত ভবিষ্যতে তাদের বসতবাড়ি ও আবাদি জমিজমা বেহাত হওয়া নিয়ে।
এলাকাবাসীর বক্তব্য, ‘এখানে চুনাপাথরের বিশাল খনি পাওয়াটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সুখবর। এই খনিকে কেন্দ্র করে এলাকার উন্নয়ন হবে। মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ তৈরি হবে। তবে আমরা চাইব, আমাদের দীর্ঘদিনের ভাতের থালার (যে জমিতে ধান উৎপাদন হয়) যেন কোনো ক্ষতি না হয়। আর যদি হয় তবে সরকার যেন তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে।’
বারফলা গ্রামের আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘তাজপুরে যে চুনাপাথর পাওয়া গেছে তাতে আমরা আনন্দিত। কিন্তু এখানে চুনাপাথর উত্তোলনের কাজ শুরু হলে আমাদের জায়গা-জমি বেহাত হয়ে যাবে। সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে আমাদের বিপাকে পড়তে হবে। আমরা আশা করব, সরকার আমাদের ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করবে।’
বারফলা গ্রাম থেকে সবে নতুন বাড়ি তৈরি করে দৌলতপুর গ্রামে উঠে এসেছেন ফিরোজা বিবি। তিনি বলেন, ‘খনির জন্য যদি বাড়িঘর ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে হয় তাহলে আমাকে রাস্তায় নামতে হবে। তবে সরকার আমাদের জন্য ভিন্ন ব্যবস্থা করে দিলে কোনো সমস্যা হবে না।
২৩ এপ্রিল,২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ