এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : নীলফামারী জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় বসে ফ্রিল্যান্সিং করে কোটিপতি হয়েছেন রায়হান মিয়া। মাসে তাঁর সর্বোচ্চ আয় আট লাখ টাকারও বেশি। নিজ খরচে অনেক তরুণ-তরুণীকে ফ্রিল্যান্সিংও শেখাচ্ছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ে রায়হানের সফলতার গল্প জানাচ্ছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান!
সব সময় নিজে কিছু করতে চাইতেন রায়হান মিয়া। ইউটিউব, গুগল ঘেঁটে জানাতে পারেন ফ্রিল্যান্সিং করেও টাকা আয় করা সম্ভব। ২০১২ সালে ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউটে গ্রাফিক ডিজাইন কোর্স করেন। পাশাপাশি এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকেও নেন পরামর্শ।
কিন্তু কাজের দেখা পাচ্ছিলেন না একদমই। তাই ওই সময়টায় পলিটেকনিকের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং করাতে থাকেন।
অবশেষে সুসময়ের দেখা
২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়। তখনো ফ্রিল্যান্সিংয়ে একটি টাকাও আয় হয়নি তাঁর। ২০১৪ সালের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের এক বায়ারের প্রতি সপ্তাহে ৪৮০ ডলারের একটি কাজের মাধ্যমে তাঁর আয়ের শুরু। তিন মাস এই কাজ নিয়মিত করেছেন। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
যেভাবে কোটিপতি
রায়হান কাজ করেন লিড জেনারেশন, অটোমেশন অ্যান্ড শপিজ অ্যান্ড উইক্স, ওয়েব ক্রলিং, ওয়েব এক্সট্রাকশন, ডেটা মাইনিং, তালিকা বিকাশকারী, ব্রাউজার অটোমেশন, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বিষয়ের ওপর। আপওয়ার্ক, ফাইভার মূলত তাঁর প্রধান মার্কেটপ্লেস।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে মার্কেটপ্লেসে তিনি সর্বোচ্চ আট লাখ ৬৯ হাজার ৩০৬ টাকা আয় করেছেন। গড়ে তাঁর মাসিক আয় পাঁচ লাখ টাকারও বেশি। আপওয়ার্কে তিনি ৫৭৪টি প্রজেক্টের মধ্যে ৩৫৯টি সফলভাবে শেষ করেছেন। চলমান আছে ২১৫টি প্রজেক্ট।
শুধু আপওয়ার্ক থেকে তাঁর আয় চার কোটি পেরিয়েছে অনেক আগেই। তাঁর ক্লায়েন্টদের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ইত্যাদি দেশের নাগরিক।
অভাবকে জয়
কৃষক বাবা। ছয় ভাই। বড় সংসারের মূল দায়িত্বটা চাপে রায়হানের কাঁধে। তিনি যে সবার বড়। সে কারণে স্কুলজীবন থেকে রায়হানকে পড়াশোনার পাশাপাশি আয়ের পথ খুঁজতে হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘স্কুলজীবন থেকে কোচিং করাতাম পরিবারকে সাহায্য করার জন্য। চেষ্টা করতাম নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই যেন চালিয়ে নিতে পারি। অর্থের অভাবে মাইলের পর মাইল হেঁটে বাসায় আসতে হতো।’
সাদিয়া আইটি
একসময় রায়হান দেখলেন, মফস্বলের ছেলেমেয়েরা সেভাবে ফ্রিল্যান্সিং শেখার সুযোগ পাচ্ছে না। এ জন্য ২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সাদিয়া আইটি। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী তিনি।
তিনি বলেন, ‘মফস্বলে বা গ্রামে অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা মেধাবী। তারা যেন ফ্রিল্যান্সিং শিখে সফল হতে পারে সেই ভাবনা থেকে সাদিয়া আইটি করা। এই প্রতিষ্ঠানে ১৫ জন কর্মী ফুলটাইম কাজ করছেন।
তাঁরা রায়হানের কাছেই ফ্রিল্যান্সিং শিখেছেন। তাঁদের পেছনে মাসে প্রায় লাখ তিনেক টাকা খরচ হয় রায়হানের। নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ থানার পারেরহাট বাজারে সাদিয়া আইটির অবস্থান। সাদিয়া আইটি থেকে এ পর্যন্ত ৩০০ জন ফ্রিল্যান্সিং শিখেছে।
উদ্যোক্তা তৈরি
রায়হান নিজে শুধু ফ্রিল্যান্সিংয়ে সফল হয়ে বসে থাকেননি। অনেককে শিখিয়েছেন ফ্রিল্যান্সিং। তাঁরা সফলভাবে ওয়েব ডেভোলপার, লিস্ট ডেভোলপার, বিটুবি লিড জেনারেটর, গ্রাফিক ডিজাইনার, কনটেন্ট রাইটার হিসেবে কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে রেদয়ান আলী, জুয়েল রানা, রিপন মিয়াসহ অনেকেরই মাসিক আয় প্রায় দুই লাখ টাকা।
যত পুরস্কার
কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সালে রায়হান মিয়া পেয়েছেন বেসিস আউটসোর্সিং অ্যাওয়ার্ড। এ ছাড়া পেয়েছেন জেলাভিত্তিক বেস্ট ফ্রিল্যান্সার অ্যাওয়ার্ড। ২০২৩ সালে রাইজিং ইউথ অ্যাওয়ার্ড আর রংপুর বিভাগের সেরা ফ্রিল্যান্সার হওয়ার গৌরব তিনি অর্জন করেছেন।
মফস্বলে বসে ফ্রিল্যান্সিং
মফস্বলে বসে ফ্রিল্যান্সিং করতে কোনো সমস্যা হয় কি না জানতে চাইলে রায়হান বলেন, ‘মফস্বলে বসে ফ্রিল্যান্সিং করতে গিয়ে জটিল কোনো সমস্যার মুখে পড়িনি। তবে কাজের মধ্যে বারবার বিদ্যুৎ চলে যায়। ইন্টারনেটে কিছু সমস্যা হয়।’
রায়হানের কিছু টিপস
পেশাদারত্ব আর কাজের প্রতি নিষ্ঠা, একাগ্রতা থাকা চাই। অর্জন করতে হবে উপযুক্ত কোনো দক্ষতা, যা দিয়ে কিনা বিশ্ববাজারে টিকে থাকা যায়। ইংরেজি যেমন জানতে হবে, তেমনি ক্লায়েন্টকে বুঝানোর দক্ষতাও থাকা চাই।
ফ্রিল্যান্সিং শিখেও অনেকেই কাজ পান না। এর পেছনের কারণ হিসেবে তিনি আরো বলেন, ‘দক্ষ শিক্ষকের কাছে না শেখা। রাত জেগে কাজ অনুসন্ধান না করা। দিনের পর দিন লেগে থাকার প্রয়োজনবোধ না করা।’
প্রতারক চেনার উপায়
ব্যাঙের ছাতার মতো ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর নামে প্রতারণার অভিযোগের শেষ নেই। এই প্রতারকদের চেনার কিছু উপায় বাতলে দিলেন রায়হান।
- মার্কেটপ্লেসে এদের কোনো প্রফাইল থাকে না।
- প্রফেশনাল প্রফাইল থাকে না।
- অল্প টাকায় অফার করে যেকোনো কোর্স।
- অফিস থাকে না।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকায় বাড়ি, গাড়ি
ফ্রিল্যান্সিংয়ের টাকায় দুটি বাড়ি করেছেন রায়হান। কিনেছেন গাড়িও। সাদিয়া আইটির পাশাপাশি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলে তাঁর অর্থে। পাঁচ ভাইকে প্রতিষ্ঠার নেপথ্যেও আছে তাঁর ফ্রিল্যান্সিংয়ের আয়। ব্যবসা, গরুর খামার করার জন্য তিনি টাকা দিয়েছেন ভাইদের।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
নীলফামারী জেলায় হাজার হাজার প্রতিভাবান তরুণ-তরুণী আছে। তাদের ফ্রিল্যান্সিং শেখাতে চান রায়হান। তিনি মনে করেন, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ দিলে এই তরুণ-তরুণীরা অনেক ভালো করবে। নিজেদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি তারা অন্যদের জন্যও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে। অসংখ্য পরিবার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।
পরিবার
দাদি, বাবা, মা, ছয় ভাই, ভাইয়ের সন্তান ও স্ত্রী, নিজের দুই মেয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে রায়হান থাকেন নীলফামারী জেলার কিশোরগঞ্জ থানার সিঙ্গেরগাড়ী পারের হাটবাজার গ্রামে।
তিনি কিশোরীগঞ্জ বহুমুখী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি পাস করে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন। পরিবারে আগে কেউ ফ্রিল্যান্সিং না করলেও ছোট ভাই রেদয়ান আলী টপ রেটেট প্লাস আপওয়ার্ক ফ্রিল্যান্সার।-কালের কণ্ঠ