বিচিত্র জগৎ ডেস্ক : ১৯৫৮ সাল। চীনে তখন চলছে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বাধীন ‘মহান উল্লম্ফনের অভিযান’ বা Great Leap Forward। উদ্দেশ্য ছিল—চীনকে দ্রুত শিল্প ও কৃষিতে উন্নত করে তোলার মাধ্যমে একটি স্বনির্ভর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা। এই অভিযানের অংশ হিসেবে শুরু হয় এক অবিশ্বাস্য ও ইতিহাসখ্যাত অভিযান—চড়ুই পাখি নিধন কর্মসূচি।
পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে চীনের কৃষিজমিতে চড়ুই পাখির উৎপাত নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে প্রশাসন। অভিযোগ ছিল, ঝাঁকে ঝাঁকে চড়ুই এসে কৃষকের মাঠের পাকা ধান খেয়ে নিচ্ছে। এতে ধানের উৎপাদন কমে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়। বিষয়টি চীনের সর্বময় নেতা চেয়ারম্যান মাও সেতুং-এর কানে যেতেই তিনি ঘোষণা দেন—চীনের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে চড়ুই পাখিকে নির্মূল করতে হবে।
‘ফোর পেস্ট ক্যাম্পেইন’—এক ভয়াবহ পরিবেশবিরোধী আন্দোলন
এই অভিযানের অংশ ছিল ‘চারটি কীটপতঙ্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ বা Four Pests Campaign, যার লক্ষ্য ছিল চারটি প্রাণীকে নির্মূল করা: ইঁদুর, মাছি, মশা, চড়ুই (Sparrow)।
সরকারি নির্দেশে শুরু হয় এক চড়ুই নিধনযজ্ঞ। শিশু-কিশোরদের হাতে দেওয়া হয় গুলতি, বড়দের হাতে বাজনার ড্রাম। কোথাও কোথাও ড্রাম বা পাত্র পেটানো হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যাতে চড়ুই পাখি বসতে না পারে।
ফলে চড়ুইয়েরা আকাশেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত এবং অবশেষে মাটিতে পড়ে মারা যেত। সেইসঙ্গে চড়ুইয়ের বাসা, ডিম ও ছানাগুলোও ধ্বংস করে দেওয়া হতো। এক দিনে শুধু সাংহাই শহরেই প্রায় দুই লাখ চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়—এমন তথ্য পাওয়া যায় ঐতিহাসিক দলিলে।
শুরু হলো অদৃশ্য বিপর্যয়
চড়ুই নিধনের পর চীনের জনগণ ভেবেছিল—এবার হয়তো ধানের ফলন বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ঠিক উল্টো।
পরের বছর দেখা গেল, ধান গাছে পোকামাকড়ের ভয়ানক আক্রমণ শুরু হয়েছে। চড়ুই পাখি নিধন করে ফেলার ফলে ধানের ক্ষতিকর পোকা যেমন গুবরে পোকা, শুঁয়োপোকা ইত্যাদির প্রাকৃতিক শত্রু আর অবশিষ্ট ছিল না। কীটনাশক দিয়েও এসব পোকা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না।
সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয় ১৯৬০ সালে, যখন পঙ্গপালের ভয়াবহ আক্রমণে লাখ লাখ একর জমির ফসল ধ্বংস হয়ে যায়। এতে উৎপাদন আরও কমে আসে এবং শুরু হয় এক মারাত্মক দুর্ভিক্ষ।
চীনজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দুর্ভিক্ষ। খাদ্যের জন্য হাহাকার শুরু হয় গ্রামে-গঞ্জে। ইতিহাসবিদদের মতে, এই দুর্ভিক্ষে প্রায় দেড় কোটির বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যদিও কিছু তথ্যে সংখ্যাটি তিন কোটির কাছাকাছিও হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, যার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছিল চড়ুই নিধনের এই অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত।
দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন চেয়ারম্যান মাও বুঝতে পারেন যে চড়ুই নিধন ছিল এক বিশাল পরিবেশগত ভুল। পরে তিনি চড়ুই নিধনের আদেশ প্রত্যাহার করে নেন এবং পাকিস্তান থেকে নতুন করে চড়ুই আমদানি করে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কিন্তু তখন যা হওয়ার হয়ে গেছে। জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় সহজে পূরণযোগ্য ছিল না।
এই ঐতিহাসিক ঘটনা শুধু চীনের নয়, বরং বিশ্ববাসীর জন্য এক জাগ্রত বার্তা। প্রকৃতির নিজস্ব ভারসাম্য আছে—যেখানে প্রতিটি প্রাণী, এমনকি ছোট্ট একটি পাখিও গুরুত্বপূর্ণ।
চড়ুই শুধু ধান খেত না, বরং ক্ষতিকর পোকা দমনেও ছিল কার্যকর ভূমিকা। যখন সেই পাখিকে মুছে ফেলা হলো, প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দিয়ে।