মঙ্গলবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৬, ১১:২৬:৪৯

‘ধরেই নিয়েছি, সব শেষ’, মৃত্যুগহ্বর থেকে বেঁচে আসা এই তরুণী জানালেন লোমহর্ষক সেই কাহিনী

‘ধরেই নিয়েছি, সব শেষ’, মৃত্যুগহ্বর থেকে বেঁচে আসা এই তরুণী জানালেন লোমহর্ষক সেই কাহিনী

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত ইতিমধ্যে ১৩৩ জনে পৌঁছেছে। শনিবার স্থানীয় সময় দিনগত রাত ৩টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মৃত্যুগহ্বর থেকে বেঁচে এসেছেন ওই ট্রেনের এক যাত্রী নিকিতা সিং। নিজের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা তিনি জানিয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকাকে।
 
নিকিতা জানান, মাঝরাতে এভাবে আচমকা ঘুম ভাঙার ধাক্কা বোধহয় জীবনভর আমায় তাড়া করে বেড়াবে।
 
প্রথমেই ভয়ংকর একটা ঝাঁকুনি। তার পরে গোটা দুনিয়াটা ঝনঝনিয়ে কেঁপে ওঠা। এসি টু টায়ার, এ-ওয়ান কোচের আপার বার্থে জেগে উঠে তখন ধরে নিয়েছি, এ বার সব শেষ!
 
ট্রেনটা এক নাগাড়ে কেঁপেই চলেছে। আর আমি ভাবছি, ওপর থেকে গড়িয়ে পড়তে আর কতক্ষণ!
 
আশপাশ থেকে কান্নাকাটি-চিৎকার ভেসে আসছে। আর প্রায় ফ্ল্যাশব্যাকের মতো আমাদের কলকাতার বাড়ি, মা-বাবার মুখ, ফ্যামিলি অ্যালবাম' সব অন্ধকার কামরাটায় ভেসে-ভেসে উঠছে।
 
এই তো মামার বাড়িতে কত মজা করে আমি বারাণসী ফিরছি। কাশী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএড-এর ক্লাস আবার শুরু হবে। হবে কি? জীবনটাই পুরোপুরি খতম বলে তখন আমি মনে-মনে ধরে নিয়েছি, বলে চলেন নিকিতা।
 
কিন্তু ট্রেনের কাঁপুনি এক সময়ে থেমে গেল। একটা বিকট শব্দ! তারপর সব শান্ত। মনে হচ্ছিল, যেন কোনো পাহাড়ের খাড়াই ঢালে শুয়ে আছি।
 
কিছুক্ষণ পর একটা গলার স্বর কানে এল। 'আপ লোগ শান্ত হো জাইয়ে। চিল্লাইয়ে মাত! ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হুয়া হ্যায়। কোশিস কিজিয়ে কম্পার্টমেন্ট কে লাইট জ্বলানে কা...'
 
হাতড়ে-হাতড়ে আলো জ্বালাতেই দেখলাম, নীচের বার্থের 'আন্টি' মেঝেয় পড়ে ছটফট করছেন। ভারী দু'খানা স্যুটকেস তার উপরে পড়েছে। চেষ্টা করেও সরাতে পারছেন না।
 
নিকিতা বলেন, আমার পাশের আপার বার্থে ছিল, বান্ধবী অমৃতা পাঠক। আমরা দু'জনেই ঢাল বেয়ে নেমে কামরায় দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ট্রেনটা এমনভাবে এক দিকে হেলে আছে, নিজের পায়ে দাঁড়ানোই যেন অসম্ভব।
 
বার কয়েক চেষ্টা করেও আন্টির উপর থেকে স্যুটকেসগুলো সরাতে পারলাম না। শেষটা এসি কামরার খাবার রাখার তাকের কোণে এক পা রেখে নীচে ঝুঁকে যতটুকু পারি, চেষ্টা করলাম। অনেক চেষ্টায় সরানো গেল স্যুটকেসটা। আন্টি উঠে বসলেন।
 
ততক্ষণে অনেকেই দমাদ্দাম বাড়ি মেরে জানালার কাচ ভাঙবার চেষ্টা করছেন। কামরা হেলে থাকার দরুণ এক দিকের দরজা দিয়ে বেরোন যাবে না!
 
যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন 'দাদা' মিলে অন্য দিকের দরজাটা খোলার চেষ্টা করছিলেন। ওই দরজা দুটো তখন পুরো 'জ্যাম'! কিছুতেই খুলছে না। হাতুড়ি না কী যেন একটা দিয়ে মেরে, মিনিট পনেরোর চেষ্টায় দরজা আলগা হল। বাইরেটা তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার।
 
আমরা সবাই এক-এক করে নীচে নামছিলাম। রড ধরে একটু নীচে পৌঁছে, প্রায় ফুট ছয়েক উপর থেকে লাফ।
 
ওই অচেনা সহযাত্রী দাদারাই ভরসা দিচ্ছিলেন, কিচ্ছু হবে না, নেমে এসো! তখন রাত সাড়ে তিনটে বেজে গিয়েছে। আমরা নেমে যাওয়ার পরে ওরা আবার ভিতরে ঢুকলেন। সবার 'সামান' ওরাই নামিয়ে দিলেন।
 
আলো ফোটার আগে অবধি কত ভয়ংকর অঘটন যে ঘটে গিয়েছে, তার কিছুই কিন্তু বুঝিনি। আমরা তো ইঞ্জিন থেকে তিন নম্বর কামরাটায় ছিলাম। মাঝে মোটে একটা কামরা, একই রকম হেলে রয়েছে! তার পরের কামরাটাই দেখি ধ্বংসস্তূপ। পিছনের কামরাগুলো সব তালগোল পাকানো অবস্থায়।
 
কয়েকজন 'দাদা' মিলে ভেতর থেকে লোকজনকে বের করার চেষ্টা করছেন। আমার মাথা ভোঁ-ভোঁ করছিল। আমি আর অমৃতা শক্ত করে দু'জনে দু'জনকে ধরে ছিলাম!
 
বোধহয় সকাল সাতটা-সাড়ে সাতটা হবে। না, বারাণসীতে এখনই যাওয়ার সাহস হয়নি। লক্ষণৌ আমার দিদির বাড়ি। আমরা ওখানেই চললাম।
 
ঘণ্টা চারেক বাদে লক্ষণৌয়ে পৌঁছে দিদিকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ বসেছিলাম। আতংকে মুখে কথা সরছিল না। একটু খেয়ে, ঘুমিয়ে এখন শরীরে জোর পাচ্ছি।
 
খালি মনে হচ্ছে, আমাদের 'কোচ'টার পরে মোটে একখানা কামরা আস্ত ছিল! তার পরই সাক্ষাৎ মৃত্যু। একটা হঠাৎ ঝটকা খেলনা পুতুলের মতো সব ভেঙেচুরে ছারখার করে গিয়েছে। -যুগান্তর।
২২ নভেম্বর, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে