আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জারি করা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি রাজ্যের আদালত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ আংশিক স্থগিত করার আদেশ দিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিমানবন্দরে আটকা পড়েছেন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত দেশগুলোর কয়েকশ’ মুসলিম নাগরিক। আর বিমানবন্দরগুলোর বাইরে সাধারণ মার্কিনিরা ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও আসছে সমালোচনা।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, মাত্র এক সপ্তাহ আগে ক্ষমতা নিয়েছেন ট্রাম্প। আর এ সময়ের মধ্যে তিনি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার মধ্যে সব থেকে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে ৭টি মুসলিম প্রধান দেশের মানুষদের আমেরিকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। এ আদেশ আসার পর অনেক অভিবাসী ও শরণার্থীদের বিমানে উঠতে দেয়া হয় নি। তারা আটকে পড়েন বিমানবন্দরে।
সিরিয়া, ইরান, ইরাক, সুদান, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সোমালিয়ার নাগরিকদের আগামী ৯০ দিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন ট্রাম্প। তার এ সিদ্ধান্তে নাগরিক অধিকার, বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রুপ ও ডেমোক্রেট দলের রাজনীতিকরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তারা ট্রাম্পের এ আদেশের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
মুসলিম নিষেধাজ্ঞা আদেশের পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিভিন্ন বিমানবন্দরে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতির অবতারণা হয়। এরপর নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনের এক ফেডারেল বিচারকের দেয়া রায় সাময়িক স্বস্তি এনে দেয়। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়ন (এসিএলইউ) আদালতে আটকে পড়া সফরকারীদের যুক্তরাষ্ট্রে থাকতে দেয়ার জন্য ট্রাম্পের আদেশে সাময়িক স্থগিতাদেশ চান। আদালত প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের অংশবিশেষে স্থগিতাদেশ দেয়।
এ সময় ব্রুকলিনের আদালতকক্ষের বাইরে উপস্থিত সমর্থক এবং ডালাস, শিকাগো, নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্য স্থানের বিমানবন্দরে প্রতিবাদকারীরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। তবে আদালতের এই আদেশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে পাল্টে দেবে না। রায়ে বিচারক বলেছেন, যারা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ ভিসা নিয়ে অবতরণ করেছেন তাদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো উচিত হবে না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর নাগরিকদের আমেরিকায় ঢোকার ওপর ৯০ দিনের যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে আইনজীবীরা আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।
শনিবার রাতে মার্কিন ডিস্ট্রিক্ট বিচারক অ্যান ডনলি রায়ে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের ফলে মার্কিন বিমানবন্দরে আটকে পড়া কয়েক ডজন মানুষের বিষয়টি রয়েছে। এসিএলইউ মামলাটি দায়ের করে। সংস্থাটি নির্বাহী আদেশের ওপর আদালতের এই সাময়িক স্থগিতাদেশকে নিজেদের বিজয় হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। এসিএলইউ’র অভিবাসন অধিকার প্রকল্পের উপ- পরিচালক লি গিলার্ন্ট বলেন, ‘এই রায়ে স্থিতিবস্থা বহাল রাখতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি এর দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, যাদের এ দেশে থাকার অধিকার রয়েছে তাদেরকে অবৈধভাবে আমেরিকার মাটি থেকে সরানো যাবে না।’
এসিএলইউ বলেছে, এর ফলে বৈধ ভিসা ও শরণার্থী মর্যাদা রয়েছে এমন ১০০ থেকে ২০০ মানুষ উপকৃত হবে। ট্রাম্প শুক্রবার রাতে ওই আদেশে সই করার পর তারা পথিমধ্যে বা মার্কিন বিমানবন্দরে আটকে আছেন। তবে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যখন দুই ইরাকিকে বৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টাকালে জন এফ কেনেডি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে (জেএফকে) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটকে দেয়। জেএফকে বিমানবন্দরে অন্তত ১২ জন লোককে আটক রাখা হয়েছে। ফলে বিমানবন্দরে গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জানিয়েছে কমপক্ষে ১০৯ জন ভ্রমণকারীকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশে সাতটি সংঘাতকবলিত মুসলিম দেশ থেকে কার্যত কোনো শরণার্থীর প্রবেশও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি কেউ গ্রিন কার্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র থাকলেও প্রবেশ করতে পারছেন না। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার বেলায় ট্রাম্প শরণার্থী নেবেন, তবে সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন খ্রিস্টানরা। আর আমেরিকার দীর্ঘ যাচাইবাছাই প্রক্রিয়ার কথা বিবেচনায়, মুসলিম শরণার্থীদের প্রবেশের বিষয়টিই কার্যত স্থগিত করে দেয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা দেয়া নির্বাহী আদেশে তাৎক্ষণিকভাবে বিপাকে পড়েছেন আনুমানিক ৩৭৫ জন ব্যক্তি। এর মধ্যে ১০৯ জন ছিলেন ট্রানজিটে। তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। অপর ১৭৩ জনকে বিমানে ওঠার আগেই আটকে দেয়া হয়।
এদিকে ট্রাম্পের এই আদেশের প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও প্রতিবেশী রাষ্ট্র কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভিন্ন বক্তব্য নিয়ে হাজির হয়েছেন। টরোন্টো বিমানবন্দরে এক সিরিয়ান শিশুকে অভ্যর্থনা জানানোর ছবি দিয়ে তিনি টুইটারে লিখেছেন, ‘যারা নির্যাতন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, আপনাদেরকে কানাডিয়ানরা স্বাগত জানাবে। আপনার ধর্মবিশ্বাস এক্ষেত্রে বিবেচ্য নয়। বৈচিত্র্য হলো আমাদের শক্তি। কানাডায় স্বাগতম।’
ট্রুডোর মুখপাত্র বার্তাসংস্থা এপিকে বলেছেন, কানাডার অভিবাসন ও শরণার্থী নীতির সফলতা নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে কথা বলবেন ট্রুডো। ধারণা করা হচ্ছে, খুব শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র সফর করবেন দেশটির অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র কানাডা। বৃটেনের বিরোধী লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিন বলেছেন, ‘মুসলিম নিষেধাজ্ঞা’ যতদিন বলবৎ থাকবে ততদিন ট্রাম্পের বৃটেন সফরে নিষেধাজ্ঞা থাকা উচিত।
জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছেন, শরণার্থীদের বা মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রগুলোর লোকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্য সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াই কোনো অজুহাত হতে পারে না। মার্কেলের মুখপাত্র স্টিফেন সেইবার্তের বরাত দিয়ে এ খবর দিয়েছে রয়টার্স। ওদিকে, ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা আসার পর ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্য মার্ক আয়রল্ট রোববার বলেন, শরণার্থীদের দুর্দশা বিবেচনা করাটা হলো দায়িত্ব। আর তাদের নিরাপদ আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করার পেছনে সন্ত্রাসবাদ কোনো বৈধ কারণ নয়। এক টুইটে তিনি বলেন, ‘শরণার্থীদের গ্রহণ করা হলে একাত্মতা প্রকাশ করার দায়িত্ব। সন্ত্রাসবাদের কোনো জাতীয়তা নেই। বৈষম্য এর জবাব নয়।’
এছাড়া, ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন টেক জায়ান্ট গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই। এর আগে সমালোচনা করেন ফেসবুকের প্রধান নির্বাহী মার্ক জাকারবার্গ। সুন্দর পিচাই বলেছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রে মেধাবী লোকজনের পাড়ি জমানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। গুগল এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় বিদেশে ভ্রমণরত নিজ কর্মীদের অবিলম্বে দেশে ফেরারও আদেশ দিয়েছিল।
নিজ কর্মীদের কাছে লেখা এক ই-মেইলে পিচাই বলেন, সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে লোকজনের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর যেই নিষেধাজ্ঞা তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গুগলের অন্তত ১৮৭ জন কর্মী। তিনি লিখেছেন, ‘এ নির্দেশের প্রভাব ও যেকোনো প্রস্তাব যার কারণে গুগল কর্মী ও তাদের পরিবারের ওপর কড়াকড়ি আরোপিত হয় বা যার কারণে দারুণ মেধাবীদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়, তা নিয়ে আমরা হতাশ।’ এ খবর দিয়েছে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল।
চিঠিতে সুন্দর পিচাই আরো বলেছেন, ‘এ নির্বাহী আদেশের ফলে আমাদের সহকর্মীদের যে ব্যক্তিগত ক্ষতি হলো তা দেখাটা যন্ত্রণাদায়ক।’ এদিকে বিবিসি জানিয়েছে, বিদেশে ভ্রমণরত নিজেদের প্রায় ১০০ কর্মীকে ডেকে পাঠিয়েছে গুগল।
কর্মীদের কাছে লেখা চিঠিতে ৪৪ বছর বয়সী পিচাই আরো জানান, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গুগলের কমপক্ষে ১৮৭ জন কর্মী এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছেন। তবে তিনি এ-ও লিখেছেন, আমাদের প্রথম কাজ হলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া গুগল কর্মীদের সাহায্য করা। যদি আপনারা বিদেশে থাকেন ও সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে, তাহলে দয়া করে আমাদের বৈশ্বিক নিরাপত্তা দলের কাছে যান।
চিঠির শেষে তিনি লিখেন, ‘এই আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা কাউকে গ্রাস করুক, বিশেষ করে আমাদের গুগল সহকর্মীদের, তা আমরা চাই না। এই অনিশ্চিত সময়ে, আমাদের মূল্যবোধই আমাদের সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয়।’
ওদিকে, প্রভাবশালী এক শিয়া ধর্মীয় নেতা মোকতাদা আল সদর রোববার মন্তব্য করেছেন যে, আমেরিকানদের ইরাক ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। এমজমিন
২৯ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি