আন্তর্জাতিক ডেস্ক : বিভিন্ন ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যাবাদিতা, মিথ্যা বিবৃতি ও অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি তথ্যভিত্তিক সমাজের ভঙ্গুরতাকেই তুলে ধরেছে। আর এটি নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক চলছে। অন্যদিকে বিদেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও শত্রুরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রত্যেকটি কথা বা বক্তব্যকে হুমকি বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তার চিহ্ন বা ইশারা হিসেবে বিবেচনা করে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যাবাদিতা তাদের মাঝে এক ভিন্ন ধরনের শংকার বীজ বপন করেছে। ট্রাম্পের প্রতিরক্ষা চুক্তি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য চুক্তি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করা যায় কিনা সে ব্যাপারে পরিমাপ করার চেষ্টা করছেন বিদেশী নেতারা। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ট্রাম্পের মতো একজন অস্থির মনের প্রেসিডেন্ট ছোটখাটো ইস্যুতে ত্রুটিপূর্ণ মন্তব্য করে তাদের মধ্যে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিচ্ছে যে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ বা ইরানের পরমাণু চুক্তির মতো বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট কেমন মন্তব্য করতে পারেন। অথচ এর সঙ্গে যুদ্ধ ও শান্তির মতো বিষয় জড়িয়ে আছে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম সপ্তাহে ধারাবাহিকভাবে কয়েকজন বিদেশী নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিন্তু টোকিও এবং বেইজিং থেকে লন্ডন ও বার্লিন পর্যন্ত বিদেশী নেতা ও কর্মকর্তারা প্রেসেডিন্ট ট্রাম্পের মিথ্যা কথন অতীব শংকার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছেন। ট্রাম্পকে তারা বিশ্বাস করতে পারেন কিনা সে ব্যাপারে তারা অনিশ্চিত। ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভালো যাবে কিনা সে ব্যাপারে তারা একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত পিটার ওয়েস্ট ম্যাকট বলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লোক সমাগমের আকার বা সেদিন তার প্যারেডে বৃষ্টি হয়েছিল কিনা- এ ধরনের অপেক্ষাকৃত গুরুত্বহীন বিষয়ে প্রেসিডেন্ট যদি মিথ্যা বলতে থাকেন সেটা ভালো কোনো ব্যাপার নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তবে যেমনটা আমি আমার স্টাফদেরকে বলতাম, ছোটখাটো বিষয়গুলোতে আমি যদি আপনার প্রতি নির্ভর করতে না পারি, বড় ব্যাপারে কীভাবে আমি আপনার ওপর নির্ভর করব।’
বিদেশী নেতাদের মধ্যে যারা নিরাপত্তার মতো ইস্যুতে বা তাদের পণ্যের বাজার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করেন, তাদের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনির্ভরযোগ্যতা একটি বড় ধরনের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা যেটা করতে পারে, মৌলিক বিষয়গুলোতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে সতর্ক করার চেষ্টা করা বা তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়া। যেমনটা দুই ইউরোপীয় নেতা জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল ও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে সম্প্রতি করেছেন। গত শনিবার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এক ফোনালাপকালে চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল সাত সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশের নাগরিকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর ট্রাম্পের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন।
অ্যাঞ্জেলা মার্কেলের মুখ্যপাত্র বলেন, চ্যান্সেলর প্রেসেডেন্টকে জেনেভা কনভেনশনের ব্যাপারে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। জেনেভা কনভেনশন মতে, মানবতার খাতিরে যুদ্ধের কারণে শরণার্থীদেরকে সুরক্ষা দেয়া দেশগুলোর দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। অন্যদিকে, শুক্রবার এক সরকারি সফরে হোয়াইট হাউসে যান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। তার লক্ষ্য ছিল ন্যাটোর ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অবস্থান কি সে বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া।
নির্বাচনী প্রচারণায় ও পরে জার্মানির পত্রিকা দ্য বিস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ন্যাটোকে সেকেলে বলে ব্যঙ্গ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’র সফরে তিনি আশ্বাস দেন, ন্যাটোকে যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করবে। প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে তাদের মধ্যকার এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন। কয়েকটি ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যা দাবির মাঝে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন কূটনীতিকরা। যেমন শপথ ও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জনতার উপস্থিতি বা লাখ লাখ লোক নির্বাচনে অবৈধ ভোট দিয়েছিল এবং তার ইঙ্গিতে ভোট দিয়েছিল এবং তার ইঙ্গিত রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার বা ইরানের পরমাণু চুক্তির ব্যাপারে কঠোর হওয়ার প্রতিশ্রুতি। পরে সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়েস্ট ম্যাকট বলেন, ওই প্রতিশ্রুতিগুলো ‘নগ্ন মিথ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত হওয়ার মতো কিছু নয়। বরং ওগুলো হচ্ছে পররাষ্ট্র নীতির প্রাথমিক বিবৃতি। তিনি বলেন, সম্ভবত ওগুলো ভালোভাবে চিন্তা-ভাবনা করে বলা হয়নি। ওই প্রতিশ্রুতিগুলোর ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং অন্যরা ভুল উপসংহার টানতে পারে। আর সে জন্যই ওই প্রতিশ্রুতিগুলো আরও পরিষ্কার হওয়া দরকার। ওয়েস্ট ম্যাকট বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তেরেসা মে’র বৈঠকই সেই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রথম কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে সত্য বিকৃত করা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে অভিপ্রায় এ ইস্যুগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ় নীতি বিচার করা আরও কঠিন করে তুলতে পারে। ওই ইস্যুগুলোতে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনহর মন্ত্রিসভার একজন সিনিয়র কর্মকর্তার যে মতামত তা তাদের বস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন এবং তাদেরকে প্রেসিডেন্টের চেয়ে শক্তিশালী হাত হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
কয়েকজন বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিথ্যাবাদিতায় আতংকের কোনো কারণ নেই। এই বিশেষজ্ঞদের কয়েকজন সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ কূটনীতিক স্যার হেনরি ওটনের একটি কথার স্মরণ করেছেন। স্যার হেনরি ওটন বলেন, রাষ্ট্রদূত হচ্ছেন একজন সৎ ও ভদ্রলোক, যাকে তার নিজের দেশের ভালোর জন্য মিথ্যা বলতে বিদেশে পাঠানো হয়। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একগুয়েমি তাদেরকেও চিন্তিত করে তুলছে। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একজন সমালোচক ইলিয়ট এ কোহেন বলেন, রাজনীতিকদের কৌশলগত মিথ্যা জনগণ ধরতে পারে। তবে ভয়ের কারণ যেটা সেটা হচ্ছে, ট্রাম্প যখন মিথ্যা বলেন, তিনি এ ব্যাপারে নির্ভার থাকেন। এই নির্ভার থাকার অর্থ হচ্ছে তিনি মৌলিকভাবেই বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। -যুগান্তর।
০৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/সৈকত/এমএম