বুধবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭, ১২:৩৮:৩৪

শপথ ভঙ্গ করে ফেলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প!

শপথ ভঙ্গ করে ফেলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের দিন ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী শপথ গ্রহণ করেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি শপথ নিয়ে ছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও এর পক্ষে থাকতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। এর এক সপ্তাহ পরেই ২৭ জানুয়ারি তিনি অভিবাসনবিষয়ক একটি নির্বাহী আদেশে সই করলেন।

এটা ছিল অসাংবিধানিক। ওই নির্বাহী আদেশে যুক্তরাষ্ট্রে পরবর্তী ১২০ দিন অভিবাসী প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। একই সঙ্গে মুসলিমপ্রধান ৭টি দেশ- ইরান, ইরাক, লিবিয়া, সোমালিয়া, সুদান, সিরিয়া ও ইয়েমেনের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ ৯০ দিন পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেন। এর মধ্যে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা দেন অনির্দিষ্টকালের জন্য।

ওই নির্দেশ সই করার পর ছাত্র, পর্যটক ও যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ অভিবাসী, যারা গ্রিনকার্ডধারী এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শরণার্থীদের আটকে দেয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরগুলোতে এবং বাইরেও তাই। এর মধ্যে কিছু মানুষকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। আবার কিছু মানুষকে বিদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাস্টমস ও বর্ডার প্রটেকশন বিভাগ বিমান সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।

তাদের বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রগামী কোনো ফ্লাইটে নিষিদ্ধ দেশগুলো থেকে কোনো আরোহীকে তোলা যাবে না। আর যদি বিমানে এমন কেউ থেকে থাকে তাহলে তাদের বিমান থেকে নামিয়ে দিতে বলা হয়। বিমান সংস্থায় কাজ করা নিষিদ্ধ ৭টি দেশের বিমান ক্রুদের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ওইসব দেশে দায়িত্ব পালন করা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের ইমিগ্রেশনে সাক্ষাৎকারের জন্য থামতে বলা হয়। একই সঙ্গে মুলতবি আছে যেসব ভিসার কর্মকাণ্ড তা স্থগিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এ অবস্থায় বিদেশে জন্মগ্রহণকারী ফ্যাকাল্টি সদস্য ও শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষগুলো নিশ্চয়তা দিতে চেষ্টা করে, তারা এ নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না।

নির্বাহী এ আদেশ দেয়ার মাধ্যমে ট্রাম্প তার সমর্থকদের দেখিয়েছেন, তিনি নির্বাচনী প্রচারণার সময় দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে যে শপথ তিনি নিয়েছেন তা শুধু তার সমর্থকদের খুশি করার জন্য নয়। তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে অঙ্গীকার করেছেন সব মানুষের স্বার্থরক্ষা করে সংবিধানকে সংরক্ষণ, সুরক্ষা ও পক্ষ অবলম্বন করবেন।

তার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে যখন তুরস্কের আঙ্কারার পথে তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ওই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। আঙ্কারায় ফিরে তেরেসা মে সাক্ষাৎ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের সঙ্গে। তার সঙ্গে একটি অস্ত্রবিষয়ক চুক্তি সম্পন্ন করেন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে তেরেসা মে শ্রদ্ধা প্রকাশ করেন ট্রাম্পের প্রতি। বৃটেন একবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেলে বৃটেনের স্বার্থে যায় এমন একটি বাণিজ্যিক চুক্তির আশা প্রকাশ করেন ট্রাম্প-তেরেসা।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ‘ভেরি স্পেশাল রিলেশনশিপের’ ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ওই বক্তব্য দেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ট্রাম্প অভিবাসনবিষয়ক যে আদেশ দেন সে বিষয়ে তিনি নতুন বন্ধু তেরেসা মে-কে অবহিত করেছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। ওদিকে তুরস্কে সাংবাদিকদের সামনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন তেরেসা মে। তিনি পরে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে কথা বলেন, যাতে বৃটিশ পাসপোর্টধারীরা ওই নিষেধাজ্ঞায় না পড়েন এবং তাদের ওপর এর কোনো প্রভাব না পড়ে এ বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে কথা বলতে নির্দেশনা দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।

ট্রাম্প হয়তো বহির্বিশ্বে আমেরিকা বিরোধী যে বিক্ষোভ হচ্ছে সে বিষয়ে অবহিত। ওয়াশিংটন যাদের ওপর শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য নির্ভরশীল সেসব জোট এর মধ্য দিয়ে দুর্বল হচ্ছে। তিনি পুরো ইউরোপে ডানপন্থিদের ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। তাকে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের পক্ষ থেকে বৃটেন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এজন্য বৃটেনজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রতিবাদ দেখা দিয়েছে। (শনিবারও সেখানে ৪০ লাখের মতো মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। তাদের হাতে ছিল ট্রাম্প বিরোধী বিভিন্ন স্লোগান সংবলিত ব্যানার, প্লাকার্ড)।

বৃটেনের কমপক্ষে ১৫ লাখ মানুষ ট্রাম্পকে জানানো আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করতে আহ্বান জানিয়েছে। পার্লামেন্ট সদস্যরাও একই আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখছেন। তারাও ট্রাম্পের সফর বাতিল করার আহ্বান জানাচ্ছেন। লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছেন, যতদিন পর্যন্ত নিষ্ঠুর ও লজ্জাজনক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হবে, ততদিন ট্রাম্পের বৃটেনে রাষ্ট্রীয় সফর স্থগিত করা উচিত। তবে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে যত বড় প্রতিবাদ বিক্ষোভই হোক না কেন ট্রাম্পের ওই সফর যেকোনো উপায়ে হবেই। ওদিকে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশগুলো, ইরাক, ইরান তো ক্ষোভে ফুঁসছে। তারা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশোধ নেয়ার হুমকি দিয়েছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সবেমাত্র দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। এ সময়ে তাকে বৃটেনে রাষ্ট্রীয় সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে রাজনৈতিক বিতর্কে নিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে। এটা তার বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হয়নি।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভাঙাকে উৎসাহিত করা অথবা ন্যাটোর মূল্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অথবা মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশগুলোকে শত্রু বানানো ট্রাম্পের জন্য কোনো স্মার্ট কাজ হয়নি। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, ইউক্রেন ও বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর প্রতি তার হুমকিকে মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন শক্তিশালী ও অনুগত ইউরোপীয় মিত্র। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে, ইসরাইলেও যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র প্রয়োজন। কিন্তু ট্রাম্পের মন্ত্র হলো ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। এর মধ্য দিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বাকি বিশ্ব থেকে ভয়াবহভাবে নিঃসঙ্গতার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

অভিবাসনবিষয়ক নির্দেশ জারি করার আগে তিনি দৃশ্যত কোনো গোয়েন্দা সংস্থা, আইন মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো শলাপরামর্শ করেননি। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি জন কেলি বলেছেন, তার মন্ত্রণালয় এমন নির্দেশ আসছে এ বিষয়ে অবহিত ছিল। তবে এক্ষেত্রে সরকারি কোনো কোনো আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে তাও কিন্তু স্পষ্ট নয়। শরণার্থীদের অবস্থাবিষয়ক জাতিসংঘের কনভেনশনের অধীনে আন্তর্জাতিক যেসব বাধ্যবাধকতা আছে ট্রাম্প স্পষ্টত তা মানেননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান ও আমেরিকার মূল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখাননি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জোর গলায় বলেছেন, তিনি পৃথিবীর বুক থেকে আইএস ও আল কায়েদাকে একেবারে মুছে দেবেন। আইরিশ প্রজাতন্ত্র ও ইসলামিক জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বৃটিশ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা জোরালোভাবে ফুটিয়ে তোলে যে, যাদের নাম ব্যবহার করে জঙ্গিরা তাদের কর্মকাণ্ড চালায় বিজয়ের জন্য সেই সব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে সহযোগিতা খুবই জরুরি। বিশ্বজুড়ে যেসব মুসলিমের সহযোগিতা খুব দরকারি ছিল তাদের ট্রাম্প বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। তিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নিষ্পেষণের শিকার শরণার্থীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। একই সঙ্গে আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে খ্রিস্টানদের অন্যরকম সুবিধা দেয়ার কথা বলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি আইনের শাসনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিশ্রুতি তার প্রতি মস্করা করেছেন।

উপরন্ত তার নির্বাহী আদেশ অনুমোদন করতে দ্বিমত করায় তিনি বরখাস্ত করেছেন ভারপ্রাপ্ত এটর্নি জেনারেল স্যালি ইয়েটসকে। ট্রাম্পের নীতিকে অনুমোদন করেছিলেন এমন রিপাবলিকানরাও ট্রাম্পের তড়িঘড়ি দেখে এখন আতঙ্কে। ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞা ফেডারেল কোর্ট চ্যালেঞ্জ করেছে। তবে সর্বশেষ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আবার সরকার আপিল করেছে। জাতীয় ও ধর্মীয় বৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে ট্রাম্প ওই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এটা অবশ্যই অসাংবিধানিক।

দেশজুড়ে ফেডারেল জজরা এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন। এই আইনি লড়াই শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়াতে পারে। দৃশ্যত, সুপ্রিম কোর্টও তার এই অগ্রহণযোগ্য পদক্ষেপকে অনুমোদন দেবে না। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে ট্রাম্প বেছে নিয়েছেন রক্ষণশীল নিল গোরসাশকে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের সরকারি কোনো দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা নেই। তার জানা উচিত আমেরিকার মানুষ সংবিধানে সুরক্ষিত তাদের আমেরিকান মূল্যবোধ দিয়ে পরিচালিত হবেন। এটাকেই তিনি সুরক্ষা দেয়ার, সংরক্ষণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

(লর্ড লেস্টার লিবারেল ডেমোক্রেট দল থেকে বৃটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব লর্ডসের একজন সদস্য এবং একজন ব্যারিস্টার। তিনি লন্ডনের টেম্পলে ব্লাকস্টোন চেম্বারসে সংবিধান ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন। তার লেখা সর্বশেষ বই হলো ‘ফাইভ আইডিয়াস টু ফাইট ফর’। বার্তা সংস্থা রয়টার্সে ৩রা ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ আবুল হোসেন) এমজমিন

০৮ ফেব্রুয়ারি,২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে