শুক্রবার, ২৫ আগস্ট, ২০১৭, ১২:৫৭:১১

উত্তরে আইনের শাসন, দক্ষিণে ঘাটে ঘাটে তেল

উত্তরে আইনের শাসন, দক্ষিণে ঘাটে ঘাটে তেল

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : চার বছর আগে বইটি প্রকাশের পরই বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল। বইটির নাম কেন জাতিসমূহ ব্যর্থ। ‘হোয়াই নেশনস ফেইল? দি অরিজিনস অব পাওয়ার, প্রোসপারিটি অ্যান্ড প্রোভার্টি’। সেই পুরনো প্রশ্ন, মানুষ গরিব কেন? এটা তার নিয়তি নাকি অন্য কিছু? একই প্রশ্ন উঠেছে দেশ ও জাতির প্রশ্নে। কিছু দেশ ধনী আর ধনী।

তাদের টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত শুধু বাড়ে আর বাড়ে। আর কিছু দেশ দরিদ্রই থেকে যায়। তার উন্নয়নের নামে কত রাজনীতি হয়, কিন্তু গরিবেরা গরিবই থেকে যায়। এটা কেন? কী তার কারণ? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, বিশ্বখ্যাত দুই অর্থনীতিবিদ এসিমগলু এবং রবিনসন। তাদের নজর এড়ায়নি দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপীড়িত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো।

(পর্ব-৩)
আমরা এ বইয়ে দেখব, মিশরের চেয়ে বৃটেন কেন ধনী? সেটা কি ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের ফসল? কেউ বলবেন, বৃটেনে বিপ্লব হয়েছিল কিন্তু‘ মিশরে হয়নি। বৃটেনের বিপ্লব হয়েছে বলে তার রাজনীতির রূপান্তরকরণ ঘটেছে এবং সে কারণে দেশের অর্থনীতি বদলে গেছে। মানুষ লড়াই করেছে। তারা তাদের রাজনৈতিক আদায় করে নিয়েছে। আর সেই আদায় করে নেয়া অধিকার দিয়ে তারা তাদের অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা সম্প্রসারিত করেছে। আর তার ফল হিসেবে এমন একটি ভিন্নমাত্রার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ট্রাজেক্টরি তৈরি করেছে, যা বয়ে এনেছে শিল্প বিপ্লব।

বৃটেনে শিল্প বিপ্লব এবং তার উৎকর্ষ সাধনের সুফল বা তার কোনো রেশ মিশর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়নি। কারণ তখন মিশর ছিল ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীনে। আর সেই শাসকগোষ্ঠী যেভাবে মিশরকে শাসন করেছিল, ঠিক সেই একই উপায় পরবর্তীকালে মোবারকের পরিবার বেছে নিয়েছিল। মিশরে ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের উৎখাত করেছিলেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট।

সেটা ১৭৯৮ সালের কথা। কিন্তু দেশটি তখন ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের কবলে পড়ে। আর তারাও ওসমানিয়া সাম্রাজ্যের নীতি অনুসরণ করে। আর সেই নীতি হলো মিশরের জনগণের স্বার্থের প্রতি উদাসীন থাকা। যদিও মিশরের জনগণ পরবর্তীকালে ওসমানিয়া এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং ১৯৫২ সালে রাজতন্ত্র উৎখাত করে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও মিশরের এই বিপ্লবকে ইংল্যান্ডের ১৬৮৮ সালের বিপ্লবের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। বিপ্লবীরা মিশরের রাজনীতির মৌলিক রূপান্তরকরণের পথে হাঁটেনি। তারা আসলে এমন এক শাসকগোষ্ঠীকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল, যারা আগেকার অভিজাত গোষ্ঠীরই ধারক-বাহক। তাই তাদের সঙ্গে ওসমানিয়া ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই তুলনা করা চলে। মিশরের সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষায় তাদের কোনো টান ছিল না। এর ফল দাঁড়াল এই যে সমাজের মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন এলো না এবং মিশর আগের মতোই গরিব থেকে যায়।

এই বইয়ে আমরা দেখব, কীভাবে এই প্যাটার্নগুলো সময়ের ধারায় নিজেদের জন্য ‘রিপ্রডিউস’ করে এবং কেন মাঝেমধ্যে তাতে একটা পরিবর্তন আসে। যেমনটা আমরা দেখেছি, ১৬৮৮ সালের ইংল্যান্ডে এবং ১৭৮৯ সালের ফ্রান্সে। এটা আমাদের বুঝতে সাহায্য করবে যে, মিশরের আজকের পরিস্থিতিতে যদি পরিবর্তন এসে থাকে, তাহলে যে বিপ্লব মোবারককে উৎখাত করেছে, তা দেশটির ভেতরে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটা শক্তিশালী করবে কি না; যা সাধারণ মিশরীয় নাগরিকদের জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে।

মিশর তার অতীত ইতিহাসে নানা ধরনের বিপ্লব দেখেছে। কিন্তু তা কোনো পরিবর্তন বয়ে আনেনি। কারণ, সেই সব বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারীরা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছে তাদের হাত থেকেই, যারা তাদের হাত থেকে একদা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এই যে, তারা আসলে একই পথের পথিক। শুধু ক্ষমতার হাত বদলই ঘটেছে।

ব্যবস্থার কোনো বদল হয়নি এবং যখনই হাত বদল হয়েছে, তখনই তারা পুনরায় আগের অবস্থা টিকিয়ে রেখেছে। অবশ্য এটা একটা সত্যি কঠিন বিষয় যে সাধারণ নাগরিকের পক্ষে প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন করা। আর যেভাবে সমাজ চলে আসছে তাকে বদলে ফেলাও সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন। কিন্ত অসম্ভব নয়। এই বইয়ে আমরা সেটাই দেখব।

সাধারণ জনগণের কাছে কীভাবে ক্ষমতা এসেছে। যেটা আমরা দেখেছি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে। আমরা দেখেছি জাপান, বোৎসোয়ানা ও ব্র্রাজিলে। মৌলিকভাবে একটি দরিদ্র সমাজকে ধনী সমাজে রূপান্তরিত হতে হলে তার একধরনের রাজনৈতিক রূপান্তর দরকার এবং কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে, এমন ঘটনা মিশরেও ঘটতে পারে।

তাহিরির স্কয়ারের আরেক প্রতিবাদকারীর নাম হলো রেদা মেতওয়ালি। তার যুক্তি হলো, ‘আপনি এখন দেখতে পাচ্ছেন, মুসলিম এবং খ্রিস্টানরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আপনি দেখতে পাচ্ছেন, নবীন ও প্রবীণরা জোট বেঁধেছে। তারা সবাই একটা বিষয় (পরিবর্তন) চাইছে।’ আমরা দেখব, মিশরীয় সমাজে এ ধরনের একটি ব্যাপকভিত্তিক আন্দোলন, সেটা কিন্তু অন্যান্য দেশে সংঘটিত যে রাজনৈতিক রূপান্তরের কথা আমরা বলছি, সেখানেও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হিসেবে ছিল।

আমরা যদি বুঝতে পারি যে, একটি জাতির জীবনে কখন এবং কেন ওই ধরনের ক্রান্তিকাল সংঘটিত হয়, তাহলে আমরা এটা বুঝতে একটা ভাল অবস্থানে পৌঁছতে পারব যে, কখন আমরা আশা করব যে অতীতের মতোই এ ধরনের আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে এবং কখন আমরা আশা করতে পারি যে, তা সাফল্যের মুখ দেখবে এবং লাখ লাখ জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।

১. কত ঘনিষ্ঠ যদিও তাতে কত পার্থক্য

রিওগ্রান্ডি উপত্যাকার অর্থনীতি : নোগালেস শহরটি কাঁটাতার দিয়ে বিভক্ত করা হয়েছে। শহরটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত। আপনি যদি এর পাশে দাঁড়ান আর উত্তর দিকে নজর দেন, তাহলে নোগালেস আপনার চোখে পড়বে। এটি অ্যারিজোনার সান্তাক্রুজ কাউন্টিতে অবস্থিত। এই শহরের বাসিন্দাদের গড় বার্ষিক আয় প্রায় ৩০ হাজার ডলার।

বেশির ভাগ টিনএজাররা স্কুলগামী এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের অধিকাংশ হাইস্কুল পেরোনো গ্র্যাজুয়েট। এসব সত্ত্বেও এখানকার মানুষেরা আক্ষেপ করে থাকেন যে, মার্কিন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কতটা অপ্রতুল। শহরের মানুষেরা অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান। বিশ্বমানের তুলনায় তাদের গড় আয়ুষ্কাল বেশি। বাসিন্দাদের অনেকেরই বয়স ৬৫ বছরের বেশি এবং তাদের রয়েছে, স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার।

সরকারের দেয়া সুযোগ-সুবিধার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা অন্যতম। বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা, জনস্বাস্থ্য এবং তার সঙ্গে এমন একটি সড়ক ব্যবস্থা; যা তাদের আঞ্চলিক শহরগুলোকে তো বটেই বাদবাকি আমেরিকার সঙ্গেও যুক্ত করেছে। কোনো প্রকারের ভয়-ভীতি ছাড়াই অত্যন্ত নিরাপদে নোগালেসের জনগণ যেখানে খুশি সেখানে ভ্রমণ করতে পারেন। তারা সর্বদা চুরি-রাহাজানি বা ছিনতাইয়ের ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকেন না। তারা একটুও উদ্বিগ্ন হন না এটা ভেবে যে, বাড়ি বা ব্যবসায়ে তাদের করা বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় কি না।

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মাঝে মধ্যে কিছু দুর্নীতি এবং অদক্ষতা সত্ত্বেও সরকারই তাদের জীবনে বড় ভরসা। সরকারই তাদের কাছে নির্ভরশীল এজেন্ট। তারা চাইলেই ভোট দিয়ে তাদের মেয়র, কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের বদলাতে পারেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তারা ভোট দিয়ে এটা নিশ্চিত করতে পারেন যে, তাদের দেশকে কে নেতৃত্ব দেবে। গণতন্ত্র তাদের কাছে একটা সেকেন্ড ন্যাচার বা দ্বিতীয় প্রকৃতগত বিষয়।

ওপরে যে কাঁটাতারের কথা উল্লেখ করেছিলাম, তার পাশে দাঁড়িয়ে এবার নজর দিন দক্ষিণে। এবারে কিন্তু একটা ভিন্নতা চোখে পড়বে। নোগালেস শহরটির দক্ষিণ প্রান্ত মেক্সিকোর মধ্যে পড়েছে। সুতরাং নোগালেস যুক্তরাষ্ট্রের এরিজনার অঙ্গরাজ্যের শহর, আবার নোগালেস মেক্সিকোর সনোরা প্রদেশের শহর। এখন দুটি দেশ হওয়ার কারণে দুই শহরের মানুষেরা এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও তাদের আয়ে কিন্তু বৈষম্য ঘটেছে এবং সেটা ব্যাপক।

মেক্সিকোর অংশের শহরের মানুষের আয় যুক্তরাষ্ট্রের অংশের শহরের মানুষের আয়ের থেকে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। তাদের বেশির ভাগ বয়স্ক মানুষের হাইস্কুল ডিগ্রি নেই এবং বহু শিশু-কিশোর স্কুলে যায় না। মায়েরা শিশুর মৃত্যুর উচ্চহারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন থাকেন। আর তাদের দুর্দশাগ্রস্ত জনস্বাস্থ্যর ব্যবস্থার অর্থই হলো, এটা জেনে কারও বিস্মিত না হওয়া যে, নোগালেসের বাসিন্দাদের আয়ুষ্কাল তাদের উত্তরের প্রতিবেশীদের চেয়ে অনেক কম।

বহু ধরনের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকেও তারা বঞ্চিত। কাঁটাতারের দক্ষিণের রাস্তার পরিস্থিতি করুণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই বাজে, অপরাধের হার বেশি এবং দোকানপাট খোলা একটি ঝুঁকিপূর্ণ তৎপরতা এবং সেটা আপনার দোকানে কোনো ডাকাতি হবে শুধু এ ভেবে নয়, একটি দোকান খোলার জন্য আপনাকে অনুমতি জোগাড় করতে হলে ঘাটে ঘাটে ‘তেল’ দিতে হবে। সনোরার নোগালেস শহরের বাসিন্দারা তাই রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি এবং অপুটতা নিয়েই কায়ক্লেশে জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এমজমিন
এমটিনিউজ/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে