শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৮:৫২:৫৯

নওয়াজ শরিফের মেয়ে এবং জেনারেল

নওয়াজ শরিফের মেয়ে এবং জেনারেল

মূল ইংরেজি : জাহিদ হোসেন ভাষান্তর : গোলাপ মুনীর
গত ১৭ সেপ্টেম্বরের লাহোরের উপনির্বাচনে কুলসুম নওয়াজের বিজয়ের বিষয়টি আগেই জানা ছিল। কিন্তু এতটা কম ভোট ব্যবধানে জিতবেন, তা জানা ছিল না। মোটের ওপর এনএ-১২০ (জাতীয় পরিষদের ১২০ নম্বর আসন) হচ্ছে এমন একটি নির্বাচনী আসন, যেখানে প্রায় তিন দশক ধরে নওয়াজ শরিফের পার্টি ও তার পরিবার প্রাধান্য বিস্তার করে আসছে। এই আসনে তাদেরকে কেউ পারাজিত করবে, তা বরাবরই ছিল ধারণার বাইরে। তা সত্ত্বেও এটি ছিল একটি বিপর্যয় এবং নিশ্চিতভাবেই এটি সেই ফলাফল নয়, যেটি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে থাকা শরিফেরা চেয়েছিলেন তাদের রাজনৈতিক ভাগ্য পুনরুদ্ধারের জন্য।

শরিফেরা হয়তো আসনটি ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, যা শূন্য হয়েছিল আদালতের আদেশের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণার পর। কিন্তু কাছাকাছি ব্যবধানে জয়লাভ করার বিষয়টি অবশ্যই মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হবে ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ও দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শাসক বংশ বা ডাইনেস্টির জন্য। মজার ব্যাপার হলো, এমনটি ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন এই পার্টি কেন্দ্রে ও প্রদেশ উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীন রয়েছে।

বাস্তবতা হচ্ছে, ভোটের ব্যবধান সঙ্কুচিত হয়ে নেমে এসেছে ১৪ হাজার ৬৪৭টিতে। ২০১৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে এই ভোট-ব্যবধান ছিল ৩৯ হাজার ৩৪৫টি। এটি এই সঙ্কেত দেয়, এর দুর্গে দলটির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এনএ-১২০ আসনের নির্বাচনী ফল দেশটি রাজনৈতিক গতি পরিবর্তন হয়তো করবে না, তবে এটি নিশ্চিতভাবেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।

অবশ্য উপনির্বাচন কোনো দেশের একটি পার্টির সাধারণ জনপ্রিয়তা পরিমাপের কোনো নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি নয়। কিন্তু এনএ-১২০ আসনটি ধারণ করে বৃহত্তর পরিসরের গুরুত্ব। কারণ, এই আসনটি শূন্য হয় ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, দুর্নীতির অভিযোগে তার পদের জন্য অযোগ্য ঘোষিত হওয়ার পর। মুসলিম লিগ (নওয়াজ) ও প্রধান বিরোধী দল পিটিআই তাদের প্রচারাভিযান চালিয়েছিল এই আদালতের রায়কে কেন্দ্র করেই। বাস্তবতা হচ্ছে, উপনির্বাচনে ভোট-ব্যবধান কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে দলটি সমস্যায় আছে।

অপর দিকে, পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এই নির্বাচনকে নিয়েছিল নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য অযোগ্য ঘোষণার বিতর্কিত রায় বাতিলের হাতিয়ার হিসেবে। পিটিআই এটিকে বর্ণনা করে একটি যথার্থতা হিসেবে। কোনো দলই তার বক্তব্যে সঠিক ছিল না। নিশ্চয়ই, পানামা স্ক্যান্ডালের ছায়া পড়েছিল নির্বাচনে, কিন্তু এটি ডিটার্মিনিং ফ্যাক্টর ছিল না। আসলে, ক্ষমতাসীন দল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের কন্যা মরিয়ম নওয়াজের নেতৃত্বে জোরালো প্রচারণা চালানো সত্ত্বেও ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। তা ছাড়া নওয়াজ শরিফের স্ত্রী কুলসুম নওয়াজ যেখানে প্রার্থী, সে নির্বাচন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

হতে পারে এটি এমন নির্দেশ করে যে, তাকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়, সাধারণ মানুষের কাছে ততটা সমর্থন তিনি পাননি। এটি স্পষ্ট, এখানে সিম্পেথি কার্ড কাজ করেনি। নিঃসন্দেহে কুলসুম নওয়াজ পার্টির জন্য ছিল সেরা বাজি, কিন্তু উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছে সে ধরনের শক্তিমত্তা সৃষ্টি করতে, যা প্রয়োজন ছিল ভূমিধস বিজয় অর্জনের জন্য। এটি আরো বেশি বিস্ময়ের ব্যাপার যে, পিটিআইয়ের প্রচারকাজেও ছিল দুর্বলতা। ড. ইয়াসমিন রশিদকে কার্যত কাজ করতে হয়েছে একা নিজেই, কোনো সিনিয়র নেতা তার প্রচারণায় সহায়তা করেননি, শুধু শেষ দিকে কয়েকটি র্যালি আয়োজন ছাড়া।

এটি নিশ্চিত, অন্য আরো অনেক বিষয় নির্বাচনী ফলাফলে এই কম ভোটের ব্যবধান সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলেছে। যেমন পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং দলের ভেতরের বিভাজন প্রশস্ততর হওয়া। অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন এজেন্সির আনা অদৃশ্য হাত ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অভিযোগ হালে পানি পায়নি। তা সত্ত্বেও এটি ঠিক, নিষিদ্ধ ঘোষিত বিদ্রোহী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তির ব্যাপারে অভিযোগ ছিল। এদের থামানোর দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশন ও নিরাপত্তা বাহিনীর।

কেউ ভিন্নমত পোষণ করবে না যে, মিলিট্যান্ট গ্রুপের তথাকথিত মূলধারায় আনার নীতি এবং রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম থেকে তাদের চরমপন্থী আদর্শ প্রচার করতে দেয়া গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা আইনবিরোধী। এর পরও কেউ কেউ জানতে চায়, এসব গোষ্ঠী তাদের অংশগ্রহণ মুসলিম লিগ (নওয়াজ)-এর ভোটব্যাংকে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে? দলটি এসব ডানপন্থী ধর্মীয় চরমপন্থীদের কতটুকু পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিল? ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে অনিয়ম ও দলের সমর্থকদের ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ পুরোপুরি অযৌক্তিক শোনায়।

নির্বাচনী প্রচারাভিযানে মরিয়ম ফ্যাক্টর নিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক তার অংশগ্রহণকে বর্ণনা করেছেন উত্তরাধিকার ও পার্টির নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় আনুষ্ঠানিক প্রবেশ হিসেবে, যদিও তিনি মুসলিম লিগে (নওয়াজ) সক্রিয় আছেন বেশ কিছুকাল ধরেই,প্রধানত পর্দার আড়াল থেকে। অবশ্য নওয়াজ শরিফ তার মেধাবী কন্যাকে প্রস্তুত করেছেন তার আপাত উত্তরাধিকারী হিসেবে। কিন্তু এই প্রথমবারের মতো তিনি আবির্ভূত হয়েছেন রাজনৈতিক মঞ্চের কেন্দ্রে। তিনি নিজেকে আবির্ভূত করতে পেরেছেন ছাপ ফেলার মতো এবং ভাবনা ও অনুভূতিকে স্পষ্টভাবে রূপদানে সক্ষম ব্যক্তিত্ব হিসেবে। সংরক্ষণবাদী সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন একটি পার্টির জন্যÑ যে পার্টিতে ও কেবিনেটে নারীর সংখ্যা কমÑ তার দায়িত্ব দেয়া একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু শীর্ষনেতার কন্যা হওয়ায় নিশ্চয় ডাইনেস্টিক পলিটিক্যাল কালচার (বংশানুক্রমিক রাজনীতি চর্চা) সৃষ্টি করে।

ভবিষ্যবাচ্যতা হিসেবে বলা যায়, তার উত্থান পার্টির ভেতরে, শরিফ পরিবারে ও বাইরে থেকে ডেকে আনা হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। হতে পারে তিনি পার্টির ভেতরে তার উল্লেখযোগ্য সমর্থনের পকেট সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তবে দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার আপত্তি আছে পরিপক্ব হওয়ার আগেই তার এই উত্থানের ব্যাপারে। চৌধুরী নিসার আলী খানের মতো অনেক পার্টি স্টলওয়ার্ট ও ওল্ডগার্ড তাকে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু অন্যরা সমালোচনায় না গিয়ে চুপচাপ আছেন।

মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট সম্পর্কে তার আগ্রাসী বক্তব্যের মর্মার্থ বিশেষত ভীত-শঙ্কিত করেছে তাদের, যারা তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বকে স্থিতাবস্থায় রাখতে চান। যখন দেখা যাবে দল জাহাজের মতো ডুবতে বসেছে, তখন বেশির ভাগই দল ছাড়তে দ্বিধা করবে না। পরিস্থিতি এখনো সে অবস্থায় পৌঁছেনি। তবে ব্যাপার ততটা সুবিধাজনক মনে হচ্ছে না, যেখানে শরিফ পরিবারকে দুর্নীতির অভিযোগের মামলা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এনএ-১২০ আসনের নির্বাচনের পর তার বাধাহীন বক্তব্য সমালোচকেরা ভালোভাবে নেবে না।

প্রধান বাধা আসবে তার ফ্যামিলি ডাইনেস্টি থেকে। এটি প্রতীয়মান হয় তার ক্রমবর্ধমান কথাবর্তা দলের ভেতরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব জোরালো করে তুলেছে। দুই শরিফ ভাই ও তাদের সন্তানদের মধ্যকার মুশকিলে অবস্থা এখন আর গোপন কিছু নয়। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও তার পুত্র হামজার দেশে না থাকার বিষয়টি এই দূরত্ব আরো খোলাসা করে দিয়েছে।

এটি নিশ্চিত, হতে পারে মরিয়মের উত্থান আরো বিভাজন সৃষ্টি করতে পারে এমন একটি সময়ে, যখন দলের ওপরের সারির নেতাদের ঐক্যের প্রয়োজন দেখা দেবে। দলের ভেতরের ও বাইরের সমালোচকেরা যে ব্যাপারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয় তা হচ্ছে, তার অধিকার চেতনা ও বংশানুক্রমিক ক্ষমতায় থাকার দাবি। আরেকটি বিষয় মরিয়মের বিরুদ্ধে যায়Ñ এনএবি আদালতে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ। এসব কিছু কোনো ভালো ইঙ্গিত বহন করে না তার জন্য, যিনি ক্ষমতার সিংহাসনে বসতে চান।

জাহিদ হোসেন : লেখক ও সাংবাদিক,
লেখাটি পাকিস্তানের ডন পত্রিকায়
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত
এমটিনিউজ২৪.কম/এইচএস/কেএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে