শনিবার, ৩১ মার্চ, ২০১৮, ১১:০৬:২৩

'তোমরা আমার ছেলে হত্যার প্রতিশোধ নিলে শহর ছেড়ে চলে যাবো'

 'তোমরা আমার ছেলে হত্যার প্রতিশোধ নিলে শহর ছেড়ে চলে যাবো'

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলে সহিংসতার পর গত মঙ্গলবার স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম ইমদাদুল্লাহ রশিদির ছেলে সিবতুল্লাহ রশিদিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না।

ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদল দাঙ্গাবাজ তাকে তুলে নিয়ে যায়। পরের দিন রাতে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। হত্যার পর তার লাশ বিকৃত করে ফেলা হয়। বৃহস্পতিবার নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই মৃতদেহ সিবতুল্লাহ রশিদির।
 
সন্দেহ করা হচ্ছে, দশম শ্রেণির পরীক্ষার্থী সিবতুল্লাহ রশিদিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

৪৮ বছর বয়সী ইমাম রশিদি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, সে যখন বের হয় তখন বাইরে বিশৃঙ্খলা চলছিলো। একদল দুষ্কৃতিকারী তাকে তুলে নিয়ে যায়। আমার বড় ছেলে পুলিশকে বিষয়টি জানায়, কিন্তু তাকে থানায় দেরি করানো হয়। পরে আমরা জনাতে পারি যে, একটি লাশের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। সকালে তাকে সনাক্ত করা হয়।'

বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয় ঈদগাহ ময়দানে তার জানাজায় কয়েক হাজার লোক জড়ো হয়। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে নতুন করে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।

তবে জানাজা শুরু আগে ইমাম রশিদি শান্তির ডাক দেন। তিনি বলেন, 'তোমরা যদি আমার সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ নাও তাহলে আমি এই মসজিদ এবং এলাকা ছেড়ে চলে যাবো।'

তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, 'আমি জানাজায় উপস্থিত সবাইকে বলেছি, 'আপনারা যদি আমাকে ভালোবাসেন, তাহলে কেউ একটা আঙ্গুলও তুলবেন না।'

রশিদি বলেন, 'আমি শান্তি চাই। আমার ছেলে চলে গেছে। আমি চাই না আর কোনো পরিবার তাদের ভালোবাসার কাউকে হারাক। আমি চাই না আর কোনো ঘর পুড়ুক।'

আসানসোলের মানুষ এমন নয় এবং এটি একটি ষড়যন্ত্র বলেও উল্লেখ করেন ইমদাদুল রশিদি।

তিনি বলেন, 'আমি গত ৩০ বছর ধরে এখানকার ইমাম। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে আমি মানুষকে সঠিক বার্তা দিবো- শান্তির বার্তা।'

আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি বলেন, সিবতুল্লাহ রশিদির হত্যাকাণ্ড নিয়ে স্থানীয় মুসলমান যুবকরা উত্তেজিত ছিল। তাদেরকে শান্ত করতে ইমাম সাহেবের বার্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তিনি বলেন, 'আমরা ইমাম সাহেবকে নিয়ে গর্বিত। নিজের ছেলে হারানোর যন্ত্রণায় দগ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তিনি শান্তির ডাক দিয়েছেন।'

আসানসোলের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাসিম আনসারী বলেন, 'এটি পুরো দেশের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ইমাম রশিদি এই এলাকায় জনপ্রিয়। তিনি যদি শান্তি ডাক না দিতেন, তাহলে আসানসোলে আগুণ জ্বলতো।'

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইমাম মুহাম্মদ ইমদাদুল্লাহ হাসপাতালে গিয়ে নিজের ছেলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ সনাক্ত করেন। নখ উপড়ে নেয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ। লাশটি আধপোড়া, মনে হচ্ছে কেউ পুড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে।

ক্ষত-বিক্ষত লাশটি যখন মহল্লায় আনা হলো, পরিস্থিতি আরও বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠলো।

মহল্লার বাসিন্দা মুহম্মদ ফারহাদ মালিক বলেন, 'ইমাম সাহেবের ছেলের মৃত্যুর ঘটনাটা শুনে প্রথমে সবারই মাথায় রক্ত চড়ে গিয়েছিল। এটা তো রক্ত গরম করে দেওয়ার মতোই ঘটনা।'

আসানসোলের চাঁদমারি আর কুরেশী মহল্লা মূলত মুসলমান প্রধান এলাকা। শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে এলাকার মানুষ এখানে সেখানে জটলা করছিলো। ভীড় ছিল মসজিদের সামনেও। পরিস্থাতি খারাপের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখে ইমাম সাহেব বুঝতে পারলেন এখনই শান্ত করতে হবে সবাইকে। একটা মাইক হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি।

বিবিসির কাছে পুত্র হারানোর কথা বলতে গিয়ে গলা ধরে গেল ইমামের। তবে তার মধ্যেও বলছিলেন, 'এই অবস্থাতেও আমি সবার কাছে আবেদন করতে রাস্তায় বেরিয়েছিলাম।'

ইমাম সাহেবের আবেদনে কাজ হলো। লোকজন ঘরে ফিরে গেল।

ইমদাদুল্লাহ রশিদি বলছিলেন, 'ছেলেটা মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিল, একই সঙ্গে নানা জায়গায় কোরান পড়তেও যেত। বুধবার যখন অশান্তি শুরু হয়, তখন নেহাতই কৌতূহলবশে দেখতে গিয়েছিল। আমার বড় ছেলে খবর দেয় যে একদল লোক ওকে টেনে নিয়ে যায়। পরের দিন জানলাম একটা মৃতদেহ পাওয়া গেছে - ওটাই আমার ছেলের দেহ।'

'খুব যন্ত্রণা দিয়ে মেরে তো ফেলেইছে ছেলেটাকে, তারপরে দেহটা জ্বালিয়েও দিয়েছিল। এটা কেন করল ওরা!'

ওই মহুয়াডাঙ্গাল এলাকারই বাসিন্দা প্রমোদ বিশ্বকর্মা বলছিলেন, 'ইমাম সাহেবকে যে কী বলে ধন্যবাদ দেব! ছেলে হারানোর পরেও রাস্তায় মাইক নিয়ে বলে বেরিয়েছেন যে সবাই যেন শান্তি বজায় রাখে। তবে আমাদের এই পাড়াতে আমরা হিন্দু আর মুসলমান সবাই একসঙ্গেই থাকি বহু যুগ ধরে। পাড়ায় একটা মন্দির আছে প্রায় দেড়শা বছরের পুরনো, আবার মসজিদও আছে। বাইরে যা হয় হোক, আমাদের পাড়ায় কেউ ঝামেলা করতে পারে না।'

সোমবার থেকে আসানসোল-রানিগঞ্জ এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছিল। পুলিশ তখন থেকেই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। এখন পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বুধবার পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কাছ থেকে এ নিয়ে প্রতিবেদন চেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।-ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হিন্দুস্তান টাইমস
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে