সৌপ্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়: ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’, সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’-এর গানটি বিখ্যাত। কিন্তু এই যে যুদ্ধ কি এতটাই সহজ। পুলওয়ামায় জঙ্গিহানায় ৪০ সেনার মৃত্যুর পর ফেসবুকের দেওয়াল জুড়ে একটাই চাহিদা, ‘যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই’। বদলা চাই। হ্যান চাই ত্যান চাই। ওই বাকিগুলি যদি নাও হয় দিনের শেষে যুদ্ধটি চাই। যারা এই ‘মহান দাবি’ নিয়ে লাফালাফি করছেন তাঁরা হয়তো নয় ভুলে গিয়েছেন , না হয় জানেন না ১৯৬৫ সালে ভারত – পাক যুদ্ধের সময় কলকাতার সেই ভয়ংকর দিনটি।
২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫, শ্রীনগরের কাছে চলে এসেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। শোনা যায় ভারতীয় সেনার পক্ষ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে জানানো হয়েছিল দিন দশ পনেরো লাগবে। লাহোর দখল করে নেবে ভারত। ঠিক পরের দিন অর্থাৎ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ভোরবেলা লাহোরবাসী দেখছিল ভারতীয় সেনারা দাঁড়িয়ে।
বিদেশীদের চাপ ছিল সেনা সরিয়ে নেওয়ার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীজীর কথা ছিল একটাই, কাশ্মীর থেকে সেনা সরালে তবেই ভারতের সেনা লাহোর থেকে সরে আসবে। তবে বেসামরিক লোক মারার নিষেধাজ্ঞা ছিল। ফলে গুলি কামান চালায়নি ভারতীয় সেনা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর কড়া নির্দেশ ছিল ,একজন অসামরিক ব্যক্তিও যেন না মারা যায়।
এসবের মাঝেই কলাইকুন্ডায় বিমান আক্রমন করেছিল পাকবাহিনী। তিনটি বিমান এসেছিল। স্যাবার জেটগুলির মধ্যে দুটিকে গুলি করে ফেলে ভারতীয় সেনা। সেইদিনই কলকাতায় ব্ল্যাক আউট জারি হয়। দলে দলে ভারতীয় সেনা জিটি রোড,বিটি রোড, যশোর রোড হয়ে সীমান্তে পজিশান নিয়ে নিয়েছিল। ভয় প্রাণ শুকিয়ে গিয়েছিল কলকাতাবাসীর। অস্বাভাবিক কিছুই নয়।
ভারত – পাক যুদ্ধ, আবার ফাইটার প্লেন যখন তখন আকাশে উড়ছে। পালটা আক্রমণ। দেশীয় সেনার বুটের শব্দ। তার সঙ্গে সন্ধ্যা নামলেই সমস্ত বাড়ির বিজলি বাতি বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ অর্থাৎ ব্ল্যাক আউট। ব্যারাকপুরে বিমানহানা করে পাক বিমানবাহিনী। সেটাকেও উড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় সেনা।
তবে দু তিন জন মারা গিয়েছিলেন ব্যরাকপুরের আশেপাশে। বোমার আওয়াজে যাতে বাড়ির জানলার কাঁচ ভেঙ্গে লোকজনকে জখম না করে , সে জন্য জানলার কাঁচে পাতলা সরু ফিতের মত কাপড় গুণ চিহ্নের মত আঠা দিয়ে লাগাবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল সাইরেন বাজানো।
সাইরেনের দু’রকম আওয়াজ ছিল। অ্যাটাক হলে থেমে থেমে সাইরেন বাজা ও অল ক্লিয়ার সাইন-একটানা সাইরেন বাজান । সেই সঙ্গে শেল্টার নেওয়া। বিমানহানার সময় মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে দুহাতের পাতা দিয়ে কান দুটি চেপে রাখা –এ সবও বিভিন্ন মাধ্যমে শেখানো হয়েছিল। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরেও সাইরেন সকাল নটার সময়। অসামরিক প্রতিরক্ষা দপ্তর তখন তৎপর হয়ে উঠেছিল। ভয়ে কেঁপে যাওয়ার জন্য ‘ক্যালকাটান্স’-দের আর কি চাই।
আজ অনেকেই যুদ্ধের দাবি করছেন। শুধু সেই একটা দিনের কথা ভাবুন। যুদ্ধ লাগলে কি হতে পারে। বেশ রয়েছে নেটিজেনরা। দিদি মোদীর ঝামেলা নিয়ে রোজ মারামারি চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটা হতেই পারে। কিন্তু নিজের শহরে রাস্তায় বেরোতে গেলেন আর একটা বোমা এসে পড়ল ২০০ মিটার দূরে অথবা সন্ধ্যা হলেই সমস্ত লাইট বন্ধ করে ভয়ে বসে থাকতে হল দিনের পর দিন। যুদ্ধ চাই তো ?
তবে শুধু ১৯৬৫ নয় এর পরে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়ও ব্ল্যাক আউট ছিল৷অধুনা বাঙলাদেশ স্বাধীন হবার আগের সময়। ভারত-পাক যুদ্ধ, প্রসঙ্গ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন। ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে নামিয়েছিলেন ভারতীয় সেনা। সেই সময়তেও কলকাতার রাস্তায় টিমটিম করে যে আলোগুলো জ্বলত সেই আলোগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হত। সন্ধ্যা নামলেই গা ছমছমে পরিবেশ। বাড়ির আলোগুলিকেও কাগজের ঠোঙ্গা দিয়ে ঢাকা হত।সরকার থেকে এমনই নির্দেশ ছিল।
কাজেই সন্ধ্যা হলেই গোটা শহর অন্ধকারে ডুবে যেত। দমদম এলাকা অর্থাৎ যশোর রোড ওই সময় ঘনঘন যুদ্ধ বিমান প্লেনের শব্দ শোনা যেত। বেজে উঠত সাইরেন। রেডিওতে শুধুই যুদ্ধের খবর। ১৯৩৯ সালে শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ৷ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালে৷ সেই ছয় বছরেও গোটা শহর জুড়ে ছিল থমথমে পরিস্থিতি। চলেছে ব্ল্যাক আউট৷ যখন তখন জাপানি বোমারু বিমানের হামলার ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেই ভয় পেতেন মানুষজন৷ ভয়ে কলকাতা ছেড়ে অনেকে পাড়ি দিয়েছিলেন মফস্বলে৷
সূত্র: কলকাতা২৪×৭