আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কলকাতার স্কুল শিক্ষক মিনা খাতুন : কলকাতায় আত্মীয়- স্বজন, প্রতিবেশীদের মধ্যে এখন সারাক্ষণই কাগজ-পত্র জোগাড়ের চিন্তা, তা নিয়েই সবসময় আলোচনা হচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী (মমতা ব্যানার্জী) ভরসা দিচ্ছেন এখানে এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী) করতে দেবেন না, কিন্তু মুসলিমরা ভরসা পাচ্ছেন না। তারা ধরেই নিচ্ছেন আজ হোক, কাল হোক তাদেরকে কাগজপত্র দিয়ে প্রমাণ করতে হবে যে তারা ভারতীয় নাগরিক।
আমার পরিবারের কথা ধরুন- শ্বশুর কুলের কাগজ-পত্র সব ঠিকঠাক আছে, কিন্তু আমার বাবার জমি-জমা নেই বললেই চলে, ফলে দলিল-পত্রও নেই। সেটা নিয়ে আমার চিন্তা হয়। কাগজপত্র সব দেওয়া যাবে তো।
আমাদের বা আমাদের ছেলে-মেয়েদের জন্মের সার্টিফিকেট না হয় আছে। গুরুজনদের তো নেই। গরীব-অশিক্ষিত মুসলিমরা কাগজ-পত্র তো রাখেই না। ওদের কি হবে? আমি এই কলকাতাতেই জন্মেছি। আশুতোষ কলেজে পড়াশোনা করেছি। এখন শিক্ষকতা করছি। এই শহরেই সব।
তারপরও কেন যে এখন ভবিষ্যত্ নিয়ে ভরসা পাইনা, এটা ভাবলেই নিজের কাছেও যেমন কেমন অবাক লাগে। কিছু রাজনীতিকের কথা শুনে খুব ভয় লাগে। মনে হয় তারা বোধ চাইছেন না আমরা মুসলিমরা এদেশে থাকি। অন্তত মুসলিমের সংখ্যা তারা মনে হয় কমাতে চায়।
আমাদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। কিন্তু সবাই যদি ভেতরটা দেখতো, তাহলে দেখতে পেত আমরা মুসলিমরা এদেশকে কতটা ভালোবাসি। এই শহরে বড় হয়েছি। এত হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের কথা কখনো শুনিনি।
মেয়ে কলেজে পড়ে। কিন্তু এদেশে ওর ভবিষ্যত্ কি তা নিয়ে এখন আর পুরোপুরি ভরসা পাইনা। নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি এসব নিয়ে প্র'তিবা'দ-বিক্ষো'ভ হচ্ছে, কিন্তু তাতে লাভ কি হবে? আমরা কি পারবো?
দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী রিকাত হাশমী : ভারতে অনেক মুসলিমের মত আমিও এখন দিন-রাত ভাবি এদেশে আমার ভবিষ্যত্ কী? আমার ধর্মের কারণে কি আমাকে চাকরি দেওয়া হবেনা? আমাকে কি বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হবে? এই ভ'য়-দু'শ্চি'ন্তা থেকে আমাদের কি কখনো মুক্তি হবে?
অমার ইউনিভার্সিটি জামিয়া মিলিয়াতে রাতভর স'হিং'সতার পর মা আমাকে আ'শ্ব'স্ত করতে বলেছিলেন, "ধৈর্য ধর।" নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্র'তিবা'দ করতে গিয়ে পুলিশের হাতে বে'ধ'ড়'ক পি'টু'নি খান জামিয়ার ছাত্র-ছাত্রীরা।
তাদের ক্লাসরুমে, লাইব্রেরিতে পর্যন্ত পুলিশ ঢুকে ভা'ঙ'চুর করে, কাঁদানে গ্যা'স ছোড়ে। নতুন নাগরিকত্ব আইনে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে থেকে আসা শ'র'ণা'র্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু মুসলিমদের এই সুযোগ থেকে ব'ঞ্চি'ত করা হয়েছে। এই বৈ'ষ'ম্যের বি'রু'দ্ধেই প্র'তিবা'দ শুরু করে ছাত্র-ছাত্রীরা।
তাহলে পুলিশ কেন তাদের ওপর চ'ড়াও হলো? পুলিশের বক্তব্য - শিক্ষার্থীরা গাড়িতে আ'গু'ন দিয়েছে, ইট-পাটকেল ছুড়েছে। কিন্তু সেই প্রমাণ কি পুলিশের কাছে রয়েছে? পুলিশ বলছে, তারা গু'লি করেনি। তাহলে হাসপাতালে গু'লি'তে জ'খ'ম লোকগুলো কি মি'থ্যা বলছে?
আমি জামিয়া ইউনিভার্সিটিতে ডেনটিস্ট্রি পড়ছি। গত কয়েক বছরে আমি ক্যাম্পাসে বেশ কিছু শান্তিপূর্ণ বি'ক্ষো'ভ-সমাবেশ দেখেছি। রোববার বি'ক্ষো'ভে আমি অংশ নিইনি। কিন্তু পুলিশ যে হা'ম'লা চালালো আমি তার শি'কা'র হয়েছিলাম।
পুলিশ যখন আমাদের হোস্টেলের দিকে আসছিল, আমি ভ'য়ে চি'ত্কার শুরু করে দিয়েছিলাম। আমরা বাতি ব'ন্ধ করে লু'কা'নোর চেষ্টা করছিলাম। ভাগ্যিস তেমন কোনো দু'র্ঘ'ট'না ছাড়া রাত পার হয়ে গিয়েছিল।
ছোটবেলায় অনেক দিন সকালে আমার ঘুম ভাঙতো ভজনের সুরে। উড়িষ্যার একটি হিন্দু অ'ধ্যু'ষিত এলাকায় আমরাই ছিলাম একমাত্র মুসলিম পরিবার। আমরা সবসময় বিভিন্ন ধর্মীয় পালা-পার্বন একসাথে উপভোগ করেছি। ঈদের সময় আমার হিন্দু বন্ধুরা আমার হাতে মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। আবার একসাথে নবরাত্রিতে মজা করেছি।
বিরিয়ানির লোভে আমার অনেক হিন্দু বন্ধু হর-হামেশা আমাদের বাড়িতে আসতো। আমাদের মহল্লায় বা ধারে কাছে কোনো মসজিদ ছিলনা। কিন্তু আমার বাবা কোনোদিন তার ধার ধারেননি, কারণ তিনি নামাজ পড়তেন না। আমার মা ঘরেই নামাজ পড়তেন।
আমি যে কনভেন্ট স্কুলে পড়তাম, সেখানকার সিংহভাগ শিক্ষার্থীই ছিল হিন্দু। কিন্তু কোনোদিন আমি কোনো বৈ'ষ'ম্যের শি'কা'র হইনি। শুধু একদিন একদিন আমার এক হিন্দু বন্ধু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল মুসলিমরা নাকি প্রতিদিন গোসল করেনা। শুনে আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
ধর্ম আমাদের জীবনের অংশ ছিল ঠিকই, কিন্তু কোনোদিন আমি নিজেকে শুধু মুসলিম হিসাবে ভাবিনি। এখনও ভাবিনা। কিন্তু একটি গোষ্ঠী এখন মাঠে নেমে আমাদের ভাগ করে দিতে চাইছে। ফলে আমার এখন আর ভরসা হয়না যে যে জীবন আমার এতদিন ছিল, তা আর থাকবে।
আমাদের দিন দিন এমন কথা বেশি বেশি শুনতে হচ্ছে যে আমরা মাংস-খেকো, আমার ধ'র্ষ'ণকারী, সমাজকে ক'লু'ষি'ত করছি, আমরা স'ন্ত্রা'সী, পাকিস্তানের স্বার্থ র'ক্ষা করছি, প্রেমের ছলে হিন্দুদের মুসলমান বানাচ্ছি, এবং আমরা দেশকে দ'খ'ল করে নিতে চাই।
বাস্তব সত্য যেটা তা হলো - আমাদেরকে এদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানো হচ্ছে, যাদেরকে ভ'য়ে ভ'য়ে টিকে থাকবে হবে। এক টুইটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, "এখন শান্তি, ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্ব স্থাপনের সময়।"
অথচ তার আগের দিনই তিনি হাজার হাজার মানুষের সামনে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, "কারা সরকারি সম্পত্তিতে আ'গু'ন দিচ্ছে তাতো টিভিতেই দেখা গেছে- তাদের পোশাক দেখেই তো চেনা যায়।"
তিনি খুলে বলেননি, কিন্তু আসলে তিনি একটি ধর্মের দিকে আ'ঙ্গু'ল তুলেছেন। দুঃখের বিষয় যে এসব দেখে আমি এখন ধর্মের দিকে ঝুঁ'কে পড়ছি। আমি শারীরিক বা পোশাকের কথা বলছি না, কারণ আমি ১৬ বছর বয়স থেকে হিজাব পরি।
কিন্তু প্রতিবারই আমাকে "দেশ-বিরোধী" 'হিন্দু-বিরোধী' বলে আমাকে ঠেলে পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেলেও আমাকে বলা হয়, আমি 'হিন্দু-মুসলিম' ইস্যু টেনে আনছি।
আমরা এখন এমন এক সময়ে বসবাস করছি যেখানে ধর্ম আর জা'তীয়'তাবাদকে এক করে ফেলা হয়েছে। এখন রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় আমার মনে হয়, হিজাবের কারণে মানুষজন আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
হয়তে আমি অযৌ'ক্তিকভাবে এসব ভাবছি, কিন্তু ইসলাম বি'দ্বে'ষ যে ছড়িয়ে পড়ছে তা নিয়ে কোনো স'ন্দে'হ নেই। এই ভারতে তো আমি বড় হইনি। আমরা এখন ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করি নতুন আরেকটি আইন এলে আমাদের কী হবে? সবাইকেই কি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হবে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্ত্রী তো বলেছেন ২০২৪ সালে নির্বাচনের আগে ভারত-জুড়ে নাগরিক-পঞ্জী চালু করা হবে। কিন্তু এখনও আশা পুরোপুরি শে'ষ হয়ে যায়নি। এই ঘৃণা এবং জ'ঘ'ন্য বি'দ্বে'ষী মনোভাবের বি'রু'দ্ধে দেশে জুড়ে মানুষজন কথা বলতে শুরু করেছে।
হয়তো অনেক মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হবে, তারা যুক্তি দিয়ে ভাববে। কিন্তু এখন আমার চারপাশের এতদিনকার পরিচিত পরিবেশ ধ'সে পড়ছে আর আমি চু'প করে চেয়ে দেখছি ।
আমাকে হোস্টেল থেকে বের করে জো'র করে ছুটিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পড়াশোনা আপাতত বন্ধ। পরিবারের কাছে যেতে পারছি না, কারণ তারা যে শহরে থাকে সেখানেও বি'ক্ষো'ভ শুরু হয়েছে। সুতরাং আমি দিল্লিতে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি এবং মায়ের কথাগুলো নিয়ে ভাবছি - "ধৈর্য ধরো, শক্তি হারিও না।" সূত্র : বিসিবি