শনিবার, ২৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২০, ০৭:৩৭:১৪

দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিমের ভরসা ও বিশ্বাসের ভিতটাই নড়ে গেছে

দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিমের ভরসা ও বিশ্বাসের ভিতটাই নড়ে গেছে

শুভজ্যোতি ঘোষ : উত্তর-পূর্ব দিল্লির রাস্তাঘাটে একটু একটু করে যানচলাচল আবার শুরু হয়েছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে পরি'স্থিতি এখনও অত্য'ন্ত থ'ম'থমে। সবচেয়ে বড় কথা, রাজধানীর এই এলাকাগুলোতে শ্রমজীবী হিন্দু ও মুসলিমরা যে পারস্পরিক ভরসার ভিত্তিতে এত বছর বসবাস করছিল- সেই বিশ্বাসের ভিতটাই নড়ে গেছে।

হিন্দু-অ'ধ্যুষি'ত এলাকা ব্রিজপুরী আর মুসলিম-অ'ধ্যু'ষিত মোস্তাফাবাদের সীমানায় একদল মহিলা বলছিলেন, তারা এখন দুই সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেই রাত জেগে মহল্লায় পা'হা'রা দিচ্ছেন। কিন্তু তারা স্প'ষ্টতই ব্য'তিক্র'ম। খুব কম জায়গাতেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একযোগে পা'হা'রা দিচ্ছেন কিংবা হিন্দু-মুসলিমদের নিয়ে এলাকায় 'শান্তি কমিটি' গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।

বরং জাফরাবাদ-মৌজপুর-গোকুলপুরী-ভজনপুরা গোটা তল্লাট জুড়েই প্র'ব'ল স'ন্দে'হ আর অবি'শ্বাসের বাতাবরণ। হিন্দু ও মুসলিম উভয় মহল্লাতেই গলিতে ঢোকার প্রবেশপথগুলো পাথর বা ব্যারিকেড ফেলে আ'টকে দেওয়া হয়েছে। গলিতে ঢোকার বা বেরোনোর সময় এলাকার বাসিন্দারাই ব'হিরা'গতদের নাম-পরিচয় পরীক্ষা করছেন। সংবাদমাধ্যমও এই 'স্ক্রুটিনি' থেকে বাদ পড়ছে না।

আমি ও বিবিসিতে আমার সহকর্মী সালমান রাভি-কেও বার বার এই ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। মুসলিম নাম শুনে হিন্দু মহল্লার লোকজন ভু'রু কুঁ'চকে তাকিয়েছেন, আবার হিন্দু নাম শুনে মুসলিম এলাকার লোকজন অনেকে গু'টিয়ে গেছেন। পাশাপাশি হিন্দু ও মুসলিম দুতরফেই এই প্রশ্নটা তোলা হচ্ছে, "যখন মা'রামা'রি-লু'ঠপা'ট হচ্ছিল তখন পুলিশ বা মিডিয়া কোথায় ছিল?"

শিব বিহারের বাসিন্দা বৃদ্ধ শাজাহান আলি বলছিলেন, "দুতরফ থেকেই পাথর ছোঁ'ড়াছু'ড়ি হচ্ছিল যখন - তখন কোনও পুলিশই আসেনি। বরং মনে হয়েছে, প্রশাসন যেন ইচ্ছাকৃতভাবে এই হিং'সায় উ'সকা'নি দিয়েছে।" বাইক চালাচ্ছিল তার ছেলে মুজফফর, সে পাশ থেকে যোগ করে, "সহিং'সতার পর আহ'তদের নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত আসেনি, ফোন করেও কোনও সাড়া মেলেনি!"

বস্তুত নাগরিকত্ব আইনের বি'রু'দ্ধে মূলত মুসলিমদের শান্তিপূর্ণ প্র'তিবা'দ কীভাবে এই বি'প'জ্জনক হিং'সায় মোড় নিল, সেটা এখনও একটা রহ'স্যই। ব্রিজপুরীর প্রবীণ হিন্দু বাসিন্দা পন্ডিত মোহন শর্মা যেমন বলছিলেন, "গত দুমাসের ওপর ধরেই পাড়ার মসজিদে নাগরিকত্ব আইনের বি'রু'দ্ধে প্র'তিবা'দ চলছিল। কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে পরিবেশ আচ'মকা এতটা অশা'ন্ত হয়ে উঠল কীভাবে সেটা আমার মাথাতেই ঢুকছে না।"

আবার শর্মাজির প্রতিবেশী রফিকও জানাচ্ছেন, "সেদিন সকাল থেকেই বাতাসে কা'নাঘু'ষো শুনছিলাম, গ'ন্ডগো'ল হতে পারে। বিকেল চারটে নাগাদ সেই আ'শ'ঙ্কাই সত্যি হল - পাথর-ইট-পাটকেল-পেট্রল বো'মা ছোঁ'ড়াছুঁ'ড়ি শুরু হয়ে গেল। কে আগে করেছে জানি না, কিন্তু যা হয়েছে অত্যন্ত খা'রা'প হয়েছে।"

গত রবিবার বিকেলে দিল্লিতে বিজেপির এক নেতা কপিল মিশ্র-র প্ররো'চনামূলক ভাষণকে অনেকে দা'ঙ্গা 'ট্রি'গার' করার জন্য দা'য়ী করেছেন। বহু মুসলিম আমাদের বলেছেন, "কপিল মিশ্রই যাবতীয় গ'ন্ডগো'লের মূলে। দলের ই'শা'রাতেই নিশ্চয় তিনি এখানে এসে পুলিশকে হু'মকি দিয়ে গেছেন - যাতে দা'ঙ্গার সময় তারা হাত গু'টিয়ে থাকে।"

আবার হিন্দুদের মধ্যে কপিল মিশ্রর সমর্থকও কম নয়। ভজনপুরার এক ভস্মীভূত পেট্রোল পাম্পের সামনে একদল বাইক-আরোহী যুবক মিডিয়ার লোকজন দেখে আমাদের এসে শুনিয়ে গেল, "শুনে রাখুন - আসল হিরো কিন্তু কপিল মিশ্রই! মুসলিমরা যেখানে খুশি রাস্তা আ'টকে বসে পড়বে, আমরা হিন্দুরা কি চুড়ি পরে বসে থাকব না কি?"

বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আম আদমি পার্টির এক স্থানীয় কাউন্সিলর তাহির হোসেনের নামও ভী'ষণভাবে আলোচনার কেন্দ্রে। বিজেপি সমর্থকরা সোশ্যাল মিডিয়াতে নানা ভিডিও পোস্ট করে দাবি করছেন, অঙ্কিত শর্মা নামে যে তরুণ গোয়ে'ন্দা অফিসারের লা'শ দুদিন আগে জাফরাবাদের নর্দমা থেকে উ'দ্ধা'র করা হয়েছে - তার হ'ত্যার পেছনে দা'য়ী ওই মুসলিম রাজনীতিবিদই।

তাহির হোসেন নিজে অবশ্য এদিন দাবি করেছেন, তিনি কোনও আ'ক্র'মণে জড়িত তো ছিলেনই না - বরং তার বাড়িতেই দা'ঙ্গাকা'রীরা হা'মলা করেছিল। তবে তারপরও বিভিন্ন হিন্দু মহল্লায় তাহির হোসেনকে 'টে'ররি'স্ট' বলে গা'লাগা'লাজ করা হচ্ছে, তা নিজের কানেই শুনেছি।

দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সাম্প্র'দায়িক পরিবেশ যে কতটা বি'ষিয়ে গেছে, এগুলো তারই প্রমাণ। যমুনা বিহারের এক মুসলিম গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর সঙ্গে এদিন কথা হচ্ছিল, যিনি নিজের নাম বলতে চাইলেন না। তিনি নিজের কারখানার এগারোজন হিন্দু শ্রমিককে আজ সকালেই ওল্ড দিল্লি স্টেশন থেকে বিহারের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসেছেন।

"যা পরিস্থিতি এখানে, ওদের নিরা'পত্তার দায়িত্ব নেওয়া আমার পক্ষে সত্যিই আর সম্ভব নয়। অথচ ওরা প্রায় দশ-বারো বছর ধরে আমার এখানেই কাজ করছে, কখনও কোন সম'স্যা হয়নি", বলছিলেন তিনি। ওদিকে মুস্তাফাবাদের অলিতে-গলিতে পোড়া মসজিদের ভেতর থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে, চারদিকে ছড়িয়ে আছে ছাই।

ফারুকিয়া মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে মহিলারা বলছিলেন, "হিন্দুদের বি'পদের সময় আমরা তাদের নিজের ঘরেও লু'কিয়ে রেখেছি - অথচ তারা আমাদের এত বড় ক্ষ'তি কীভাবে করতে পারল? মাদ্রাসার ছোট ছোট বাচ্চাদের ওপর পর্যন্ত হা'মলা করা হয়েছে, জ্বা'লিয়ে দেওয়া হয়েছে কোরান শরিফ।"

বস্তুত এখন সরাসরি অন্য সম্প্রদায়কে আ'ক্র'মণ করে কথা বলছে হিন্দু-মুসলিম দুতরফই। ওদিকে একটু দূরেই পিপুল গাছের গলি নামে পরিচিত সরু রাস্তার ভেতরে দিলীপ সিংয়ের বাড়ির ভেতরেও শো'কের মা'তম চলছে আজ তিনদিন ধরে।

পাড়ার মহিলারা বলছিলেন, "পরিবারের ছোট ছেলে রাহুল সেদিন দুপুরে বাড়ি থেকে মায়ের বেড়ে দেওয়া খাবার খেয়ে বাইরে বেরিয়েছিল কীসের গ'ন্ডগো'ল তা দেখতে। এই রাস্তা দিয়ে গেল, আর পাঁচ মিনিট বাদে পাশের রাস্তা দিয়ে তার ফিরল তার গু'লিবি'দ্ধ লাশ!" উত্তর-পূর্ব দিল্লির বাবরপুরা, জাফরাবাদ, মৌজপুর বা গোকুলপুরীর মোড়ে মোড়ে আজ এই ধরনেরই ছবি।

আর রাহুল সিং যেমন, তেমনি শাহিদ আলম বা তানভির শেখসহ নিহ'তদের অনেকের পরিবারেরই স্পষ্ট অ'ভিযো'গ তাদের প্রিয়জনের প্রা'ণ গেছে যে হিং'সায় - প্রশাসন চাইলে তা অনা'য়াসেই এড়াতে পারত! যে কোনও কারণেই হোক প্রশাসন তা চায়নি- আর শুধু ৩৫টি প্রাণই নয়, তার নি'ষ্ঠু'র বলি হয়েছে সেই ভর'সাটুকুও - যার ভিত্তিতে দিল্লিতে এতদিন পাশাপাশি থেকেছে হিন্দু ও মুসলিমরা। সূত্র : বিবিসি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে