বুধবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০২:০৬:৫২

বাংলাদেশকে হুবহু অনুসরণ নেপালের

বাংলাদেশকে হুবহু অনুসরণ নেপালের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : যুবসমাজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া, কয়েক দিনের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন, বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু এবং একটি নির্বাচিত সরকারের পতন। গতকাল মঙ্গলবার নেপালে কেপি শর্মা অলি সরকারের পতনের ঘটনাপ্রবাহটি অবিশ্বাস্যভাবে মিলে যায় বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে ঘটে যাওয়া আন্দোলনের সঙ্গে, যা ঘটেছিল মাত্র এক বছর আগে।

টানা দুদিনের বিক্ষোভের মুখে গতকাল প্রধানমন্ত্রী অলি বাধ্য হন পদত্যাগ করতে। এই বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেশন জেডের তরুণরা। রাজনৈতিক শূন্যতার এ মুহূর্তে নেপালের সেনাপ্রধান ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, যা কার্যত ঢাকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছুই নয়।

ঢাকায় শিক্ষার্থীরা ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। দ্রুত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও ওই আন্দোলনে যোগ দেয় এবং হাসিনার পদত্যাগ দাবিতে এটিকে একটি গণআন্দোলনে রূপান্তরিত করে। ব্যাপক দুর্নীতি এবং হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে বাংলাদেশ তখন উত্তাল ছিল।

ভারতের প্রতিবেশী দেশে ২০২৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আবারও একই ধরনের ঘটনা বা চিত্রনাট্যের পুনরাবৃত্তি ঘটল। বিক্ষোভকারীদের হত্যার কয়েক সপ্তাহ পর বাংলাদেশে হাসিনাবিরোধী বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়লেও নেপালের ক্ষেত্রে মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে।

সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ নিষিদ্ধ করার ফলে কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ শুরু হয় এবং তা নেপালের অন্যান্য জেলায়ও ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলের পোশাক পরিহিত তরুণ বিক্ষোভকারী ও ছাত্ররা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আন্দোলনের প্রথম দিনই কমপক্ষে ২০ জন নিহত হন।

বাংলাদেশে আন্দোলনের কারণ ছিল কোটা ব্যবস্থা আর নেপালে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু কয়েক মাস ধরে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল। বাংলাদেশের মতো দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নেপালেও বড় সমস্যা ছিল। নেপালে প্রতিবাদের প্রাক্কালে ‘নেপো কিডস’ এবং ‘নেপো বেবিস’-এর মতো শব্দ সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিংয়ে চলে আসে।

নেপাল ও বাংলাদেশের আন্দোলনে এমনই বেশকিছু মিল খুঁজে পেয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে-যা পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।

আন্দোলনের নেতৃত্বে তরুণ ও শিক্ষার্থীরা

নেপালের কাঠমান্ডুতে সোমবার শুরু হওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ দ্রুত পোখারা, বিরাটনগর ও ভরতপুরের মতো শহরেও ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভের নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ এবং ছাত্ররা, বিশেষ করে জেনারেশন জেড (যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে)। সরকার ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় নেপালের ৩০ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ২০.৮ শতাংশ, ইন্টারনেটের ৯০ শতাংশ ব্যবহারকারী দ্রুত আন্দোলন শুরু করেন।

স্কুল ও কলেজের পোশাক পরে হাজার হাজার তরুণ বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে আসেন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুবসমাজ’ ব্যানার নিয়ে। এই বিক্ষোভকারীরা নেপো কিডদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন। যুব-নেতৃত্বাধীন এই বিক্ষোভ ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে হওয়া আন্দোলনেরই যেন প্রতিফলন।

যুব-নেতৃত্বাধীন উভয় বিক্ষোভের ক্ষেত্রেই সোশ্যাল মিডিয়া ছিল মূল বিষয়। শেখ হাসিনার অধীনে দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জোরদার করতে এবং বিক্ষোভকারীদের একত্রিত করতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেছিল; ঠিক যেমন নেপালি জেন-জেডের ‘নেপো বেবিজ’ এবং ‘নেপো কিডস’ ট্রেন্ড করার জন্য বাকি প্ল্যাটফর্মগুলো কাজে লাগিয়েছিলেন।

ক্ষুদ্র বিষয় ডেকে আনে বড় পরিণতি

নেপালের সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের কোটা বিক্ষোভ উভয়ই স্পষ্ট করে যে, কীভাবে একটি ছোট নীতিগত সিদ্ধান্ত দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে গভীর ক্ষোভের জন্ম দিতে পারে।

নেপালে সোশ্যাল মিডিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা একটি আপাত দৃষ্টিতে ছোট বিষয় মনে হলেও যা চাপা অসন্তোষকে জাগিয়ে তোলে। যার ফলে ছড়িয়ে পড়ে বিশৃঙ্খলা, পতন হয় সরকারের।

নেপালের যোগাযোগমন্ত্রী পৃথ্বী সুব্বা গুরুং ৪ সেপ্টেম্বর ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। ঘৃণাত্মক বক্তব্য, জালিয়াতি রোধ এবং স্থানীয়ভাবে নিবন্ধন করতে ব্যর্থ হওয়ায় এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু এ সিদ্ধান্তকে ব্যাপকভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করার চেষ্টা হিসেবে দেখা হয়।

এটি বাংলাদেশের ২০২৪ সালের কোটা বিক্ষোভেরই যেন প্রতিধ্বনি। যেখানে অভিযোগ ছিল, মুক্তিযোদ্ধা কোটার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ উপকৃত হয়েছিল। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে দলটি স্বজনপ্রীতি করেছে।

দুটি কারণই ছিল ছোট নীতিগত সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশে উত্তপ্ত অর্থনৈতিক দুর্দশা এবং হাসিনার ১৫ বছরের দমন-পীড়ন সপ্তাহব্যাপী উত্তেজনা বৃদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছে। আর নেপালের ক্ষেত্রে আন্দোলন ছড়িয়েছে দাবানলের মতো। কারণ, এই নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা, রেমিট্যান্স প্রবাহ ব্যাহত হয়। ফলে গভীর রাতে জরুরি মন্ত্রিসভার বৈঠক করে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় সরকার।

উভয় ক্ষেত্রেই পরিণতি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন। বাংলাদেশের কোটা আন্দোলন হাসিনার শাসনের পতন ঘটায়; অন্যদিকে নেপালের নিষেধাজ্ঞার ফলে স্বরাষ্ট্র, কৃষি, স্বাস্থ্য ও প্রধানমন্ত্রী অলির পদত্যাগের ঘটনা ঘটে।

বিক্ষোভকারীদের হত্যা

বাংলাদেশে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা বিক্ষোভে শত শত মানুষ নিহত হলেও নেপালে কদিনের মধ্যেই অলি সরকারের পতন ঘটে, সেখানে মৃতের সংখ্যা ছিল ২০।

রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস বলেছিলেন জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভে প্রায় এক হাজার ৫০০ জন নিহত হন।

নেপালে সোমবার যারা মারা যান, তাদের বেশিরভাগই ছাত্র এবং তরুণ বিক্ষোভকারী ছিলেনÑযা দ্বিতীয় দিনের বিক্ষোভকে আরো উসকে দেয়।

সরকারি স্থাপনায় হামলা

বাংলাদেশ ও নেপাল উভয় দেশেই যুব-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভে ক্ষমতার প্রতীক ভেঙে ফেলার জন্য মন্ত্রীদের বাসভবন এবং সরকারি ভবনে হামলা চালানো হয়।

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের কোটা বিক্ষোভে জনতা শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে হামলা চালায়, সংসদ ভবন ও পুলিশ স্টেশনে অগ্নিসংযোগ করে। নেপালের বিক্ষোভেও বিক্ষোভকারীরা কেপি শর্মা ওলির বাড়িতে আগুন দেয়। যার ফলে তাকে অনেকটা হাসিনার মতো হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেওয়া হয়।

বাংলাদেশে আনিসুল হক ও আমির হোসেন আমুর মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যার ফলে দলটির অনেক নেতা আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হন। একইভাবে নেপালের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক (যিনি সম্প্রতি পদত্যাগ করেন), তার ওপর আক্রমণ করা হয়। বিক্ষোভকারীরা সিপিএন চেয়ারম্যান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা পুষ্প কামাল দাহালের বাসভবনে পাথর ছুড়ে মারেন। অন্যান্য মন্ত্রীর বাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়। মঙ্গলবার উপপ্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু পাউডেলকে বিক্ষোভকারীরা মারধর করেন।

দুটি আন্দোলনেই সংসদ ভবনে হামলা করা হয়, সরকারি অফিসে আগুন দেওয়া হয় এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত করা হয়। এভাবেই আন্দোলনকারীরা সরকারি স্থাপনাগুলোর ওপর সরাসরি আক্রমণের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদকে মোকাবিলা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাচ্যুতি

কাঠমান্ডুতে যা ঘটল, তা যেন ঢাকার ঘটনার পুনরাবৃত্তি। যার পরিণতিতে মঙ্গলবার নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেলের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী অলি পদত্যাগ করেন।

সেনা সূত্রের খবর অনুযায়ী, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এবং বাসভবন থেকে নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সামরিক সহায়তা চান অলি। জেনারেল সিগদল অলিকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, সামরিক বাহিনী কেবল তখনই পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে পারবে- যদি তিনি ক্ষমতা ত্যাগ করেন।

ঢাকায়ও একই ঘটনা ঘটেছিল। যেখানে গত বছরের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। এর একদিন আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিবৃতি জারি করে বলেছিল, তারা জনগণের পাশে রয়েছে।

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে