অনিকেত চট্টোপাধ্যায় : নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি সাতজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী, পরিবারের কয়েকজনকে নিয়ে পালিয়েছেন হেলিকপ্টারে করে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হয় ভারত, না হলে দুবাইয়ে আশ্রয় নেবেন। দেখা যাক। ওদিকে অর্থমন্ত্রীকে রাস্তায় পকেটমারের মতো ফেলে পেটানো হয়েছে।
কেপি শর্মা অলির বাড়িতে আগুন লাগানো হয়েছে। মন্ত্রীদের বাড়ি জ্বলছে। নেপালি কংগ্রেসের দপ্তরে আগুন লাগানো হয়েছে। এমনকি মাওবাদী কমিউনিস্ট নেতা প্রচন্ডের বাড়িও আক্রান্ত হয়েছে। সেখানেও বিক্ষোভকারীরা গিয়ে হামলা চালিয়েছে।
বিক্ষোভ থামছে না, বরং নতুন করে শুরু হয়েছে। এমনিতে এক অরাজনৈতিক চেহারায় শুরু হলেও এর পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, এমনকি পুরোনো রাজতন্ত্রের সমর্থকরাও ভালোভাবে আছেন। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনো নেপালের রাজধানী সম্পূর্ণ ছাত্র-যুবাদের দখলে। তারা সামাজিক মাধ্যমের অধিকারের দাবি ফেরত পেয়েই রাস্তা ছাড়েননি।
পুলিশদের পেটানো হচ্ছে এবং মিলিটারি দাঁড়িয়ে চুপ করে দেখছেন। তারা চাইছেন নতুন ব্যবস্থা, চাইছেন গুলি চালানোর বিচার, চাইছেন যাবতীয় দুর্নীতির তদন্ত। নিজেরাই বলছেন, এটা জেন-জির বিপ্লব; আমরা নতুন সমাজ তৈরি করব। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তাল।
এই বিক্ষোভ আরেকটা নতুন আলোচনাকে উসকে দিচ্ছে। এই কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন অস্থিরতা চোখে পড়ছে, যা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে। শ্রীলংকায় এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত একটা পারিবারিক রাজবংশের মতো শাসনব্যবস্থার পতন ঘটিয়েছিল।
তার রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশে এক সীমিত কোটা সংস্কার আন্দোলন একটা বিশাল গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়ে সরকার পরিবর্তন ঘটাল। প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে বেঁচেছেন, তা আমরা দেখেছি। আর এখন নেপালে সামাজিক মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভ একদিনের মধ্যে বেকারত্ব-দুর্নীতির বিরুদ্ধে আরেকটা বৃহত্তর আন্দোলনের চেহারা খালি নিল না, এমন একটা চেহারা নিল যাতে করে সরকার পতন বলা যায় না, মানে সরকার নেই ওখানে, কেউ নেই ওখানে-প্রেসিডেন্টও নেই, প্রধানমন্ত্রীও নেই। কাজেই খুব স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো, এই গণবিক্ষোভের ঢেউ কি এবার ভারতেও আছড়ে পড়বে? গণবিক্ষোভ যদি চারধারজুড়ে হয়, তাহলে ভারতে কেন আছড়ে পড়বে না? নাকি ভারতের পরিস্থিতি একেবারেই আলাদা?
শ্রীলংকার বিপর্যয় থেকে শুরু করা যাক, যেখানে অর্থনীতি ছিল একমাত্র কারণ। আগে শ্রীলংকায় অনেক রকমের জটিলতা ছিল; এবারে যা হয়েছে তার কারণ অর্থনীতি। শ্রীলংকায় গণবিক্ষোভের মূল চালিকাশক্তি ছিল কোনো রাজনৈতিক দল, কোনো নির্দিষ্ট সামাজিক ইস্যু। কিন্তু এটা ছিল একটা ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে অচল করে দিয়েছিল এবং এই সংকটের পেছনে বেশকিছু কারণ ছিল।
২০১৯ সালে গোতাবায়া রাজাপাকসের সরকার ক্ষমতায় এসে এক অযৌক্তিক কর ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। হঠাৎ করে কর ছাঁটাইয়ে সরকারের রাজস্ব মারাত্মকভাবে কমে যায়। সেই সঙ্গে যোগ হয় চড়া সুদের বাণিজ্যিক ঋণের ওপর বিরাট নির্ভরতা। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সাল নাগাদ শ্রীলংকার বৈদেশিক ঋণের ৫৬ শতাংশ ছিল এই বাণিজ্যিক ঋণ; যেখানে ২০০৭ সালে এই হার ছিল মাত্র ২.৫ শতাংশ।
আরেকটা বিরাট উদাহরণ ছিল কৃষিতে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত। সরকার এক রাতের মধ্যে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করে জৈব সারে চাষের ওপর জোর দিল। পরে এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়েছিল; কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপর আসে কিছু অপ্রত্যাশিত বহিরাগত ধাক্কা।
কোভিড-১৯ অতিমারি শ্রীলংকার পর্যটনশিল্পকে সম্পূর্ণ স্থবির করে দেয়-সেখানকার বৈদেশিক টাকা রোজগারের অন্যতম প্রধান উৎস। সেটা কাটতে না কাটতেই শুরু হয়ে যায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয়। এ সবকিছু একসঙ্গে মিলে একটা ধাক্কা, যা শ্রীলংকার সীমিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় নিঃশেষ করে দেয়।
ফলে দেশটি প্রয়োজনীয় আমদানি করতেও ব্যর্থ হয়। যখন মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতি হয়, নিয়ন্ত্রণহীন মুদ্রাস্ফীতি হয়, তখন একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে; তখন সাধারণ মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হবে, আগুন লাগবে। সেই স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের মুখে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার পরিবারের সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
এবারে আসুন বাংলাদেশের পরিবর্তনে। আদতে এক কোটা বাতিলের আন্দোলন সরকার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াল। বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ শুরু হয়েছিল নির্দিষ্ট দাবিকে কেন্দ্র করে। সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার। এক সীমিত ছাত্র আন্দোলন হিসাবে এটার সূচনা হয়েছিল; কিন্তু আন্দোলন দমনে সরকারের চূড়ান্ত দমনমূলক ব্যবস্থা, পুলিশি জুলুম, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর একধরনের প্রতারণামূলক ভাষণ এবং দেশজুড়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। ফলে আন্দোলন দ্রুত কোটা সংস্কারের ছোট্ট গণ্ডি পেরিয়ে বৈষম্যবিরোধী এবং তারপর গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল, যা সাধারণ মানুষকে এর সঙ্গে যুক্ত করেছিল। সরকার প্রথমে এর গুরুত্ব বুঝতেই পারেনি।
ছাত্রদের আন্দোলন কঠোর দমনপীড়ন দিয়ে মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছিল। জাতিসংঘের একটা প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী-পুলিশ, র্যাব, বিজিবি আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করেছে। মারার জন্য গুলি চালিয়েছে। যার ফলে জুলাই-আগস্টে প্রায় ৬৫০ জন মারা যান। সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দিয়ে আটক ছাত্রনেতাদের জোর করে তাদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি বের করে ভিডিও প্রকাশ করে আন্দোলন দমন করতে গিয়েছিল। কিন্তু এই কৌশলগুলো কাজে দেয়নি। জনগণের ক্ষোভ কমার বদলে তা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৫ আগস্ট তৎকালীন সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন, সেনাবাহিনী আর জনগণের ওপর গুলিটুলি চালাতে রাজি নয়। সামরিক বাহিনীর এই নিরপেক্ষ অবস্থাই সরকারের পতনের চূড়ান্ত কারণ হিসাবে কাজ করে। দুপুর ২টার দিকে যখন সেনাপ্রধান প্রধানমন্ত্রীকে এই সিদ্ধান্তের কথা জানাচ্ছেন, তখন লাখ লাখ বিক্ষোভকারী ঢাকার কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করতে শুরু করেছে এবং সেদিনই সরকারের পতন হয়েছে।
বাংলাদেশের ঘটনাটা প্রমাণ করে যে, একটা সরকার যদি শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকে দমনপীড়নের মাধ্যমে মোকাবিলা করার চেষ্টা করে, তবে সেই দমনপীড়নই জনগণকে আরও বেশি করে উসকে দিতে পারে। একই সঙ্গে এটাও দেখায়, যে কোনো গণতান্ত্রিক বা অর্ধগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর ভূমিকা কতটা নির্ণায়ক হতে পারে।
তিন নম্বর হচ্ছে নেপালের নতুন ছবি, যা আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভের বিস্ফোরণ জন্ম দিয়েছে দেশজুড়ে আন্দোলনের। নেপালের চলমান বিক্ষোভের সরাসরি সূত্রপাত হয়েছিল সরকারের এক আপাতদৃষ্টিতে ছোট্ট সিদ্ধান্তের কারণে। ২৬টা সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম, যার মধ্যে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব ইত্যাদি আছে, সেগুলোকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
সরকার জানিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মগুলো সরকারের কাছে নিবন্ধিত না হওয়ায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে ব্যবসা, পর্যটন মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে এবং প্রবাসে থাকা স্বজনদের সঙ্গে নাগরিকদের যে যোগাযোগ, সেটাও বন্ধ হয়ে যায়। লাখ লাখ মানুষ, যারা এই প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে সামান্য কিছু আয় করে, তারাও সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু বিক্ষোভ এক বিরাট চেহারা নেওয়ার পর বিক্ষোভকারীরা নিজেরাই বলছে, এটা শুধু একটা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ নয়।
এই আন্দোলনের মূল কারণ হলো নেপালের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। একেকজন মন্ত্রী এবং মন্ত্রীর ছেলেমেয়ে, পরিবারের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি। তাদের গাড়ি দেখলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে। তারা যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে-আসছে, তখন মনে হচ্ছে, যে কাউকে চাপা দিয়ে দিতে পারে।
একজন বিক্ষোভকারী বললেন, আমরা আমাদের দেশকে ফিরে পেতে চাই; আমি এসেছি দুর্নীতি বন্ধ করতে অর্থাৎ ওই সমাজমাধ্যম বড় ব্যাপার নয়, এই আন্দোলন জেন-জি বা নতুন প্রজন্মের হাতে চলে গেছে, যারা রাষ্ট্রের কাছে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে এক তরুণ বলছেন, নেতাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ যদি উজ্জ্বল হয়, তাহলে আমাদেরটা কোথায়? ঠিক কথা। এই বিক্ষোভ এক প্রযুক্তিগত অনুঘটকের টেকনোলজি ক্যাটলিস্টের মাধ্যমে সামনে এসে দাঁড়াল। আদতে এটা গভীর সামাজিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ এবং এ ঘটনা দেখাচ্ছে যে, একটা আপাত ছোট সরকারি সিদ্ধান্ত কীভাবে সমাজের অন্তর্নিহিত ক্ষতগুলোকে উন্মোচন করতে পারে; বের করে আনতে পারে, তুলে ধরতে পারে, বিশেষ করে যখন সেই সমাজে ব্যাপক বেকারত্ব ও দুর্নীতির মতো সমস্যা আছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই তিন দেশের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষাপটে একটা প্রশ্ন উঠছে যে, ভারতেও কি একই ধরনের বিস্ফোরণের আশঙ্কা আছে? ভারতের অর্থনৈতিক চিত্রটা কিন্তু একই রকমের নয়। একদিকে দেশের শেয়ারবাজার আপাতত এক জায়গায়ই দাঁড়িয়ে ওঠানামা করলেও এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত নতুন নতুন রেকর্ড গড়েছে।
ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ এনএসসিতে রেজিস্টার্ড বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে, যা ভিয়েতনামের মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। মিউচুয়াল ফান্ড এবং এসআইপির মাধ্যমে খুচরা বিনিয়োগকারীর সংখ্যা অনেক দ্রুত বাড়ছে। যদিও সেই উন্নয়ন সমাজের একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির অর্থনৈতিক উন্নতিকেই ইঙ্গিত করে। অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর অংশে বেকারত্ব এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির জাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু একটা বিরাটসংখ্যক মানুষ আছেন মোটামুটিভাবে।
এই মোটামুটি থাকা লোকজন শিক্ষিত মানুষ, তারা এ ধরনের রিস্কের জায়গায় যেতে চাইছেন না, এটা একটা কারণ হতে পারে। সামগ্রিক বেকারত্বের হার আপাতদৃষ্টিতে কম মনে হলেও এপ্রিলে ৫.১ শতাংশ যুবসমাজে, বিশেষ করে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সের মধ্যে বেকারত্বের হার সাংঘাতিক। ১৫.৩ শতাংশ উচ্চশিক্ষিত তরুণের মধ্যে এই হার আরও বেশি। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কর্মসংস্থানের কোনো মিলই নেই। মুদ্রাস্ফীতি একটা বড় উদ্বেগের কারণ। খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। আমদানি করা পণ্যের মুদ্রাস্ফীতির হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এতটাই বেড়েছে, টিআইবির ১৬ মার্চ ২০২৫-এর বিবৃতি দেখে নিন, এই অর্থনৈতিক বৈষম্য সামাজিক অস্থিরতার অন্যতম প্রধান কারণ হতে পারে। শিক্ষিত অথচ বেকার যুবসমাজ, যাদের উচ্চাশা আছে কিন্তু সুযোগ নেই, তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তেই পারেন। আগে যে হয়নি তাও তো নয়।
প্রথমত, মোদি সরকারের আনা তিনটি বিতর্কিত কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকরা দীর্ঘ এক বছর ধরে দিল্লির সীমান্তে অবস্থান বিক্ষোভ করেছিল। কৃষকদের মূল দাবি ছিল করপোরেট পুঁজির হাত থেকে কৃষিকে বাঁচানো, এমএসপি নিশ্চিত করা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চিত করা। সরকার প্রথমে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলেও আন্দোলনের তীব্রতা, কৃষকদের যে ইউনিটি, তার কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করে বিতর্কিত তিনটি আইন তুলে নেয়।
দ্বিতীয় যেটা হলো, ২০১৯ সালে পাশ হওয়া বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। এই আইন আমাদের প্রথমবার নাগরিকত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে ধর্মকে একটা মাপকাঠি হিসাবে ব্যবহার করে, যা ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে খাপ খায় না। এই আন্দোলন ছিল মূলত আদর্শগত এবং শহরাঞ্চলে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়-হায়দরাবাদ, দিল্লি, শাহেনবাগ, মুম্বাই, কলকাতা-সরকারের কঠোর দমনপীড়নে সামলানো যাচ্ছিল না। সরকারের মধ্যে নানা প্রশ্নও উঠছিল। এই দুটো আন্দোলনই দেখায় যে, ভারতীয় সরকার একদিকে যেমন সুসংঘবদ্ধ আন্দোলনের চাপে পড়ে ছাড় দিতে বাধ্য হয়, অন্যদিকে দমনপীড়নের মাধ্যমেই আদর্শগত আন্দোলনকে একেবারে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে তাও নয়।
কারণ ও ফলাফলগুলোকে ভারতের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করলে কয়েকটা মৌলিক পার্থক্য দেখা যায়, যেমন শ্রীলংকায় বিক্ষোভ শুরুর মূল কারণ ছিল তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত বৈদেশিক ঋণের প্রতিক্রিয়া। সরকার জরুরি অবস্থা, কারফিউ জারি করলে শেষ পর্যন্ত সরকার ভেঙে গেল এবং প্রেসিডেন্টকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এক সীমিত কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম নিয়েছিল।
এটারও কারণ ছিল প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য ও দুর্নীতি। নেপালের বর্তমান বিক্ষোভের সূত্রপাত সামাজিক মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার কারণে; কিন্তু এর পেছনে রয়েছে গভীর বেকারত্ব, দুর্নীতি এবং তরুণ প্রজন্মের হতাশা। নেপালের বিক্ষোভের পেছনে রাজতন্ত্রের সাহায্য, উসকানি থাকতেই পারে। অন্যদিকে ভারতে বিতর্কিত কৃষি আইন বা সিএবিরোধী আন্দোলনের মতো বড় বড় বিক্ষোভ হলেও সেগুলো সুনির্দিষ্ট কারণকে কেন্দ্র করে হয়েছিল।
অতএব গোটা দেশের মানুষ একটা জায়গায় এসে দাঁড়াচ্ছেন না। ভারতের রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলো বিভক্ত, দুর্বল, যা জনগণের ক্ষোভকে একটা জায়গায় একটা প্ল্যাটফর্মে আনতে ব্যর্থ। শ্রীলংকা, বাংলাদেশ বা নেপালের বিক্ষোভগুলো হয় স্বতঃস্ফূর্ত গণ-আন্দোলন অথবা সুসংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সামনে এসেছিল।
এসবের ওপরে রয়েছে ১৯৫০ সাল থেকে লাগাতার ভারতবর্ষের নির্বাচন। লাগাতার নির্বাচন, ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হাতবদলের ইতিহাস। মানুষ এখনো মনে করে, নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারকে, সে যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, তাকে বদলানো যায়। ইন্দিরা গান্ধীর মতো স্বৈরাচারী সরকারের পতন আমরা দেখেছি। কাজেই এক অটুট বিশ্বাস মানুষের আছে এই দেশের সংসদীয় ব্যবস্থার ওপর, যা কিন্তু নেপাল বা বাংলাদেশ বা শ্রীলংকায় ছিল না।
ভারতে ১৯৫০ থেকে আজ অবধি সব রাজ্যে, কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে সেই নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর থেকে মানুষের বিশ্বাস কিন্তু চলে যাচ্ছে বা সরকার এমন কিছু করছে, যাতে করে মানুষ মনে করছে আমার ভোটে কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর তাই এই মুহূর্তে ভারতে ওই দেশগুলোর মতো একটা সর্বব্যাপী গণবিস্ফোরণের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম হলেও একেবারে নেই, এ কথা বলা যাবে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়া এই আগুন আমাদের দেশে জ্বলবে না, তেমন গ্যারান্টি কিন্তু কেউ দিতে পারবে না।
বাংলাবাজার ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে
অনিকেত চট্টোপাধ্যায় : ভারতীয় সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক