আন্তর্জাতিক ডেস্ক : কল্পনা করুন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আবারও একটি সংঘাত শুরু হলো এবং ইসলামাবদকে সহায়তায় সৌদি আরবের বিমানবাহিনী তাদের এফ-১৫ এবং ইউরোফাইটার টাইফুন পাঠাল। সৌদি আরবের সঙ্গে সদ্য স্বাক্ষরিত প্রতিরক্ষা চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান এমন ‘স্বপ্ন’ দেখতেই পারে।
কিন্তু পাকিস্তানের এই ফ্যান্টাসি সৌদি আরবের অগ্রাধিকার কিংবা বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে নাও মিলতে পারে। বিশ্লেষকরা এই চুক্তিকে নিছকই এক ধরনের ‘লোক দেখানো’ বলে অভিহিত করছেন, যার লক্ষ্য ভারতের চেয়ে ইসরায়েলের দিকে বেশি।
গতকাল বুধবার সৌদি আরব এবং পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তিতে’ কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। চুক্তিটিতে কোনো দেশের নাম উল্লেখ না করে বলা হয়েছে, ‘দুই দেশের যে কারও বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসন উভয় দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন বলে বিবেচিত হবে।’
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট— ন্যাটোর আদলে এই প্রতিরক্ষা চুক্তি এবং ‘একজনের ওপর আক্রমণ=দুজনের ওপর আক্রমণ’–এ ধরনের শব্দমালা ইসলামাবাদে একটি বড় কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে দেখা হবে। এটি সম্ভবত ভারতকে প্রতিরোধের জন্য একটি কৌশলগত উপায় হিসেবে কাজ করবে।
যদিও পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে কয়েক দশক ধরে অনানুষ্ঠানিক প্রতিরক্ষা সম্পর্ক থাকলেও, সর্বশেষ এই চুক্তিটি ইসলামিক দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতাকে আনুষ্ঠানিক করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার দিকেও ইঙ্গিত করে।
এই চুক্তির অর্থ ভারতের জন্য কী?
বিশেষজ্ঞ এবং ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছেন, এই চুক্তির অর্থ এই নয় যে, সৌদি আরব পাকিস্তানের জন্য ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। বাস্তব পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই ঘোষণার সময়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তিটিকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কের বিষয়ে সতর্কতা হিসেবে সৌদি আরব দ্রুতই ঘোষণা দেয়, ‘ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী।’
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এক সিনিয়র সৌদি কর্মকর্তা বলেছেন, ‘চুক্তিটি কোনো নির্দিষ্ট দেশ বা নির্দিষ্ট ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়... ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী। আমরা এই সম্পর্ককে আরও বাড়াতে থাকব এবং যেকোনো উপায়ে আঞ্চলিক শান্তিতে অবদান রাখার চেষ্টা করব।’
সৌদি আরব ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার, আর দিল্লি রিয়াদের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ছিল ৪১.৮৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। উভয় দেশের মধ্যে গভীর অর্থনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে বাণিজ্য মাত্র ৩-৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তাই, সৌদি আরবের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যাওয়া প্রায় অসম্ভব।
অস্ট্রিয়ান ভূ-রাজনৈতিক কৌশলবিদ ভেলিনা চাকারোভা এক এক্স বার্তাং বলেন, ‘এই চুক্তি দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে সৌদির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা তুলে ধরেছে। ভারতের জন্য সংকেত: সৌদি ভারসাম্য রক্ষা আরও জটিল হয়ে উঠছে।’
এদিকে ভারত সতর্কতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে এবং উল্লেখ কতরেছে ‘চুক্তিটি সৌদি আরব ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিক রূপ ছাড়া আর কিছু নয়।
ইসরায়েলের জন্য সংকেত?
প্রকৃতপক্ষে, এই চুক্তির সময়টি ইসরায়েলের প্রতি একটি ইঙ্গিত বলেই ধারণা করা হচ্ছে। কারণ কাতারে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে ইসরায়েলি হামলার করার কয়েক দিন পরেই এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ইরান, লেবানন, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের পর কাতার ইসরায়েলি তৎপরতা আরব দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে উপসাগরীয় দেশগুলো জানে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলই একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশ। সুতরাং, সৌদি-পাকিস্তান আঁতাত হলো বৃহত্তর ইসলামিক ব্লকের সংহতি এবং একটি ঐক্যবদ্ধ অবস্থান তুলে ধরার একটি বার্তা।
স্পেনের একজন সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্লেষক ড. বিলাল আফজাল এক এক্স বার্তায় বলেছেন, ‘সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি কাগজে-কলমে পারস্পরিক মনে হলেও, বাস্তবে তা নয়। পাকিস্তানে হামলা হলে রিয়াদ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে না। কিন্তু ইসরায়েল যদি কখনো সৌদি আরবে আক্রমণ করে, তাহলে ধর্ম, রাজনীতি এবং চুক্তির জন্য পাকিস্তান সেখানে হস্তক্ষেপ করবে।’ সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে