শনিবার, ০৫ মার্চ, ২০১৬, ০৫:৫৮:০৬

'নেতানিয়াহু আরব লীগ প্রধান হলে অবাক হবেন না!'

'নেতানিয়াহু আরব লীগ প্রধান হলে অবাক হবেন না!'

আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতি (গত ২ মার্চ) লেবাননের জনপ্রিয় ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ বলে ঘোষণা করেছে পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসি এবং আরব লীগ। পিজিসিসি’র সব সদস্যই রাজতান্ত্রিক দেশ এবং সৌদি আরবের অনুগত রাষ্ট্র। আর এর বাইরের আরব সরকারগুলোর বেশিরভাগই সৌদি অর্থ-সহায়তাকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

আরব আমিরাত, বাহরাইন, সৌদি আরব, ওমান, কাতার ও কুয়েত পিজিসিসি বা পারস্য উপসাগরীয় পরিষদের সদস্য। এই পরিষদ ও আরব লীগের মন্ত্রিপরিষদও লেবাননের জনপ্রিয় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী বলে ঘোষণা করেছে। লেবাননী ও ফিলিস্তিনি নানা দল এবং খ্যাতনামা আরব নেতা ও ব্যক্তিত্বসহ এ অঞ্চলের অনেকেই এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। অবশ্য ইহুদিবাদী ইসরাইল এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। কথায় বলে সমধর্মীরা একই-পথে চলে।

লেবাননের হিজবুল্লাহ এই ঘোষণার জবাবে বলেছে, এ আন্দোলন বহুমুখী চাপ এবং রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমের হামলার কাছে নতি স্বীকার করবে না; বরং ইহুদিবাদী ও তাকফিরি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। এই আন্দোলন মজলুম ফিলিস্তিনি, সিরিয় ও ইয়েমেনি জাতিসহ মজলুম জাতিগুলোর প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখবে। হিজবুল্লাহ আরও বলেছে, আরব লিগ ও পিজিসিসি এই পদক্ষেপের মাধ্যমে দখলদার ইসরাইলের সেবা ও সহযোগিতা জোরদার করল।

লেবাননের পাশ্চাত্যপন্থী ফোরটিন মার্চ জোটের নেতা এবং আলমুস্তাকবাল দলের প্রধান সা'দ হারিরি বলেছেন, আরব-লিগের এ ঘোষণা সত্ত্বেও হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের আলোচনা অব্যাহত থাকবে। ফোরটিন মার্চ জোটের সঙ্গে সৌদি সরকারের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।

লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, ওমান, তিউনিশিয়া ও আলজেরিয়া জনপ্রিয় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংস্থা বলে ঘোষণা দেয়ার তীব্র বিরোধিতা করেছে। এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের সংগ্রামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ইসলামী জিহাদ। এ ছাড়াও কয়েকটি ইসরাইল-বিরোধী সংগ্রামী ও প্রতিরোধকামী দলও নিন্দা জানিয়েছে এই পদক্ষেপের।  

ইয়েমেনের জনপ্রিয় ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন আনসারুল্লাহও হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করার হঠকারী পদক্ষেপকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি ও এ অঞ্চলের জালিম সরকারগুলোর প্রতি বিনামূল্যের সেবা বলে নিন্দা জানিয়েছে।  

আরব ও মুসলিম বিশ্বের গর্ব হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করার হঠকারী পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরান। এ পদক্ষেপকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের অপরাধযজ্ঞের দিক থেকে বিশ্ব-জনমতের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আবদুল্লাহিয়ান।  

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হোসেন জাবের আনসারিও বলেছেন, হিজবুল্লাহ যখন দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে মজলুম ফিলিস্তিনিদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে আদর্শ বা মডেলে পরিণত হয়েছে ঠিক তখন পারস্য উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা পিজিসিসিভুক্ত আরব দেশগুলো হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা দিল।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সিরিয়া ও লেবাননে দায়েশ ও আন্‌ নুসরার মতো উগ্র ওহাবি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতা মোকাবেলায় হিজবুল্লাহর বিরাট অবদানের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, রাজতান্ত্রিক আরব সরকারগুলো এমন সময় হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করল যখন তাকফিরি সন্ত্রাসের কারণে লেবাননের জাতীয় নিরাপত্তা ও ঐক্য হুমকিগ্রস্ত হয়েছে এবং একই সঙ্গে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

রাশিয়া বলেছে, দেশটি প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহকে লেবানন সরকারের অংশ বলেই মনে করছে এবং এই নীতি অব্যাহত থাকবে।

এদিকে আরবি দৈনিক ‘রাই আলইয়াওম’ অপরাজেয় বলে কথিত ইহুদিবাদী ইসরাইলের বিরুদ্ধে গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্য সর্বপ্রথম ও কয়েকটি কিংবদন্তীতুল্য বিজয় অর্জনের গৌরব সৃষ্টিকারী হিজবুল্লাহকে আরব লিগের পক্ষ থেকে সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। দৈনিকটি এ ব্যাপারে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক ভাষায় লিখেছে, এ সিদ্ধান্তের ফলে মনে করা যায় যে ইহুদিবাদী ইসরাইল শিগগিরই আরব লিগে যোগ দিতে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যদি আরব লিগের মহাসচিব হন তাহলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না! দৈনিকটি এ পদক্ষেপকে ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রতি আরব সরকারগুলোর সবচেয়ে বড় পুরস্কার হিসেবে অভিহিত করে বলেছে, এর ফলে লেবানন আর গাজায় ইহুদিবাদী ইসরাইলের নতুন যুদ্ধ ও আগ্রাসনের পথ প্রশস্ত হল।

দৈনিকটি আরও লিখেছে, ‘আরব লিগের এ সিদ্ধান্তের পেছনে সৌদি অর্থের প্রভাব ছিল খুবই ব্যাপক। ফলে দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধকে সন্ত্রাস বলে অপবাদ দেয়া হল এবং আরব লিগের এই গোলামসুলভ সেবার পরিণতিতে হয়তো শিগগিরই আমরা দেখব যে নেতানিয়াহু নিজেই এই সংস্থার মহাসচিব হয়েছেন!’

বিশ্লেষকরা হিজবুল্লাহর প্রতি সৌদি সরকার ও তার লেজুড়দের ক্ষোভ বেড়ে যাওয়াকে আরব লিগ ও পিজিসিসি’র হিজবুল্লাহ-বিদ্বেষী ঘোষণার অন্যতম বড় কারণ বলে মনে করছেন। এমনিতেই ইরানপন্থী ও ইসরাইল-বিরোধী হিজবুল্লাহ আরব বিশ্বে প্রতিরোধ আন্দোলনের জনপ্রিয় এবং সফল মডেলে পরিণত হওয়ায় ইসরাইল আর পাশ্চাত্যের সেবাদাস আরব সরকারগুলো তাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। তার ওপর সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায় সৌদি-মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের ব্যাপক বিপর্যয়ে লেবাননের হিজবুল্লাহর ভূমিকা সৌদি সরকার এবং তার মিত্র বা লেজুড়দেরকে এই আন্দোলনের প্রতি আরও বেশি ক্ষুব্ধ করেছে।

এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক এক ভাষণে লেবাননের হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ বলেছেন, ‘সৌদি সরকার সেই ২০০৫ সাল থেকেই হিজবুল্লাহর ওপর ক্ষুব্ধ। লেবাননের কয়েকটি অঞ্চলে গাড়ি বোমাগুলোর বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল সৌদি-ব্যবস্থাপনায়। সৌদি আরব এ অঞ্চলের নানা দেশে পরোক্ষভাবে যুদ্ধ করছে। তবে একমাত্র ইয়েমেনেই সরাসরি যুদ্ধ করছে সৌদি শাসকগোষ্ঠী। এ ব্যাপারে যারাই নীরব থাকতে চায় তারা নীরব থাকুক, কিন্তু আমরা হিজবুল্লাহ ইয়েমেনে সৌদি আরবের এতসব অপরাধের ব্যাপারে নীরব থাকতে পারব না। আর নীরব না থাকাটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে সেই অপরাধের জন্য আমরা গর্বিত। আমার জীবনের সবচেয় সম্মানজনক বিষয় হল এটা যে ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসন শুরু হওয়ার দ্বিতীয় দিনেই আমি এর বিরুদ্ধে ভাষণ দিয়েছি। এ ভাষণ এক জিহাদ। কারণ, আমি সত্য কথাই বলছি। ইয়েমেনের জনগণ এতই মজলুম যে তাদের ওপর জুলুম ফিলিস্তিনিদের ওপর সংঘটিত জুলুমের চেয়েও বেশি ভারি হয়ে পড়েছে। ইয়েমেনে যে জুলুম করা হচ্ছে সৌদি সরকারের নেতৃত্বে বর্তমানে সেরকম জুলুম বিশ্বের আর কোথাও হচ্ছে না।’

হিজবুল্লাহর প্রধান সাইয়্যেদ হাসান নাসরুল্লাহ আরও বলেছেন, ইয়েমেনে সৌদি আগ্রাসনের বিষয়ে নীরব থাকার অর্থ হবে আরব ও মুসলিম বিশ্বে এ যুদ্ধকে বৈধতা দেয়া। তিনি আরও জানান, কাতারের আলজাজিরা টেলিভিশনে সৌদি সরকারের বিরুদ্ধে নানা সমালোচনা উচ্চারিত হতে থাকায় দোহাকে পিজিসিসি থেকে বের করারও হুমকি দিয়েছিল সৌদি সরকার।

যে হিজবুল্লাহ এতটা স্পষ্টভাষী ও সংগ্রামী সে হিজবুল্লাহর গায়ে সন্ত্রাসীর লেবেল এঁটে দেয়ার চেষ্টা সৌদি সরকার ও তার লেজুড়রা যে করবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সৌদি সরকার ও তার লেজুড়রা বহু বছর থেকেই ইহুদিবাদী ইসরাইল এবং মার্কিন সরকারকে বলে আসছে যে যত অর্থ লাগে আমরা সৌদি সরকার তা দেব, ইরানপন্থী ও ইসরাইল-বিরোধী হিজবুল্লাহকে ধ্বংস করে দিন!-রেডিও তেহরান
০৫ মার্চ, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে