জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: ২০০৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের, বর্তমানে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সোয়াত উপত্যকায় মাওলানা ফজলুল্লাহ বলে এক ইসলামি উগ্রবাদী দলের নেতা সেই এলাকার ৫৯টি গ্রাম দখল করে নেন পাকিস্তান সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের তাড়িয়ে দিয়ে। দখল করতে তাঁর সঙ্গে ছিল সাড়ে চার হাজার জঙ্গি বাহিনী। দখল করার পর ফজলুল্লাহর দল সোয়াত উপত্যকায় এক সমান্তরাল সরকার গঠন করে এবং তাঁর ভাষ্যমতে শরিয়া আইন ও আদালত গঠন করে।
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কর্তাব্যক্তিরা উপত্যকা থেকে পালাতে বাধ্য হন। প্রায় দুই বছর পর পাকিস্তান সরকার তুমুল যুদ্ধের পর সোয়াতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ পুনঃস্থাপন করতে পারে এবং সাময়িক শান্তি স্থাপন করে, তাও এলাকায় শরিয়া আইন বলবৎ রাখবে এই আশ্বাস দেওয়ার পর। মাওলানা ফজলুল্লাহর অভ্যুত্থান এবং সোয়াত দখল কোনো আকস্মিক ব্যাপার ছিল না। তিনি তাঁর উগ্রপন্থী ধর্মীয় মতবাদ বহু বছর আগে থেকেই চালিয়ে আসছিলেন।
আদর্শগতভাবে আফগানিস্তানের তালেবান আন্দোলনের সঙ্গে মিল থাকলেও তিনি আরও কট্টরবাদী এক দল সৃষ্টি করেন, যার মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান একটি নিষ্কলুষ শরিয়া রাষ্ট্র হবে এবং যারা এর প্রতিরোধ করবে, তারা ইসলাম ও দেশের শত্রু হিসেবে পরিগণিত হবে। সে জন্যই তাঁর দল পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। তাঁর কট্টরবাদিতার কিছু উদাহরণ; তিনি মেয়েদের সব স্কুল বন্ধ করে দেন, ছেলেরা যাতে দাড়ি কামাতে না পারে, সে জন্য চুল কাটার দোকান বন্ধের আদেশ দেন, সব সিনেমা হল ও ভিডিওর দোকান বন্ধের আদেশ দেন, গানের রেকর্ড জ্বালিয়ে দেন। (এই ফজলুল্লাহর নির্দেশেই পরবর্তী সময়ে প্রতিবাদী মেয়ে মালালার ওপর গুলি চালানো হয়)।
মাওলানা ফজলুল্লাহ তাঁর আন্দোলন এবং দল গঠনের কাজ বলতে গেলে সোয়াত দখলের সাত-আট বছর আগে থেকে প্রায় অবারিতভাবে করে যাচ্ছিলেন। তিনি তাঁর উগ্রবাদী মন্তব্য এবং ভাষণ স্থানীয় রেডিওতে প্রচার করতেন। কয়েকটি নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসার মাধ্যমে এসব ভাষণ প্রচার করা হতো। সোয়াত তাঁর দলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার আগে থেকেই তাঁর দলের লোকজন এর বাসিন্দাদের প্রায়ই হুমকি-ধমকি দিত। সোয়াতের বাসিন্দারা ভয়ে কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যেত না। কারণ, ওরাও এই দলের কাউকে বেশি ঘাঁটাতে চাইত না। সে সময়ে পাকিস্তানে ছিল পিপলস পার্টির সরকার আর আসিফ আলী জারদারি ছিলেন প্রেসিডেন্ট। জারদারি তখন, বিশেষ করে পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করে সরকার চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
তিনি কোনো রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করতে চাইতেন না, সেনাবাহিনীকে তো নয়ই। সোয়াতে কী হচ্ছে, কী না হচ্ছে তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতে চাইতেন না, ভাবখানা সোয়াত বহুদূর, আর এলাকাটা তো সারা পাকিস্তান নয়? অতএব যা হওয়ার তা-ই হলো, সোয়াত হাতছাড়া হলো।
অবস্থা হয়তো তা-ই থাকত, যদি এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চাপ না দিত। আফগানিস্তানের তালেবান দমাতে যুক্তরাষ্ট্রকে দারুণভাবে চিন্তিত করে এই নতুন সৃষ্ট উগ্রবাদী দল। তালেবানকে প্রতিহত করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়তা প্রয়োজন।
এখন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা প্রতিকূল হলে এ সহায়তা পাওয়া দুষ্কর হবে। তাই ফজলুল্লাহর বাহিনীকে তাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধানকে চাপ দেয় এবং সাহায্যের আশ্বাস দেয়। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সোয়াত পুনর্দখল করে এবং এতে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলা ভূমিকা রাখে। অবশ্য পাকিস্তান সরকারের সোয়াতে শরিয়া আইন অপরিবর্তিত রাখার অঙ্গীকার শান্তি ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
আজ প্রায় ১০ বছর পর মাওলানা ফজলুল্লাহ আর তাঁর দলের ইতিহাস তুলে ধরার কারণ বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু ভীতিকর ঘটনা, আর সে ব্যাপারে আমাদের সরকারি ভাষ্য। গত দুই বছরে রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য জেলায় ডজন খানেক হত্যা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন বিদেশি, বাকিরা বাংলাদেশি। বাংলাদেশিদের মধ্যে আছেন কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। নিহত বাংলাদেশিদের মধ্যে রয়েছেন কিছু মুক্তমনা লেখক, শিক্ষক ও প্রকাশক।
একটি মতাদর্শের মুখোমুখি হতে হয় অন্য আদর্শ নিয়ে, যা মানুষকে হানাহানি থেকে মানবতার পথে নিয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন সাধারণ মানুষের জন্য আইনের আশ্রয় ও সুরক্ষা এসব জঘন্য হত্যার কোনোটির বিচার হয়েছে বলে আমার জানা নেই, তবে প্রতিটি ঘটনার পর দুই রকমের ভাষ্য আমি শুনেছি। প্রথমটি শুনেছি, এই হত্যার জন্য দায়িত্ব নিয়েছে একটি দল, যারা নিজেদের হাজার হাজার মাইল দূরে সংগঠিত এক বা একাধিক জঙ্গি শক্তির অনুসারী বলে দাবি করে।
দ্বিতীয় হচ্ছে, সরকারি মন্ত্রী কিংবা আরও উচ্চপর্যায় থেকে ভাষ্য। এসব ভাষ্যে এই হত্যাকাণ্ডগুলো হয় বিরোধী দল, না হয় বিচ্ছিন্ন আতঙ্কবাদীদের কাজ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ফল হয়েছে যে আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুচারুভাবে এ হত্যাকাণ্ডগুলোর তদন্ত, বিশেষভাবে এর পেছনে কোনো বিশেষ মতাদর্শের গোষ্ঠী সংঘবদ্ধভাবে কাজ করছে কি না, তা না দেখে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কথায় সাড়া দিয়ে যাচ্ছে। খুনিদের না খুঁজে কেন তাঁরা খুন হলেন তার ব্যাখ্যা খুঁজছে।
এ সুযোগ নিচ্ছে সেই গোষ্ঠী, যারা তাদের মতাদর্শ অনুযায়ী নীরবে কাজ করছে, আর প্রয়োজনে তাদের মতাদর্শবিরোধী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
আজকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি দেখে আমার মনে হচ্ছে আমাদের নেতারাও এমন ভাব হয়তো নিচ্ছেন যে হত্যাকাণ্ডগুলো দেশের বিরুদ্ধে কোনো বিরাট হুমকি নয়, এগুলো কিছু ব্যতিক্রমী মানুষের বিরুদ্ধে কিছু লোকের আক্রোশের ফল। দুঃখের বিষয়, সোয়াতে যে মতাদর্শ ফজলুল্লাহ প্রচার করেছিলেন, তা তিনি চলে যাওয়ার পর তাঁর অনুসারীরা শুধু সোয়াতেই নয়, পাকিস্তানের বহু এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং এখনো পাকিস্তানকে তার মূল্য দিতে হচ্ছে।
বাংলাদেশে যা ঘটছে একদিকে হয়তো তা কিছু লোকের কাছে মনে হতে পারে এটা শুধু তাদের ভেতর সীমিত, যারা ব্যতিক্রমী কাজ করেন। কিন্তু তাদের এবং আমাদের সবার জানা থাকা দরকার যে এসব হত্যার পেছনে একটা যোগসূত্র আছে আর তা হচ্ছে একধরনের মতাদর্শের ধারণায় নিহত ব্যক্তিদের ভাবমূর্তি। নিহত ব্যক্তিরা তাদের শিকার, কারণ তাঁরা তাদের মতাদর্শবিরোধী, কিংবা সেসব দেশের নাগরিক, যাঁরা তাদের অনুসারীদের ক্ষতি করেছেন। তারা প্রতিটি দেশে তাদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। যাঁরা এ মত পোষণ করেন যে বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গি শক্তির উপস্থিতি নেই, তাদের জানা থাকা দরকার যে বিদেশি জঙ্গিদের দেশে অবস্থিতির অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশে মধ্যপ্রাচ্য বা আরব দেশীয় ব্যক্তিরা এসব কাণ্ড ঘটাচ্ছে।
বাংলাদেশে আপাতদৃষ্টিতে হয়তো মাওলানা ফজলুল্লাহর মতো ব্যক্তি নেই, কিন্তু একটি মতাদর্শ ছড়াতে ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিতি প্রয়োজন নেই, মতাদর্শের অনুসারী হতে সেই আদর্শে বিশ্বাসই যথেষ্ট।
একটি মতাদর্শের মুখোমুখি হতে হয় অন্য আদর্শ নিয়ে, যা মানুষকে হানাহানি থেকে মানবতার পথে নিয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন সাধারণ মানুষের জন্য আইনের আশ্রয় ও সুরক্ষা। আমাদের বর্তমান নাজুক পরিস্থিতির একটি কারণ হয়তো আমরা এ অবস্থা থেকে দূরে, কিন্তু এর চেয়ে বড় কারণ হলো আমরা, বিশেষ করে সরকারে যাঁরা আছেন, তাঁদের আসল পরিস্থিতি সম্পর্কে গোপনীয়তা বজায় রাখা। এতে শুধু দেশেরই ক্ষতি নয়, তাঁদেরও। উটপাখির মতো বালুতে মাথা গুঁজে না থেকে যত তাড়াতাড়ি সত্যের মুখোমুখি হওয়া যায়, ততই শুভ।-প্রথম আলো
৫মে, ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/সবুজ/এসএ