বিনোদন ডেস্ক: বাংলাদেশের সিনেমা বাজার দখল করতে মরিয়া হয়ে উঠছে ভারত। এদেশে সরাসরি সিনেমা ব্যবসা করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। সেসব বিষয়ই খতিয়ে দেখলেন সুদীপ্ত সাইদ খান।
বাংলাদেশে ভাল সিনেমার অভাবে দর্শক সিনেমা হলে যাওয়া প্রায় বন্ধই করে দিয়েছে। আর সে কারণে একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সিনেমা হল। কিন্তু সিনেমার দর্শক ঠিকই অপেক্ষায় আছেন ভাল কোন চলচ্চিত্র দেখার অপেক্ষায়। এবার এই সুযোগটি কাজে লাগাতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারত। তারই পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করতে ৫ই অক্টোবর ঢাকায় এসেছেন মুকেশ ভাট ও রমেশ সিপ্পি। এদেশে হিন্দি ছবি রপ্তানির পথ সুগম করতেই আজ বৈঠকে বসেছেন তারা।এছাড়া এদেশে সরাসরি সিনেমা ব্যবসা করতেও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত।
বাংলাদেশের সিনেমা বাজারে ঢোকার চেষ্টা ভারতের নতুন নয়, দশকের পর দশক ধরেই বাংলাদেশের বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছে ভারত। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সালে বাংলাদেশের সিনেমা বাজারে প্রবেশ করতে সরাসরি চেষ্টা করে তারা। এদেশিয় কিছু এজেন্টদের সঙ্গে যোগ সাজশে হিন্দি ছবি রপ্তানির করার উদ্যোগ নেয়। তখন ইনউইন এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এলসি খুলে বেশকিছু ছবি আমদানির করে। সেসময় সিনেমা সংশ্লিষ্টদের আন্দোলনের মুখে থেমে যায় তাদের সেই প্রক্রিয়া। বাংলা সিনেমা প্রেমীরা সেসময় প্রেসক্লাবের সামনে প্লেকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আন্দোলনও করেছিলো।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সিনেমার সূচনীয় অবস্থায় প্রসেনজিৎ সহ কলকাতার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা গোপনে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে আসেন। বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকেও তারা কলকাকতায় আমন্ত্রণ জানান।এরই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু কলকাতার আনন্দবাজারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বাংলাদেশের সিনেমা বাজার তাদের জন্য নমনীয় করা হবে। ভারতীয় ছবি বাংলাদেশের হলগুলোতে অবাধ প্রদর্শনের জন্য আমরা আইন সংশোধন করছি।’
যদিও ঐ সাক্ষাৎকারে তথ্যমন্ত্রী ভারতে বাংলাদেশি ছবি চালানোর জন্যও অনুরোধ করেছিলেন। এর কয়েক মাস পরেই ২০১৩ সালের ৭ই আগস্ট বাংলাদেশে গোপনে বৈঠক করে যান কলকাতার জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ, শ্রী ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কলকাতা সরকারের একজন প্রতিনিধি। এ বৈঠকে তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বিএফডিসির মহাপরিচালক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্রনায়ক ফেরদৌস, নায়িকা কুসুম শিকদার ও নির্মাতা মুশফিকুর রহমান গুলজারসহ আরো অনেকেই।
সেসময় এই প্রতিবেদক মুখোমুখি হয়েছিলো পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। তিনি গোপন বৈঠকের সত্যতা স্বীকার করে এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘এটা মূলত তথ্যমন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমি শুধু উপস্থিত ছিলাম। এদেশে সিনেমা চালানোর জন্য কলকাতার ওরা কিছু প্রস্তাব দিয়েছে, সেটা সরকার গ্রহণ করবে কি না তা আমি বলতে পারবো না।’
সেসময় পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে বিষয়টি চাউর হয়ে ওঠলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম হয়। কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না তখন কৌশলে পথ হাঁটা শুরু করে ভারত। যৌথ-প্রযোজনার নাম নিয়ে বাংলাদেশের বাজারে ঢুকে পড়ে তারা। অনন্য মামুনের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ১৬ মে ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’ ছবিটি বাংলাদেশের বাজারে মুক্তি দেয় এসকে মুভিজ। এরপর এদেশের শীর্ষ প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজের আশ্রয়ে ছবি নির্মাণ শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। রোমিও ভার্সেস জুলিয়েট, ‘অগ্নি-২’ ‘আশিকী’ ছবি তিনটি জাজ-এসকের যৌথ-প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে।
যৌথ-প্রযোজনার ছবির ব্যাপারটি দর্শক গ্রহণ করলে আবারো হিন্দি ছবি চালানোর উদ্যোগ নেয় ইনউইন এন্টারপ্রাইজ। তারা ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি মুক্তি দেয় সালমান খান অভিনীত ‘ওয়ান্টেড’। এটি ২০১০ সালে এলসি করে আনা ছবিগুলোর একটি। যদিও ২০১১ সালে এই প্রতিষ্ঠানটি জোর, বদলা, সংগ্রামসহ বেশকিছু ভারতীয় বেশকিছু বাংলা ছবি প্রদর্শন করে। সেসময়ও প্রতিবাদের আওয়াজ উঠেছিলো।
তবে ‘ওয়ান্টেড’ মুক্তির কয়েকদিন আগে ২০১৫ সালের ২১ জানুয়ারি হিন্দি চলচ্চিত্র বন্ধের লক্ষ্যে পরিচালক সমিতি, শিল্পী সমিতিসহ প্রায় ১৯টি চলচ্চিত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত চলচ্চিত্র ঐক্য পরিষদ আবারো হিন্দি সিনেমা প্রতিরোধ করতে মাঠে নামে। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ জানুয়ারি কাফনের কাপড় পরে রাস্তায় নেমেছিলো পরিচালক-শিল্পীসহ চলচ্চিত্র ঐক্যসংগঠন। পরে তথ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করা হয়।
এতসব আন্দোলনের পরও থেমে নেই ভারত। যৌথ-প্রযোজনার নামে, নায়ক-নায়িকাকে বলিউড সিনেমায় সুযোগ করে দেওয়ার নাম করে এদেশের সিনেমা বাজার দখলের চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে তারা।
আর সর্বশেষ শোনা যাচ্ছে ভারতের এরস ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসছে। তারা গোপনে পথ হাঁটছে বলেও জানা গেছে। এদের পরিকল্পনায় রয়েছে- প্রথমে তারা বাংলাদেশের পরিচালক দিয়ে বাংলা ছবি নির্মাণ করবে। পাশাপাশি পুরো দেশে নির্মাণ করবে প্রেক্ষাগৃহ। এ লক্ষ্যে তারা বাংলাদেশের প্রভাবশালী ১৬ জন পরিচালকের নামও লিপিবদ্ধ করেছে। প্রাথমিকভাবে চারজন পরিচালককে দিয়ে সিনেমা নির্মাণ শুরু করবে বলেও একটি সূত্রে জানা গেছে।
শুধু এরস নয়, ভারতের আরও বেশকিছু প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। অবশ্য ইতিমধ্যেই জিরোনা বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান মিউজিক নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা এদেশে সিনেমাও নির্মাণ করবে বলেও জানা গেছে।
এবার আসি শুরুর গল্পে। এ প্রতিবেদন লেখা শেষ হওয়ার আগেই তথ্যমন্ত্রণালয়ে শেষ হয়েছে রমেশ ও মুকেশের মিটিং। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান।
তিনি জানিয়েছেন, রমেশ ও মুকেশ এদেশে সিনেমা আমদানি রপ্তানি করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে সোহান বলেন, ‘না। আমরা এই মুহূর্তে তাদের প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি না। কারণ আমরা জানিয়েছি তাদের ছবির সঙ্গে প্রতিযোগীতা করার মতো সামর্থ্য এখনো আমরা অর্জন করি নাই।’
সোহানের এ বক্তব্য অনেকটা আশার কথা হলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের উচ্চ পর্যায় কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে তা বলা যায় না। আর হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে লিঁয়াজো করার পেছনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নামই শোনা যাচ্ছে। এসব গুঞ্জন যদি সত্যি হয় তাহলে ভারতের উদ্যোগ বাস্তবে পরিণত হতে এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
এ বিষয়ে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারি-অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার বলেন, ‘হিন্দি ছবি আমদানির ফলে এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে ধ্বংসের পায়তারা করা হচ্ছে। আর তাদের ছবির সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো যোগ্যতা এখনো আমাদের ছবি অর্জন করেনি। চলচ্চিত্র আমদানি করে কখনো চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা করা যায় না।’
ভারতীয় ছবি এলে এদেশের ছবি উন্নতি করবে, শিল্পী বিনিময় হলে লাভবান হবে দেশ-এমন ধারণাকেও বিভ্রান্তিমুলক দাবী করে তিনি বলেন, ‘এটা সম্ভব নয়, ভারত ছবি রপ্তানি করবে ব্যবসা করার জন্য।এতে করে আমাদের কোনো লাভ নেই। আর দেশের ছবির উন্নতি করতে হলে নিজেদের টাকায় নিজেদের মেধা দিয়েই করতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশেই অন্যের উপর নির্ভর করে কোন চলচ্চিত্র উন্নতি করতে পারেনি। আর শিল্পী বিনিময়ের ফলে শিল্পীর লাভ হলেও চলচ্চিত্র শিল্পের কোনো লাভ নেই। আর বলিউডে অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভাব নেই, নুসরাত ফারিয়া বা পরী মনি এদেশের প্রতিনিধিত্ব করার মতো ক্ষমতাও রাখে না।এটাকেও একটা ভারতীয় ষড়যন্ত্রই বলবো।’
ফলে ভারতীয় ছবি এদেশে আমদানির ফলে ধ্বংসপ্রায় ঢালিউডের নাম নিশানাও যে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না তা হলফ করেই বলা যায়। দুঃস্থ হয়ে পড়বে অগণিত কলাকৌশলি। একটি ছোট্ট উদাহরণ দিলেই সহজে বুঝে যাবেন- ডিজিটাল চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু করার পর সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রায় দেড় থেকে দুইশো মানুষ এখন বেকার ও মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তারা সিনেমার রিল বহন করার কাজ করতেন। আর হিন্দি ছবির আমদানির ফলে এ সংখ্যা পেরিয়ে যাবে কয়েক হাজারে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কপালে কি ঘটে তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন। প্রিয় নিউজ
৬ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ