রবিবার, ০১ নভেম্বর, ২০১৫, ১১:৩৮:১৩

‘আয়নাতে মুখ দেখব না’

‘আয়নাতে মুখ দেখব না’

আবুল হায়াত : আয়নাতে কে না মুখ দেখতে চায়। চেহারা ভালো হোক কিংবা খারাপ। সবাই দাঁড়ায় আয়নার সামনে। ভালো চেহারার মানুষ একধরনের গর্ববোধ করে। নিজের সুন্দর সুরতের জন্য। যার কোনো কৃতিত্বই তার নয়। আর অসুন্দর যারা, তারা হয়তোবা সৃষ্টিকর্তার কাছে জানায় অভিযোগ কেন তাদের করা হয়নি সুন্দর! তবে আয়নায় সবারই মূল কাজটা হলো রূপচর্চা বা প্রসাধন করা। কেউ কেউ শুনেছি ঘুম থেকে উঠেই দাঁড়ান আয়নার সামনে, দিন শেষে বিছানায় যাওয়ার আগে শেষ সাক্ষাৎটাও সারেন আয়নার প্রতিচ্ছবির সঙ্গে। অনেককে দেখেছি, আয়নার প্রতিবিম্বের সঙ্গে কথাও বলেন। পাকিস্তান আমলে একটা চলচ্চিত্র দেখেছিলাম রঙিলা। এর লেখক, পরিচালক ও নায়ক ছিলেন স্বয়ং ‘রঙিলা’ নামের কমেডি অভিনেতা। তিনি প্রথম দৃশ্যেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ঘোড়ে য্যায়সে চেহারা!’ অর্থাৎ ঘোড়ার মতো চেহারা! তারপর শুরু হয় নানা রঙ্গতামাশা। প্রায় ২০০ বছর আগে জার্মানিতে শুরু হয়েছিল আজকের আমাদের অতিপরিচিত আয়না তৈরি। ১৮৩৫ সালে জার্মান রসায়নবিদ ইয়োস্টুস ফন লিবেহ এক পরিষ্কার সমতল কাচের এক পিঠে পাতলা ধাতব রুপার লেপ দিয়ে তৈরি করেছিলেন আয়না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাবন হলেও প্রকৃতপক্ষে আয়নার আবির্ভাব অনেক অনেক দিন আগে। একটা গবেষণা বলছে, প্রায় আট হাজার বছর আগে আনাতোলিয়ার (বর্তমান তুরস্ক) জনগণ আয়না তৈরি করেছিল। চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় (ইরাক) এবং হাজার খানেক বছর আগে মধ্য আমেরিকা, চীন, ভারতেও নানা উপায়ে আয়না বানিয়ে তার ব্যবহারের চল ছিল বলে জানা যায়। সবকিছুর পরও বলতে হবে, প্রথম আয়না আমরা পেয়েছি প্রকৃতিতেই। শান্ত জলাধারই আয়নার কাজ করে আসছে সৃষ্টির আদি থেকে। নার্সিসাসের গল্প তো আমাদের প্রায় সবারই জানা। পানিতে নিজের চেহারা দেখে তার প্রেমে পড়ে ভদ্রলোক নাস্তানাবুদ। আসলে আয়নাটা কী? আয়না হলো এমন এক বস্তু, যা থেকে ঠিকরে পড়া আলো। আপতিত আলোর মোটামুটি সব প্রাকৃতিক গুণাবলি ধারণ করে (এটা খুব সহজ একটা সংজ্ঞা বললাম। ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী)। আর এই কাজটা খুব ভালো করে সমানতল বিশিষ্ট কাচে ধাতব রুপার লেপ লাগানো আয়না। আয়না ছিল না বলে কি আয়না ব্যবহার পৃথিবীতে ছিল না? ছিল, অবশ্যই ছিল। ২১২ খ্রিষ্টপূর্বে আর্কিমিডিসের তৈরি দৈত্যাকার আয়না দিয়ে রোমানদের যুদ্ধজাহাজে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গ্রিক পুরাণে দেখা যায়, একটি দানবের অস্তিত্ব ছিল, যার সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময়েই মৃত্যু অবধারিত। সেই দানবকে হত্যা করেন বীর পারসিয়াস, তাঁর চকচকে বর্মে প্রতিফলিত বিম্ব দেখে। এসব আয়না বেশির ভাগ তৈরি হতো পাথর ঘষে বা বিভিন্ন রকমের ধাতব বস্তু ঘষে। তুরস্কের যে ইতিহাস পাওয়া যায়, তাতে বলছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে কাচের মতো স্বচ্ছ পদার্থ নির্গত হয়ে কঠিন পদার্থে পরিণত হলে তা দিয়ে আয়না তৈরি করা হতো। আয়নার ব্যবহারের সীমা-পরিসীমা নেই। অবতল, উত্তল আয়না ব্যবহৃত হয় গাড়িতে, ক্যামেরা, টেলিস্কোপ, পেরিস্কোপসহ বিভিন্ন রকম বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতিতেও এর ব্যবহার প্রচুর। সোলার শক্তি প্ল্যান্টেও এর ব্যবহার অনিবার্য। ছোটবেলায় চট্টগ্রামের পোলো গ্রাউন্ড মাঠে কমলা সার্কেলের প্যান্ডেলের ভেতর আমরা বিভিন্ন ধরনের আয়না দেখেছিলাম বীভৎস সব প্রতিবিম্ব দেখা যেত তাতে। পাকিস্তান-ভারতের ক্রিকেট খেলাতেও একসময় দর্শকদের আয়নার সাহায্যে ব্যাটসম্যানের চোখে আলো ঠিকরে দিয়ে তাকে বিচলিত করতে দেখেছি আমরা। বাড়িতে আয়না নেই এমন উদাহরণ সম্ভবত মিলবে না। এবার মুর্শিদাবাদে জগৎ শেঠের বাড়ির জাদুঘরে দেখলাম, তার বাসভবনের এক কক্ষে তার ব্যবহৃত একটি আয়না, একে জাদুর আয়না নাম দেওয়া হয়েছে (ম্যাজিক মিরর)। জাদুটা কী? এই আয়নার সামনে দাঁড়ালে আপনি আপনার সমস্ত শরীর দেখতে পাবেন, কিন্তু ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যাবে না। কথাটা সত্যি। কারণ, আমি নিজেই দেখলাম—আমার পাশে দাঁড়ানো স্ত্রীকে পুরোটা দেখতে পেলেও আমার ওপরের অংশ দেখা যাচ্ছে না। শিরীনও তা-ই বলল, সে আমাকে পুরো দেখেছে, কিন্তু নিজের ঘাড় থেকে ওপরের অংশ দেখেনি আয়নায়। জগৎ শেঠ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার আমলের সবচেয়ে বড় সুদখোর। শুধু ভারত নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সুদের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। আরও বিখ্যাত হন রবার্ট ক্লাইভ ও মীর জাফর আলী খানের সঙ্গে সিরাজকে খতম করার ষড়যন্ত্রের অন্যতম শরিক হিসেবে। তার ঘরে কেন এই জাদুর আয়না ছিল? আমার ধারণা, যারা পাপ কর্ম করেন, তাদেরও শরম বলে একটা পদার্থ কানাকড়ি পরিমাণ হলেও থাকে। সে কারণেই নিজের চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা ও ঘৃণা বোধ হতো বলেই হয়তো এই আয়না ব্যবহার করতেন জগৎ শেঠ। আমার বিশ্বাস, বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু মানুষের বাড়িতেও হয়তো এমন আয়না আছে। আমরা জানি না। তা না হলে।-আমাদের সময় আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব। ১লা নভেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/মাহমুদ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে