নিউজ ডেস্ক: ‘মোরা এক ঘাটেতে রান্দি-বাড়ি, মোরা আরেক ঘাটে খাই, মোদের সুখের সীমা নাই, পথে-ঘাটে ঘুরে মোরা সাপখেলা দেখাই, মোদের ঘরবাড়ি নাই।’ বিখ্যাত সুরকার আবু তাহেরের এ গানের মাঝে ভেসে ওঠে বেদে সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র। তাদের ঘরবাড়ি নেই, মাথার ওপর ছাদ নেই, নেই সামাজিক সম্মান। তারা নিরন্তর ঘুরে বেড়ায়, রক্তেই যেন ঘুরে বেড়ানোর নেশা।
জীবনের টানে যেমন তারা বন্ধনে জড়ায়, আবার সেই তাড়নায়ই বাঁধন কেটে দেয় অবলীলায়। কোনো রকমে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেই মুক্তি পান কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা। বেদে জীবনের এ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান। তারই এক সফলতার ধাপ পার হয়েছে শুক্রবার।
বাবার দায়িত্ব নিয়ে কন্যা সম্প্রদান করলেন তিনি। তাই তো শুক্রবার সাভারের পোড়াবাড়ী গ্রামের বেদেপল্লীতে ছিল অন্যরকম উৎসব। সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে পশ্চিমে ৩০ মিনিট হাঁটলেই বেদেপাড়া। গ্রামের ঈদগা মাঠে সকাল থেকে সাজসাজ রব। মাঠে বড় শামিয়ানা টানানো। বেদে পরিবারের তিন কন্যার বিয়ে উপলক্ষে পুরো গ্রামের চেহারাই পাল্টে যায়। গ্রামজুড়ে উৎসবের রঙ। চমৎকার ভবিষ্যতের স্বপ্নে বিভোর তিন তরুণী।
ভোর থেকেই সবার মনে বেজে চলেছে বিয়ের সানাই। গরু, মুরগির রেজালা, দই, ফিরনি, চিনিগুঁড়ো চালের পোলাওসহ ছিল নানা আয়োজন। পুরো গ্রামের মানুষের দাওয়াত। আসেন বাইরের অতিথিরাও। ছিলেন ঢাকা-১৯ আসনের এমপি ডা. এনামুর রহমান, ঢাকা-২০ আসনের এমপি আবদুল মালেক, পুলিশ সুপার শাহ মিজান শাফিউর রহমান, ঢাকা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, গাজীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাসেল শেখ, সাভার মডেল থানার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মাহাবুবুর রহামনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি।
বেদেপল্লীর তিন তরুণী মজিরন আক্তার (১৮), মাছেনা খাতুন (১৮) ও লিমা বিবির (১৯) বিয়ে হলো গতকাল শুক্রবার দুপুরে। বিয়ের কেনাকাটা থেকে কন্যাদান, অতিথি আপ্যায়ন, উপহার, সব আয়োজনই হয়েছে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধায়নে। বাবার হয়ে দায়িত্ব ও কর্তব্যের সব বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নেন এ কর্মকর্তা।
তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করারও ঘোষণা দেন তিনি। মেয়েগুলো যেন তারই! নববধূ মজিরন আক্তারের বাবা মোস্তাকিন মিয়া বলেন, ছিলাম কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা। অভাব-দারিদ্র্যের কারণে ন্যায়-অন্যায় ভুলতে বসেছিলাম। আজ প্রকৃত বাবার দায়িত্ব পালন করছেন পুলিশ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান।
আজ থেকে তিন বছর আগে মেয়ের বয়স যখন ১৫, তখনই চূড়ান্ত করা হয় বিয়ের সব আয়োজন। খবর পেয়ে ছুটে এলেন মহান এই ব্যক্তি (পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান) আমার আঙিনায়। বোঝালেন বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে। বললেন, বরকে যখন স্থিরই করে ফেলেছেন, দরকার নেই বিয়ে ভেঙে ফেলার। বয়স হোক। আমি নিজেই আয়োজন করে আপনার মেয়ের বিয়ে দেব। হলোও তাই। শুক্রবার তিনি নিজেই মেয়েকে তুলে দেন বরের হাতে।
লিমা বিবি আর মাছেনা খাতুনের গল্পগুলোও অভিন্ন। লিমা বিবির মা অভাবী বিবি। নামের উপযুক্ততা খুঁজে পাওয়া যায় পরিবারে। জীর্ণতার সঙ্গে ক্লিষ্টতাও আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে পরিবারটিকে। অভাবী বিবি বলেন, ‘জীবনে এত খুশি হই নাই। আইজ আমাগো জীবনে আনন্দের দিন। ঈদের মতো আনন্দ লাগতাছে। আমার মাইয়াডারে নিজের মাইয়া মনে কইরা হাবিব স্যার সব আয়োজন করছেন।’
তিন তরুণীর অপরজন হচ্ছেন মাছেনা খাতুন। আবেগে আপ্লুত তার পরিবার। আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে মাছেনার মা বলেন, ‘হাবিব স্যারের মতো মানুষ অয় না। ভালো ভালো কথা তো অনেকেই কয়। কাজের সুমায় কাউকে পাওয়া যায় না। আমরা বিপদের সময় এই মহান মানুষটিকেই পাই। সেই আমাদের অভিভাবক।’
গোটা আয়োজনের নেপথ্যে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি হাবিবুর রহমান জানান, বেদেরাও তো মানুষ। ওরা হয়তো না বুঝেই অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। আমাদের দায়িত্ব ওদের বোঝানো। ওদের বিয়ে দিতে পেরে আমি আনন্দিত। ওরা সবাই আমার মেয়ের মতো।
কথা হয় মজিরন আক্তারের বর ছাদ্দাম হোসেনের (২২) সঙ্গে। তিনি বলেন, বিষয়টি ভাবলেই ভীষণ রোমাঞ্চিত হচ্ছি। এটা জীবনের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। রীতিমতো অন্ধকার ঘুচিয়ে আলোর ফোয়ারা ছুটছে বেদেপল্লীতে। ভালোবাসার অভূতপূর্ব জোয়ারে ভেসে গেছে সাভারের বেদেপল্লীর অন্ধকার। প্রত্যেকের জীবনে এখন ঝলমলে আলোর হাতছানি।
হাবিবুর রহমান ঢাকার পুলিশ সুপার থাকাকালে বেদেদের জীবনমান উন্নয়নে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তার হাত ধরেই বদলে যেতে শুরু করে বেদেপল্লী। বেদেপল্লীর দেড়শ’ কিশোরী ও নারীকে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের জন্য গড়ে তোলা হলো উত্তরণ নামের তৈরি পোশাক কারখানা। এ কারখানাই এখন ঘুরিয়ে দিয়েছে এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাকা।-সমকাল
০৮ অক্টোবর,২০১৬/এমটি নিউজ২৪ ডটকম/সবুজ/এসএ