মঙ্গলবার, ০৪ এপ্রিল, ২০১৭, ০৬:২৭:২৪

বিদেশি সাংবাদিকের চোখে বাংলাদেশের জঙ্গি বিরোধী অভিযান

বিদেশি সাংবাদিকের চোখে বাংলাদেশের জঙ্গি বিরোধী অভিযান

ঢাকা : সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি বড় আকারের জঙ্গি বিরোধী অভিযান চালানো হয়েছে। অনেকে ভেবেছিলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর জোরালো অভিযানের কারণে জঙ্গিরা হয়তো কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। কিন্তু এ লড়াইয়ে কে জিতছে? ভারতের সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক সে বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন। খবর বিবিসির।

গত সপ্তাহের প্রথম দিকে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব জেলা সিলেটে চার জন সন্দেহভাজন জঙ্গি নিহত হয়। বেশ লম্বা সময় ধরে চলে সেই অভিযান। দুই দিন পর পাশের জেলা মৌলভীবাজারে একটি জঙ্গি আস্তনায় আরেকটি অভিযান পরিচালনার সময় সাত জনের ছ্ন্নি-বিচ্ছিন্ন দেহ পাওয়া যায়।

ঢাকা এবং এর আশপাশের এলাকায় কয়েকটি 'আত্মঘাতী' বোমা বিস্ফোরণের পর এ অভিযানগুলো পরিচালিত হয়। আত্মঘাতী হামলার বিষয়টি বাংলাদেশে খুবই বিরল। সুতরাং জঙ্গিদের কৌশলেও পরিবর্তন এসেছে বলে মনে হচ্ছে, যা আশঙ্কাজনক।

"আত্মঘাতী হামলা যে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তাতে কোন সন্দেহ নেই," বলছিলেন জয়দীপ সাইকিয়া - যিনি ভারত ও বাংলাদেশর সন্ত্রাসবাদ নিয়ে বইও লিখেছেন। তিনি মনে করেন, আত্মঘাতী হামলার এ প্রবণতা দক্ষিণ এশিয়ার পূর্ব অংশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

মৌলভীবাজারের একটি বাড়িতে ঢুকে বীভৎসতার যে চিত্র পুলিশ দেখেছে, সেটি অনেককেই স্তম্ভিত করেছে। বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার-টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলামের বর্ণনায়, "জঙ্গিরা তাদের স্ত্রী এবং ছোট বাচ্চাদের সাথে নিয়ে নিজেদের বিস্ফোরণের মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়।"

বাংলাদেশে আত্মঘাতী বিস্ফোরণের প্রবণতা শুরু হয় গত ২৪শে ডিসেম্বর। ঢাকায় একটি অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশের হাতে ধরা না পড়ার লক্ষ্যে একজন নারী নিজেকে উড়িয়ে দেন। এরপর ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় তিনটি ব্যর্থ আত্মঘাতী হামলার চেষ্টা হয়। এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিচলিত হয়ে পুলিশ দেশজুড়ে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে।

সিলেটে জঙ্গি-বিরোধী মূল অভিযানটি পরিচালনা করে সেনাবাহিনী। যে বাড়িটিতে অভিযান চালানো হয়, সেখান থেকে অনেক বাসিন্দাকে নিরাপদে উদ্ধারও করা হয়। ঐ অভিযান শেষ হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মৌলভীবাজার ও কুমিল্লা জেলায় আরো দু'টি বাড়ি ঘেরাও করে পুলিশ।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জঙ্গিরা এখন ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। সিলেটে যখন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছিল, তখন মূল ঘটনাস্থল থেকে দূরে আরেকটি জায়গায় হামলার মাধ্যমে কৌশলগত দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা করে জঙ্গিরা।

মৌলভীবাজারে জঙ্গিরা পুলিশের হাতে ধরা না দিয়ে নিজেদেরকে উড়িয়ে দেয়। আর কুমিল্লায় স্থানীয় নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর বিষয়ে দুই ধরনের মতামত দেখা যায়।

কেউ কেউ মনে করেন যে এ ধরনের আত্মঘাতী বিস্ফোরণের মাধ্যমে বোঝা যায় জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, এ ধরনের ঘটনার মাধ্যমে জঙ্গিরা নিজেদেরকে সাহসী বলে প্রমাণ করতে চাইছে, যাতে তাদের অনুগতরা সেটা অনুসরণ করতে পারে।

"জঙ্গিরা এখন বেপরোয়া এবং পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের ধরার চেষ্টা করছে," বলছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনে করেন আত্মঘাতী বিস্ফোরণ জঙ্গিদের বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ হতে পারে।

বাংলাদেশের সরকার বরাবরই বলছে যে এসব জঙ্গি হামলার সাথে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট এবং আল কায়েদার সাথে কোন সম্পর্ক নেই। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য অভ্যন্তরীণ নিষিদ্ধ ইসলামপন্থী সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশকে দায়ী করছে সরকার।

কিন্তু অনেকেই বিষয়গুলোতে অশনি সংকেত দেখছেন। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত গবেষক এবং বিশ্লেষক তাজ হাশমী বলেন, "এখানে আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। সন্ত্রাসবাদ আরো বেশি শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে।"

তবে যেভাবে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করা হচ্ছে, তা নিয়েও উদ্বেগ আছে। সাবেক বাংলাদেশী কূটনীতিক ফারুক সোবহান মনে করেন, বাংলাদেশে যেভাবে জঙ্গিদের মোকাবেলা করছে, সেটা এখনও পর্যন্ত অনেকটাই সফল হয়েছে - কারণ অভিযানগুলো ধারাবাহিকভাবে চলছে। মি: সোবহান মনে করেন, যেসব কারণে উগ্রপন্থার সৃষ্টি হয় সেগুলোকে দূর করতে হবে।

গত বছর গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলায় ২০ জনকে হত্যা করা হয়েছিল - যাদের বেশিরভাগই বিদেশী নাগরিক। হলি আর্টিজানের ঐ হামলাকে অনেকেই 'বাংলাদেশর ১/১১' হিসেবে বর্ণনা করেন। গুলশানের হামলার আগে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার, লেখক এবং প্রকাশকদের উপর একের পর এক হামলা হয়।

বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী বলছে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে শীর্ষ আট জন জঙ্গি নেতা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন জেএমবি'র তামিম চৌধুরী, তানভীর কাদেরী ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম।

বিভিন্ন অভিযানে আরো কিছু সিনিয়র এবং মধ্যম-সারির নেতা-কর্মী হয় ধরা পড়েছে, নতুবা মারা গেছে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গিবাদ হয়তো নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু আত্মঘাতী হামলাগুলো যখন শুরু হলো, তখন বাংলাদেশকে নতুন আরেকটি পরিস্থিতিতে নিয়ে আসলো - যার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মিল রয়েছে।

০৪ এপ্রিল ২০১৭/এমটি নিউজ২৪/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে