আদিত্য রিমন: রোদ, বৃষ্টি, ঝড় মাথায় নিয়ে রাস্তায় প্রতি শিফটে টানা আট ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দুই শিফটে রাজধানীতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে পুরুষ পুলিশের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করেন নারী ট্রাফিক পুলিশরাও। তবে দায়িত্ব পালনকালে প্রায়ই টয়লেট সমস্যায় পড়েন তারা। জরুরি ভিত্তিতে এ সমস্যার উত্তরণ চান তারা। নারী ট্রাফিক পুলিশদের এ সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। তারা বলছে, টয়লেট সমস্যা দূর করতে কাজ চলছে।
নারী ট্রাফিক পুলিশরা বলছেন, টানা আট ঘণ্টা রাস্তায় ডিউটি করতে হয়। এ সময় কম করে তিন বার টয়লেটে যেতে হয়। কিন্তু রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে নিয়োজিত পুলিশের জন্য টয়লেটের কোনও সুব্যবস্থা নেই। সরকারি অফিস, মার্কেট বা কারও বাড়িতে গিয়ে টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। রাতের বেলায় এ সুযোগ থাকে না। কারণ, বিকাল চারটার পর সরকারি অফিস, রাত আটটার পর মার্কেটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তখন আরও বেশি সমস্যায় পড়েন নারী ট্রাফিক পুলিশরা। আবার কেউ কেউ লজ্জার কারণে এসব টয়লেট ব্যবহার করেন না। তারা টানা আট ঘণ্টা ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে গিয়ে টয়লেট ব্যবহার করেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন সুস্থ মানুষ আট ঘণ্টায় কমপক্ষে দুই থেকে তিন বার টয়লেট ব্যবহার করেন। আর অসুস্থ হলে আরও বেশি টয়লেটে যেতে পারেন। শীতকালের তুলনায় গরমকালে এটা আরও বেশি হতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, ‘সুস্থ ব্যক্তির জন্য একরকম, আর অসুস্থ ব্যক্তির ক্ষেত্রে আরেক রকমের বাথরুম ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে। তবে একজন সুস্থ মানুষ আট ঘণ্টায় সাধারণত দুই থেকে তিন বার বাথরুম ব্যবহার করেন।’
রাজধানীর কাকরাইল মসজিদের মোড়ে কর্তব্যরত নারী সার্জেন্ট কাজল রেখা-২ এর সঙ্গে কথা হয়। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে। ডিএমপিতে কাজল রেখা নামে আরও একজন নারী সার্জেন্ট থাকায় তার নামের শেষে অফিসিয়ালি ‘২’ যুক্ত করা হয়েছে। তিনি জানান, রাস্তায় দায়িত্ব পালনের সময় পাশের জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবনের টয়লেট ব্যবহার করতে হয় তাদের। সন্ধ্যার পরে এই সরকারি অফিসটি বন্ধ থাকে। তখন টয়লেটের সমস্যায় পড়েন তারা। তিনি আরও জানান, জরুরি ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার।
কাজল রেখা-২ বলেন, ‘এর আগে রমনা থানা ও রূপসী বাংলা হোটেলের মোড়ে ডিউটি করেছি। তখন রমনা থানা ও ডিবি অফিসের টয়লেট ব্যবহার করতাম। প্রায় সময়ই এসব টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। কারণ, টয়লেটের চাবি যার কাছে, অনেক সময় তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রথম দিকে তিন-চার মাস লজ্জায় টয়লেট ব্যবহার না করেই অনেক কষ্টে ডিউটি করেছি।’
কাজল রেখা-২ এর সঙ্গে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করছেন ট্রাফিক কনস্টেবল আইরিন। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবনের টয়লেট ব্যবহার করি। শুক্র ও শনিবারসহ অনেক সময় ভবনটি বন্ধ থাকে। তখন আমাদের অনেক অসুবিধা হয়। কখনও সিকিউরিটি গার্ডদের সহযোগিতা নিয়ে টয়লেট ব্যবহার করতে হয়। ট্রাফিক পুলিশের জন্য আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা থাকলে ভালো হতো। দায়িত্ব পালনের জন্য সুবিধা হতো।’
রাজধানীর কলেজ গেট মোড়ে কথা হয় কর্তব্যরত নারী সার্জেন্ট ইসমত তারা’র সঙ্গে। দিনাজপুর সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করে পুলিশে চাকরি নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ প্রয়োজনে পাশের মার্কেটের টয়লেট ব্যবহার করি। কিন্তু অনেক সময় সমস্যায় পড়তে হয়। টয়লেট সমস্যার বিষয়টি আমাদের মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। স্যাররা বলেছেন, তারা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন।’ ইসমত তারা মনে করেন, দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। ট্রাফিক পুলিশের জন্য নির্ধারিত টয়লেট থাকা খুবই দরকার।
নারী ট্রাফিক পুলিশরা আরও বলেছেন, মাসের নির্ধারিত কয়েকটি দিন ঋতু চলাকালে মার্কেট কিংবা অন্যকোনও অফিসের টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে খুবই লজ্জায় পড়তে হয়। এসব কারণে নারী পুলিশদের জন্য অব্যশই নির্ধারিত টয়লেট থাকা দরকার বলে মনে করেন তারা।
টয়লেট সমস্যার কারণে পুরুষ সহকর্মীর মতো সব জায়গায় ডিউটি করতে পারছেন নারী ট্রাফিক পুলিশরা। পুলিশ বুথ বা ডিউটি স্থানের আশপাশে টয়লেট ব্যবস্থা থাকলে নারী ট্রাফিক পুলিশরা রাজধানীর যে কোনও জায়গায় কাজ করতে পারতেন।
রাজধানীর হাতিরঝিলে কর্তব্যরত নারী সার্জেন্ট পান্না আক্তারের সঙ্গে কথা হয়। পান্না আক্তারের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায়। ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষ করে পুলিশে যোগ দেন তিনি। পান্না বলেন, ‘হাতিরঝিলে পুলিশের নিজস্ব একটি টয়লেট রয়েছে। এ কারণে এখানে কোনও সমস্যা হয় না। তবে আমি চাই, সব জায়গাতে টয়লেটের ব্যবস্থা করা হোক। টয়লেটের সুবিধা থাকলে আমরা পুরুষ সহকর্মীর মতো সব জায়গায় ডিউটি করতে পারতাম। তখন আর নির্দিষ্ট জায়গায় দায়িত্ব পালন করতে হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়- আমরাও পারি। সব জায়গায়তে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে আমরা এ পেশায় এসেছি। নারী সার্জেন্ট দেখে অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু এসব আমরা পাত্তা দেই না। আমরা আমাদের কাজ করি।’
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘এ সমস্যাটি আমরাও উপলব্ধি করছি। টয়লেট সমস্যা দূর করার কাজ চলছে।’
পুলিশ বাহিনীতে নারী সার্জেন্ট নিয়োগ-প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালে। সর্বশেষ সার্জেন্ট পদে নিয়োগের পরীক্ষায় অংশ নেন এক হাজার ৮৩৭ জন । এর মধ্যে নারী প্রার্থী ছিলেন ৪৬ জন। সব প্রক্রিয়া শেষে নিয়োগ পান ২৮ জন। তারা রাজশাহীর সারদায় বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ শেষ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশে। অন্যদিকে, হাইওয়ে পুলিশে দুজন, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দু’জন এবং খুলনা মেট্রোতে দুজন নারী দায়িত্ব পালন করছেন।-বাংলা ট্রিবিউন
এমটিনিউজ২৪.কম/টিটি/পিএস