উদিসা ইসলাম : ‘হলের নানা সমস্যা নিয়ে যারা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে চেয়ে আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন তাদেরকেই নির্বাচিত করা হয়েছে। আমরা নিজেরা শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে আগামীতে কী করতে চাই, সেটি নিয়ে আলাপ করেছি। আলোচনা একপাক্ষিক না হয়ে অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্রদের প্রতি আস্থা দেখিয়েছে।’ সোমবার (১১ মার্চ) অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে বিজয়ী হওয়া বিভিন্ন হলের ভিপি ও জিএসরা এসব কথা বলেছেন। অবশ্য, ছাত্রদের হলে জয় পাওয়া ভিপি ও জিএস স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও তারা মূলত ছাত্রলীগেরই কর্মী। মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েই তারা হলের শিক্ষার্থীদের অনুরোধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন এবং বিজয়ী হয়ে আবারও মূল দলে ফেরার ইচ্ছা পোষণ করেছেন।
তবে নির্বাচিতদের সবাই মনে করেন, একবছর খুবই কম সময়। সে কারণে তৎপর থাকতে হবে। স্বতন্ত্র হওয়ার পরেও আস্থা রেখে শিক্ষার্থীরা তাদের বেছে নেওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করে দেখাতে চেয়েছেন এসব স্বতন্ত্র ভিপি-জিএস।
২৮ বছর ১০ মাস পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ৫টি ছাত্রী হলের ৪টিরই ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। ৩টিতে জিএস পদেও জিতেছেন এসব স্বতন্ত্র প্রার্থী। শামসুন্নাহার, কবি সুফিয়া কামাল ও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী- এই তিনটি হলেই ভিপি-জিএস উভয় পদেই জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্যানেলের প্রার্থীরা। এছাড়াও ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের ভিপি পদটিও জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী রিকি হায়দার আশা। এসব হলের এজিএসসহ অন্যান্য পদেও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেকে জয়ী হয়েছেন। আর ছাত্রদের অবশিষ্ট ১২টি হলের মধ্যে অমর একুশে হল ও ফজলুল হক হলে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। এরা হচ্ছেন মেহেদী হাসান সুমন ও মাহমুদুল হাসান তমাল। এর বাইরে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের জিএস পদে জয় পেয়েছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী তৌফিকুল ইসলাম। বাকি হলগুলোর ভিপি-জিএসসহ সিংহভাগ পদে ছাত্রলীগ মনোনীত প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন।
স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের সহসভাপতি রিকি হায়দার আশা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাকে আমার হলের আপুরা এতোটা ভরসায় রাখবেন আমি আন্দাজ করিনি। কিন্তু তাদের প্রতি আমার ভরসা ছিল। তারা যে আমাকে বিশ্বাস করেছেন সেই বিশ্বাসের প্রতিদান আমি আগামী একবছরে কাজের মধ্য দিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেন, এই জয় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের জয়। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা একসঙ্গে হতে পেরেছিলেন বলেই ভোটে কোনও ব্যত্যয় ঘটে নাই। আস্থাটাই আসল সম্পদ।’
বেগম সুফিয়া কামাল হলের নির্বাচিত ভিপি তানজিনা আক্তার সুমা বলেন, ‘আমাদের হলের আপুরা আমাকে কয়েকবছর ধরে চেনেন। তারা জানেন, আমি কতটুকু করতে পারি এবং নির্বাচনের আগে একাধিকবার আমি সবার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করে সেই অনুযায়ী ইশতেহার প্রস্তুত করেছি যাতে এই সংসদ যে তাদের জন্যই এই বোধ তাদের মধ্যে কাজ করে। আমাকে যারা আস্থায় নিয়েছেন তারা নিজেরা দাঁড়িয়ে থেকে ভোট গণনায় কোনও কারচুপি যেন না হয় তা নিশ্চিত করেছেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
এতদিন পর নির্বাচন এবং সেই সংসদের নেতৃত্বে আসা গর্বের বলে মনে করেন এই হলের স্বতন্ত্র হিসেবে জয়ী জিএস মুনিরা শারমিন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাতজনের প্যানেল ছিল। এর বাইরে যে কয়জন সদস্য অন্য সংগঠনের তাদের সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে আমরা কিছু একটা করার চেষ্টা করবো। একসঙ্গে হওয়ার কোনও বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের হল সংসদ নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) পাঁচ পদে জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এই হলে ভিপি হয়েছেন সুস্মিতা কুণ্ডু, জিএস হয়েছেন সাগুফতা বুশরা। সুস্মিতা কুণ্ডু বলেন, ‘আবাসিক অনাবাসিক মেয়ে আছে। তাদের প্রতি আমার দায়িত্ব কর্তব্য আছে সেটা পালন করতে চাই। মানুষের যে ভালবাসা আমি দেখেছি তা বলার মতো নয়। হলের গণরুমের মেয়েরা কী চায়, তাদের সমস্যাগুলো কী সেগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা। আর হল প্রশাসনের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া দরকার সেটি দেখবো। সাত জনের একটি স্বতন্ত্র প্যানেল ছিল আমরা পাঁচজন জিতেছি।’
শামসুন্নাহার হলের ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন শেখ তাসনীম আফরোজ ইমি, জিএস পদে আফসানা ছপা। ছাত্রলীগের প্যানেলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়াই করে ১০৭৬ ভোট পেয়ে জয়ী হওয়া ইমি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘আমার প্রতি আস্থার জায়গা থেকে তারা আমাকে বিজয়ী করে নিয়ে আসবেন এই আকাঙ্ক্ষা আমার ছিল। ভুলে গেলে চলবে না এই জয় সহজ ছিল না, তবে জয় কাঙ্ক্ষিত ছিল। জয় বের করে আনতে প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নির্বাচনে বিপরীতে শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। এছাড়া আরও অনেক শঙ্কাও ছিল। সব ছাপিয়ে আমাদের কর্মী সমর্থকরা আমার হলের প্রিয় আপুরা রাত জেগে ব্যালট বাক্সসহ ভোটের কক্ষ পাহারা দিয়েছেন। কোনও ধরনের অনিয়ম হয় কিনা তা সারাক্ষণ চোখে চোখে রেখেছেন। আমাদের হলে কোনও অপ্রীতিকর কিছু করা সম্ভব হয়নি।
‘শুধু ভালোবাসা’ শিরোনামের ইশতেহারে নির্বাচন করে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের জিএস পদে জয় পেয়েছেন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী তৌফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি ছাত্রলীগের হল কমিটির উপক্রীড়া সম্পাদক ছিলাম। আমি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ফিরে আসবো। স্বতন্ত্র হিসেবে কেন নির্বাচন করলেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জনপ্রিয়তা থাকার পরেও মনোনয়ন পাইনি। আর বাবা মায়ের ইচ্ছার জন্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। সে কারণে আমি সব শিক্ষার্থীর আবেগটা বুঝবো। ওদের সঙ্গে থেকে ভাই হিসেবে কাজ করবো।’
অমর একুশে হলের নির্বাচিত ভিপি মেহেদী হাসান সুমন হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তারপরও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছেন। কেন স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, যাকে ভিপি পোস্টে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল তিনি কোনোদিন হলে রাজনীতি করেননি। আমার মনে হয়েছিল নির্বাচনটা করতে পারবে না। তাই বন্ধুরা মিলে আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। জয় ছিনিয়ে আনতে পারবো বলেই আমাকে দাঁড় করিয়েছিল সবাই মিলে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জয়লাভের অনুভূতি ভালো। স্বচ্ছ নির্বাচন হয়েছে, জয় পেতে আমরা অনেক কাজ করেছি। আগামীতেও সেটা করবো।’-বাংলা ট্রিবিউন