দিনাজপুর : সেই গল্পটি মনে আছে? বাদশাহ সোলেমানের দরবারে এক সন্তান নিয়ে হাজির দুই মা। শেষে বাদশাহ সন্তানকে কেটে দুই টুকরা করে দুজনকে ভাগ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাধা দিয়েছিলেন এক মা। তাঁকেই প্রকৃত মা সাব্যস্ত করেছিলেন বাদশাহ। কালের পরিক্রমায় এবার এক সন্তানকে কাছে রাখতে দুই মায়ের আকুতি।
একজন জন্মদাত্রী, আরেকজন পালক। দ্বিতীয়জন পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে চেতনা হারিয়েছেন। প্রথমজন আইনের শক্তিতে দৃঢ়। পালক বাবা যখন পাঁচ মাসের সন্তানকে জন্মদাত্রীর কোলে তুলে দেন তখন হু হু করে কেঁদে ওঠেন। গত শনিবার রাতে এই কান্নার সাক্ষী থেকেছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী থানার সব পুলিশ সদস্য। তাঁদের চোখেও জমেছিল পানি। কিন্তু আবেগকে বাড়তে দেয়নি আইন।
পুলিশ সূত্র জানায়, বিয়ের ১৩ বছর পার হলেও সন্তানের মুখ দেখতে পাননি ফুলবাড়ী দাদুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আশরাফুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী কাজিহাল ডাঙ্গা ফাজিল মাদরাসার প্রভাষিকা কল্পনা বেগম। এই দম্পতি ঠিক করেন তাঁরা সন্তান দত্তক নেবেন। এরই মধ্যে তাঁদের আত্মীয় পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য পরিদর্শক ডা. রোকেয়া বেগম একটি কন্যাসন্তান দত্তক দেওয়ার প্রস্তাব দেন। খবর পেয়ে সেদিনই তাঁরা যান এবং সদ্য ভূমিষ্ঠ কন্যাকে মৌখিকভাবে দত্তক নেন।
সন্তানকে ভালোবাসার জন্য যে মমতাগুলো তাঁদের গচ্ছিত ছিল, তা দিয়ে কন্যাটিকে লালন-পালন করতে থাকেন। এক দিনের শিশু নিয়ে এসে পাঁচ মাস বুকে জড়িয়ে ধরে মানুষ করতে থাকেন। তাঁদের পরিবারেও আসে স্বস্তি।
এদিকে হঠাৎ করে শিশুটিকে ফিরিয়ে নিতে আসেন শিশুটির মা পাঁচবিবি উপজেলার বালুঘাট গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেনের কন্যা মারুফা আক্তার (২৪)। বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেন শিক্ষক দম্পতি। খোঁজ নিয়ে দেখেন যে মারুফা সত্যি শিশুর মা। তার পরও মায়া-মমতায় জড়িয়ে পড়ায় শিশুটিকে ফেরত দিতে অস্বীকার করেন শিক্ষক দম্পতি। মারুফা কন্যাকে জোর করে আটক রাখা হয়েছে দাবি করে ফুলবাড়ী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন। সেই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে থানার পরিদর্শক শেখ নাসিম হাবিব উভয়কে ডেকে নিয়ে আলোচনা করেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় শিশু আসফিয়া জান্নাতকে তার জন্মদাত্রী মায়ের কাছে হস্তান্তর করেন।
সন্তানকে ফেরতে দিতে গিয়ে দত্তক মা কল্পনা বেগম থানার ভেতরেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ফুলবাড়ী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দত্তক বাবা শিশুকন্যাকে কাছে রাখার বিনিময়ে জন্মদাত্রীকে পাঁচ লাখ টাকা দিতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু মা তা নিতে চাননি। তিনি সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি চলে যান।
বাড়ি চলে যাওয়ার আগে মারুফা আক্তার জানান, ঢাকায় পড়ালেখা করার সময় খুলনা জেলার মাহিবুল তরফদার নামে একজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পরিবারকে না জানিয়ে তাঁকে বিয়ে করেন। এরপর মাহিবুলের বাসায় গিয়ে দেখেন তাঁর আগের স্ত্রী-সন্তান রয়েছে। প্রতারণা করায় তিনি সেখান থেকে বাবার বাড়িতে চলে আসেন। তখন তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলে ভ্রূণ নষ্ট করার জন্য ডা. রোকেয়া বেগমের কাছে যান। চিকিৎসক জানান, পাঁচ মাসের ভ্রূণ নষ্ট করা সম্ভব নয়। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে চিকিৎসককে বলেন, সন্তানটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যদি কোনো ভালো পরিবার পান, তাহলে তাকে দত্তক দিয়েন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তা-ই করা হয়। কিন্তু এখন মা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সন্তানকে ফেরত চান।