উৎপল রায় : প্রাণকৃষ্ণ সরকার (৩৮)। জীবিকার তাগিদে প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকার দোহার থেকে যান টঙ্গীতে। যোগ দিয়েছিলেন টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরী এলাকার অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানা টাম্পাকোয়। চলতি সময়ে কাজ করছিলেন সিনিয়র প্রিন্টিং অপারেটর হিসেবে।
কারখানার পাশেই স্ত্রী অঞ্জনা সরকার ও ৩ বছরের মেয়ে অপ্সরাকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি। কিছুটা অনটন থাকলেও সুখেই কাটছিল সংসার। কিন্তু শনিবার টাম্পাকো ট্র্যাজেডি এলোমেলো করে দিয়েছে এই পরিবারটিকে।
প্রাণকৃষ্ণ সরকার গুরুতর আহত হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১০২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৪ নম্বর বেডে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। গতকাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দুর্ঘটনায় ডান পা ভেঙে গেছে তার। বাম পায়েও গুরুতর জখম হয়েছে। দুই হাতের মাংস খুবলে গেছে। ঝলসে গেছে পিঠও। আঘাত পেয়েছেন মাথায়। সারা শরীরে কাচের টুকরোর অসংখ্য আঘাত। অন্যের সাহায্য ছাড়া উঠে বসতে পারেন না তিনি। ঘটনার ভয়াবয়তার কথা বলতে গিয়ে আঁতকে ওঠেন প্রাণকৃষ্ণ।
তিনি জানান, ভোর ৬টায় বাসা থেকে বেরিয়ে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলেন তিনি। কারখানার মূল গেট পার হতেই শুনতে পান গ্যাসের লাইন লিক করেছে। একটু দুনোমনায় পড়ে যান তিনি। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণ। পরে আর কিছুই মনে নেই তার। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন, হয়তো তিনি মারা যাচ্ছেন। প্রাণকৃষ্ণ বলেন, এমন বিকট শব্দ হয়েছিল, মনে হচ্ছিল পৃথিবী উল্টেপাল্টে যাচ্ছে। পরক্ষণেই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার হাত পা যে জখম হয়েছে এটা অবশ্য বুঝতে পারি। মনে হচ্ছিল মারা যাচ্ছি।
প্রাণকৃষ্ণের স্ত্রী অঞ্জনা জানান, বাসার কাছে হওয়ায় বিকট শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণেই চিৎকার শুনেই এগিয়ে গিয়ে জানতে পারি ও (প্রাণকৃষ্ণ) আহত হয়ে পড়ে আছে। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসি। অঞ্জনা জানান, স্বামীর আয়ে সংসার চলে তাদের। তিনি (অঞ্জনা) নিজেও গুরুতর অসুস্থ। মাসে অন্তত ৫ হাজার টাকার ওষুধের প্রয়োজন হয় তার। একে তো স্বামী আহত হয়ে শয্যাশায়ী। কবে নাগাদ স্বামী সুস্থ হবেন সে বিষয়ে ডাক্তাররা কিছুই বলতে পারছেন না। অন্যদিকে আয় রোজগার বন্ধ। কিভাবে চলবে সংসার। মেয়ের মুখে দুধ তুলে দেবেন কিভাব- সে চিন্তায় হাউমাউ করে কাঁদছিলেন অঞ্জনা।
একই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন সিলেটের গোলাপগঞ্জের রুস্তমপুর গ্রামের শাহিন আহমেদ। টাম্পাকোয় তিনি কাজ করতেন মেশিন অপারেটর হিসেবে। শনিবার ভোরে তিনিও কাজে যোগ দিতে গিয়েছিলেন কারখানায়। কিন্তু ঢোকার মুহূর্তেই ঘটে দুর্ঘটনা। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পান তিনি। এখন তার চিকিৎসা চলছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ঘটনার ভয়াবহতা মনে হলে শিউরে উঠছেন শাহিন। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরেই শুনছিলাম গ্যাসলাইনে সমস্যা আছে।
কিন্তু ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে গিয়েছিলাম। আমার তো তাও ভাগ্য ভালো। বেঁচে আছি। কিন্তু যারা আগে কারখানায় প্রবেশ করেছিল তাদের অনেকেই বিস্ফোরণে মারা গেছে। বিস্ফোরণের সময় দেখি ছিটকে পড়ছে মানুষ। একটু পরে দেখি কুণ্ডলী পাকিয়ে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।
টাম্পাকোয় সহকারী অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন বরিশালের বাকেরগঞ্জের ডিঙলারা গ্রামের জাকির হোসেন (৪৫)। ওই দিন ভোরে তিনিও কাজে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়ে এখন তিনি হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। মেরুদণ্ড ও ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন। কতদিন এভাবে হাসপাতালে থাকতে হবে জানেন না তিনি।
কিভাবে সংসাস চলবে তাও বুঝতে পারছেন না। সাড়ে ১৫ হাজার টাকা বেতনে জাকিরের বৃদ্ধ বাবা, মা, স্ত্রী ও দুই ছেলেসহ ৬ জনের পরিবার চলতো। অর্থের অভাবে স্ত্রী ছেলেদেরও নিজের কাছে এনে রাখতে পারেননি তিনি। জাকিরের সামনে এখন কেবলই অন্ধকার। তিনি বলেন, আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। অনেক কষ্টে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলাম। কিন্তু এখন কি হবে? আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো?
ফেরদৌস মিয়ার (৩২) সারা শরীরে অসংখ্য কাচের টুকরোর আঘাত। এছাড়া বাম কনুইয়ের মাংস উঠে গেছে। হাঁটুর উপরেও মাংস খুবলে গেছে। ১০২ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ফেরদৌস ঘটনার ভয়াবহতায় হতভম্ব হয়ে গেছেন। প্রায় সাত বছর আগে লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার জংগ্রাম থেকে এসে যোগ দিয়েছিলেন টঙ্গীর বিসিক শিল্প নগরীর অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানা টাম্পাকোয়। তার আয়ে চলতো সংসার। কিন্তু এ দুর্ঘটনার পর থমকে গেছে ফেরদৌস ও তার পরিবারের জীবন। এখন তার সামনে শুধুই অন্ধকার।
ফেরদৌসের দুর্ঘটনার খবর পেয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামে থেকে ঢাকায় ছুটে এসেছেন অসুস্থ পিতা মফিজুর রহমান (৬৫)। তিনি বলেন, ছেলের আয়ে সংসার চলতো। আমি নিজে একজন হৃদরোগী। এখন সংসার কেমন করে চলবে, আমি ভেবে পাচ্ছি না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, টাম্পাকো দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে তুলনামূলক যারা কম আঘাত পেয়েছেন তাদের অনেকেই চিকিৎসা নিয়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে গেছেন। তবে, এখনও গুরুতর আহত রয়ে গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে বেশ ক’জন জরুরি বিভাগে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জরুরি বিভাগে যারা পর্যবেক্ষণে রয়েছেন তাদের প্রায় সবার অবস্থাই গুরুতর।
কেউ মাথায় আঘাত পেয়েছেন, কারও শরীরের মাংস উড়ে গেছে, কারও বুক, পিঠ, হাত পা ঝলসে গেছে। কেউ বুকে, পিঠে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন। আবার কারও ভেঙেছে হাত, পা। দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আহতদের সুস্থ হতে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে যথেষ্ট সময় লাগতে পারে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে পর্যবেক্ষণে রয়েছেন গুরুতর আহত মো. শিপন (৩০)। টাম্পাকোর পেইন্টিং বিভাগে ওয়ার্কার পদে কাজ করতেন তিনি। মাথাসহ প্রায় পুরো শরীরে আঘাত পেয়েছেন তিনি।
চিকিৎসকের বরাত দিয়ে স্ত্রী নিগার সুলতানা বলেন, ২৪ ঘণ্টা পার না হলে কিছুই বলা যাবে না। আমরা এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। কি হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। একই অবস্থা সিলেটের বিয়ানীবাজারের আঙ্গুরা গ্রামের আমিনুল হক রিজুর। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন তিনি। তার ভাই হাসানুল হক মিজু জানান, মারাত্মক আহত হয়েছেন আমার ভাই। তার দুই কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। মাথায়ও গুরুতর আঘাত পেয়েছেন।
ডাক্তাররা বলেছেন, সময় না গেলে কিছুই বলা যাবে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. জেসমিন নাহার বলেন, এখন পর্যন্ত গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত ১০ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে ৫ জনের অবস্থা গুরুতর। তারা আশঙ্কামুক্ত নন। তারা নিউরো ও অর্থোপেডিক ট্রিটমেন্টে রয়েছেন। তারা এতটাই আঘাতপ্রাপ্ত যে, তাদের বিষয়ে সময় না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না। তবে এটুকু বলা যায়, গুরুতর আঘাতপ্রাপ্তদের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। এমজমিন
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি