নাজমুল হাসান, কালিয়াকৈর থেকে : নতুন বই নিয়ে স্কুলে যাওয়া হলো না রিভা আর তালহার। সব শেষ হয়ে গেল একটি দুর্ঘটনায়। স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হলো একটি পরিবারের। গতকাল গাজীপুরের কালিয়াকৈরে রেলওয়ের একটি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় একই পরিবারের চারজনসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
সকাল সোয়া ৯টার দিকে কালিয়াকৈরে প্রাইভেট কারযোগে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে দুই মা স্কুলে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনার শিকার হন। এ সময় প্রাইভেটকার চালকও নিহত হন। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল গোয়ালবাথান ও আশপাশের এলাকায় শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। স্বজনের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠছে বাতাস। বিকালে তাদের মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঢাকা থেকে রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্ঘটনায় লাইনচ্যুত হওয়া বগি উদ্ধার করা হলে পাঁচ ঘণ্টা পর ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
স্থানীয়রা জানান, পাঁচ বছর বয়সী শিশু রিভাকে দুদিন আগে প্লে গ্রুপে আর তারই চাচাতো ভাই তহসিন আহমেদ তালহাকে নার্সারি ক্লাসে ভর্তি করে নতুন বই নিয়ে সকালে মায়েরা রওনা দেন স্কুলের পথে। বাড়ি থেকে বের হয়ে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যেই দ্রুতগতির প্রাইভেটকার ট্রেনের ইঞ্জিনের সঙ্গে সংঘর্ষে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন কালিয়াকৈর উপজেলার গোয়ালবাথান গ্রামের ঠিকাদার রিপনের স্ত্রী নুসরাত জাহান লাকি আক্তার (৩৬), তাদের ছয় বছরের মেয়ে রুবাইদা নুশরাত রিভা, রিপনের চাচাতো ভাই পরিবহন ব্যবসায়ী বিদ্যুতের স্ত্রী সোনিয়া আক্তার (৩০) ও তাদের পাঁচ বছর বয়সী ছেলে তহসিন আহমেদ তালহা এবং চালক মিনহাজ উদ্দিন (৪৫)।
গ্রামের আবদুস সাত্তার জানান, একমাত্র সন্তানসহ স্ত্রীকে হারিয়ে নির্বাক ব্যবসায়ী রিপন। আর পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সোনিয়া আক্তার ও একমাত্র ছেলে তালহাকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গেছেন বিদ্যুত। আর চালক মিনহাজের স্ত্রী সন্তানরাও আহাজারি করছেন তাকে হারিয়ে। বিকালে তাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় কালিয়াকৈর উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম সেতু, পৌর মেয়র মজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দীন শিকদার, বিএনপি নেতা হুমায়ুন কবির খানসহ বিপুল সংখ্যক মানুষ শরিক হন।
কালিয়াকৈর থানার ওসি আবদুল মোতালেব মিয়া জানান, রোববার সকালে কালিয়াকৈর উপজেলার নয়ানগর গোয়ালবাথান গ্রাম থেকে মায়েরা তাদের সন্তানদের নিয়ে স্থানীয় মিশনারি স্কুলে রওনা দেয়। রেললাইনের ওপর গ্রামের রাস্তার ওই ক্রসিংয়ে কোনো বাঁশকল ছিল না। প্রাইভেট কারচালক খেয়াল না করে রেললাইনে উঠে পড়েন। একই সময় ঢাকা থেকে কলকাতাগামী মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনের সামনে পড়ে যায় ওই গাড়িটি।
প্রাইভেটকারটি ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে আটকে যায়। এ অবস্থায় আটকে থাকা গাড়িটি নিয়েই এগিয়ে যায় ট্রেন। এ সময় গাড়িটি দুমড়ে মুচড়ে যায়। প্রায় দেড় কিলোমিটার পর ট্রেন একটি সেতুতে উঠলে কারের ভাঙা বিভিন্ন অংশ নিচে পড়ে। রেলসেতুর নিচে কংক্রিটের প্লাটফরমে গাড়ির ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রাইভেটকারটি রক্ষার জন্য ট্রেনচালক ব্রেক কষলে আধাকিলোমিটার যাওয়ার পর ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়।
জয়দেবপুর জংশনের মাস্টার শহীদুল ইসলাম জানান, দুর্ঘটনার পর কিছুদূর গিয়ে মৈত্রী এক্সপ্রেসের একটি বগি লাইনচ্যুত হওয়ায় ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তরবঙ্গ রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। এ সময় জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনে ঢাকাগামী সিরাজগঞ্জ এক্সপ্রেস ও চাঁপাই এক্সপ্রেস এবং উত্তরবঙ্গগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস, ধূমকেতু এক্সপ্রেস ও নীলসাগর এক্সপ্রেসসহ কয়েকটি ট্রেন বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়ে।
স্থানীয়রা আরো জানান, পৌরসভা থেকে কয়েক বছর আগে ১২ ফুট চওড়া গ্রামের ওই রাস্তায় পিচঢালাই দেয়া হলেও কোনো রেলগেট করা হয়নি। কোনো গেটম্যান নিয়োগ করা হয়নি। সেখানে শুধু একটি সাইনবোর্ড বসিয়ে সবাইকে নিজ দায়িত্বে চলাচল করতে বলা হয়েছে। গত বছরও ওই ক্রসিংয়ে কাটা পড়ে এক ব্যাক্তি। এমজমিন
৯ জানুয়ারি ২০১৭/এমটিনিউজ২৪/এসবি