শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২, ০২:২২:৪৮

কাজ করেন ৩২ কর্মচারী, কোটিপতি পেঁয়াজু বিক্রি করে

কাজ করেন ৩২ কর্মচারী, কোটিপতি পেঁয়াজু বিক্রি করে

এমটিনিউজ২৪ ডেস্ক : পেঁয়াজু বিক্রি করে কোটিপতি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার মাসুদ খান। কালিয়াকৈর বাজারের ফলপট্টিতে প্রতিদিন ৭৫ হাজার টাকার ভাজাপোড়া বিক্রি করেন তিনি। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় পেঁয়াজু। ৩০ বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন। বর্তমানে দোকানে ৩২ জন কর্মচারী কাজ করছেন। এসব কারিগর-কর্মচারীকে মাসে ছয় লাখ টাকা বেতন দেন। রায়হানুল ইসলাম আকন্দ-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বিস্তারিত।

মাসুদ খানের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ, সেদ্ধ ছোলাসহ নানা ধরনের ভাজাপোড়া সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একের পর এক ক্রেতা পছন্দের খাবার কিনছেন। দোকানের পাশে ১৬ কর্মচারী এসব খাবার তৈরি করছেন। কেউ পেঁয়াজ কাটছেন, কেউ পেঁয়াজু, বেগুনি ও আলুর চপ বানাচ্ছেন। আবার কেউ বড় পাত্রে ভাজাপোড়া খাবার দোকানে সাজিয়ে রাখছেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলে এসব খাবার তৈরি ও বিক্রি। পেঁয়াজু, বেগুনি ও আলুর চপ পাঁচ টাকা করে বিক্রি করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারের ব্যবসায়ীরা একই খাবার তৈরি ও বিক্রি করেন। কিন্তু মাসুদের মতো বিক্রি কারও হয় না। জেলা-উপজেলার ক্রেতা ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে মাসুদের ভাজাপোড়া কিনতে আসেন অনেকে। বিশেষ করে তার পেঁয়াজুর সুনাম সবার মুখে মুখে। কারণ এই পেঁয়াজু বিক্রি করে তিনি এখন কোটিপতি। দীর্ঘদিন যেসব কর্মচারী-কারিগর তার দোকানে চাকরি করছেন তারাও সহায়-সম্পত্তি এবং বাড়ির মালিক হয়েছেন।

মাসুদের পেঁয়াজুর স্বাদ ভালো এবং সবার প্রিয় জানিয়ে উপজেলার সুত্রাপুর এলাকার বিজয় চন্দ্র সরকার বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে ব্যবসা করছেন, কিন্তু স্বাদের কোনও পরিবর্তন হয়নি আজো। তাই নিয়মিত পেঁয়াজু কিনতে তার দোকানে আসি।’

একই অভিব্যক্তি জানিয়ে একই এলাকার বাসিন্দা কল্পনা রানী বলেন, ‘সারা বছর মাসুদের দোকানে পেঁয়াজুসহ নানা ধরনের ভাজাপোড়া তৈরি করা হয়। অন্যদের চেয়ে তার ভাজাপোড়ার স্বাদ বেশি হওয়ায় দিনদিন ক্রেতা বাড়ছে। আমরা তার দোকান থেকে নিয়মিত ভাজাপোড়া কিনি।’

মাসুদের পেঁয়াজুর স্বাদটাই আলাদা উল্লেখ করে শ্রীফলতলী এলাকার আল আমীন বলেন, ‘আশপাশের দোকান থেকেও মাঝেমধ্যে আমরা ভাজাপোড়া খেয়েছি। কিন্তু মাসুদের পেঁয়াজুর স্বাদটাই আলাদা। তার মতো করে কেউ বানাতে পারে না। অন্য ১০ দোকানে খেলেও তার দোকানের পেঁয়াজু না খেলে মনে তৃপ্তি আসে না।’

দোকানের কারিগর দুলাল মিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত পেঁয়াজুসহ নানা খাবার তৈরি করি। প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন পেয়ে যাই। রমজান মাসে আমাদের বেতন বাড়িয়ে দেন মালিক। কারণ বছরের অন্য সময়ের চেয়েও রমজান মাসে আমাদের বেচাকেনা দ্বিগুণ হয়।’

১০ বছর ধরে এই দোকানে পেঁয়াজুসহ নানা ভাজাপোড়া তৈরি করছি জানিয়ে আরেক কারিগর আইয়ুব আলী বলেন, ‘আমার মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকা। তবে রমজান মাসে ৪০ হাজার টাকা পাই। আসলে সারা বছরই আমাদের বেচাকেনা ভালো হয়। এজন্য আমরা সবাই খুশি।’

দোকানের আরেক কারিগর নাহিদ হোসেন বলেন, ‘তিন বছর ধরে চাকরি করছি। ১৮ হাজার টাকা বেতন পাই। উপজেলা শহরে এত টাকা বেতন পেয়ে বাবা-মা, ভাইবোন নিয়ে খুব সুন্দরভাবে চলছে জীবন।’

দোকানের বাবুর্চি বাবুল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমার মাসিক বেতন ১৮ হাজার টাকা। রমজান মাসে ৩০ হাজার টাকা পাই। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেশ ভালো আছি। আমাদের দোকানের পেঁয়াজুর সুনাম সর্বত্র। একটু কমবেশি প্রতিদিন একই রকম বেচাকেনা হয়। দূরদূরান্ত থেকেও ক্রেতারা আসেন।’

২০ বছর ধরে মাসুদ খানের দোকানে চাকরি করছি উল্লেখ করে দোকানের ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) আমির উদ্দিন বলেন, ‘এই চাকরি করে তিন মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। তিনতলা বাড়ি করেছি। মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনভাতা পাই। দোকানে প্রতিদিন ৭০-৭৫ হাজার টাকার বেচাকেনা হয়। মাঝেমধ্যে আরও বেশি হয়। এই টাকা থেকে কর্মচারীদের বেতনভাতা ও অন্যান্য খরচ চালানো হয়।’

পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বাবার মৃত্যুর পর ছয় বোন, দুই ভাই ও মাসহ ৯ জনের ভরণপোষণের দায়িত্ব পড়ে মাসুদ খানের ওপর। এ অবস্থায় ১৯৯২ সালে ফুটপাতে পেঁয়াজু বিক্রি শুরু করে সংসারের হাল ধরেন মাসুদ। কয়েক মাসের মধ্যে তার পেঁয়াজুর স্বাদের কথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। কালিয়াকৈর ও আশপাশের মানুষজন পেঁয়াজুর স্বাদ নিতে শুরু করেন। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
পেঁয়াজু
পেঁয়াজু বিক্রির শুরুর সময়টা ছিল কষ্টের জানিয়ে মাসুদ খান বলেন, ‘একটা সময় অনেক কষ্ট করেছি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। এই ব্যবসা করে বোনদের বিয়ে দিয়েছি। রেস্টুরেন্ট বানিয়েছি, পাকাবাড়ি করেছি। মানুষকে তৃপ্তিদায়ক খাবার খাইয়ে নিজেও তৃপ্তি পাচ্ছি।’

মাসুদ খান বলেন, ‘৩০ বছর আগে পেঁয়াজু বিক্রি শুরু করি। তখন ফুটপাতে দোকান ছিল। আমার পেঁয়াজুর বিশেষত্ব হলো—পেঁয়াজের সঙ্গে অল্প পরিমাণ ময়দা, কাঁচা মরিচ, ধনিয়া পাতা এবং বিশুদ্ধ সয়াবিন তেল দিই। পুরনো তেল দিয়ে কখনও পেঁয়াজু ভাজি না। পেঁয়াজু, বেগুনি, আলুর চপ ভাজার পর তেল অবশিষ্ট থাকলে তা দিয়ে ছোলা ভাজি। আমার পেঁয়াজুর সুনাম প্রথম থেকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কালিয়াকৈর ছাড়াও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, ময়মনিসংহ, জামালপুর এমনকি ঢাকা থেকে কেউ কেউ এসে পেঁয়াজু কিনে নিয়ে যান। ৩২ জন কর্মচারী-কারিগর নিয়মিত কাজ করছেন। এছাড়া দৈনিক মজুরিভিত্তিতে কিছু নারী কারিগর রয়েছেন; যারা পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর কাজ করেন। সবমিলিয়ে প্রতি মাসে তাদের ছয় লাখ টাকা বেতন দিই।’

এসব ভাজাপোড়া খাওয়া কতটা স্বাস্থ্যসম্মত জানতে চাইলে কালিয়াকৈর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য পরিদর্শক হাজেরা খাতুন বলেন, ‘কতটা স্বাস্থ্যসম্মত কিংবা পুষ্টিগুণ আছে কিনা তা জানি না। তবে খেতে ভালো লাগে। তাই মাঝেমধ্যে কিনে খান সবাই। কিন্তু মাসুদের দোকানে বেচাকেনা যেহেতু বেশি সেহেতু স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিবেচনায় নিয়ে খাবারগুলো ঢেকে রাখা উচিত।’

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে