শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:১৪:৪৪

নারীর সুরক্ষায় পর্দা কেন জরুরি?

নারীর সুরক্ষায় পর্দা কেন জরুরি?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : আজ আমাদের সমাজে নারীরা নানাভাব লাঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। সাম্প্রতিককালে নারীদের নিরাপত্তাহীনতা আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে । ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই নারীরা যৌন হয়রানি তথা বর্বর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নির্যাতনে অনেকে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, আবার অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করে কোনো মতে বেঁচে থাকছে। আবার অনেকে লাঞ্চনায় আত্মহত্যা করছে। এক্ষেত্রে তিন-চার বছরের শিশু থেকে ৬০ বছরের নারীরাও রেহাই পাচ্ছে না। গেল কিছুদিনের বেশ কয়েকটি লোমহর্ষক ঘটনা আইয়্যামে জালিয়াত তথা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। এসব ঘটনা আমাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বব্যাপী চলছে নারীর প্রতি এ ধরনের আচরণ।

সম্প্রতি বর্ষবরণ উৎসবে ছাত্রীদের উত্যক্ত করে চাঁনখারপুলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই, টিএসসি চত্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেটে বেশ কিছুসংখ্যক নারীর ‘শ্লীলতাহানি’র ঘটনা ঘটে। এতে কারও কারও শাড়ি ধরে টান দিয়েছে বখাটেরা। কয়েকজনকে প্রায় বিবস্ত্রও করে অন্যায় আবদার পূরণের চেষ্টা এবং এই কাজে বাধা দিতে গিয়ে আহত হন তিন ছাত্রনেতা, একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে বিবস্ত্রকরণ। প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়া বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক ছাত্রীকে মারধর। এমন কী স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে যৌনহয়রানি করা হচ্ছে। সারা দেশে বেড়েই চলছে নারীদের হয়রানির ঘটনা। বাড়ছে খুন, ধর্ষণের ঘটনাও। দুর্বৃত্তদের পাশবিকতা থেকে বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও।

গত কয়েক মাসে খোদ রাজধানীতেই একাধিক গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। কর্মস্থল থেকে বাসায় ফিরতে মাইক্রোবাসে তুলে, বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে, এমনকি স্বামীকে অতিরিক্ত মদ্যপান করিয়ে মাতাল করে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি রাজধানীর ভাটারা থানার নয়ানগরে নিজের ঘরে ধর্ষিত হয়েছে চতুর্থ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত এক গারো শিশু। এর আগে গত জুন মাসে ভাটার থানা এলাকা যমুনা ফিউচার পার্কে পোশাকের দোকানে কর্মরত এক গারো তরুণীকে চলন্ত মাইক্রোবাসে ধর্ষণের ঘটেছিল।  পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত ছয় মাসে সারা দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় অন্তত ১০ হাজার মামলা হয়েছে। এ থেকে বুঝা যায় আমাদের নারীরা কতটা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।

কেন এগুলো হচ্ছে এবং এ থেকে নারীদের কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আমরা যদি লক্ষ্য করি তবে দেখতে পাবো- প্রগতিশীলতার নামে নারীরা আজ নিজেরাই নিজেদেরকে ভোগ্য পণ্যে পরিণত করছে। যে কোন সভ্য সমাজকে কোন একটা নেতৃত্বের অধীনেই কাজ করতে হয়। যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে কিংবা নেতৃত্ব নিয়ে সঙ্ঘাতের ফলে সামাজে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। সাধারন মানুষ তখন কোন দিক নির্দেশনা পায়না। আল্লাহ তাআলা সমগ্র মানব জাতিকে একজন পুরুষ আর একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছেন। শারীরিক স্বামর্থ, মনোবল, নিরাপত্তা, শালীনতা প্রভৃতি বিবেচনায় রেখে আল্লাহ তাআলা কঠিন নেতৃত্বের ভার পুরুষের উপরই অর্পন করেছেন। নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একজন নেতাকে ঘরে-বাইরে, দিনে-রাতে, ঝড় বৃষ্টিতে এবং আরও অনেক প্রতিকুল পরিবেশে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতে হয় যেটা একজন নরীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় এবং সমীচীনও নয়। নারীরা মায়ের জাতি। সভ্য, সুশিক্ষিত, সৎ ভবিষ্যত প্রজন্মকে গড়ে তুলতে তাদেরকে মানবিক গুনাবলী শিক্ষা দিতে, তাদেরকে সার্বক্ষনিক স্নেহ-মমতায় ঘিরে রাখতে, পুরুষদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করতে, সমাজ থেকে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা দূর করতে নারী ছাড়া পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অধিকন্তু প্রয়োজনে সম্মাজনক জীবিকার সন্ধান করার অনুমতিও ইসলাম নারীকে দিয়েছে। তবে সেটা কোন ভাবেই নিজের ইজ্জত, আব্রু আর সম্মানের বিনিময়ে নয়।

সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নামী জনপ্রিয় দেশী পোশাক ব্র্যান্ডের জমকালো রেড কার্পেট শো এর সংবাদের সঙ্গে দেয়া ফ্যাশন শো এর ছবিতে হঠাৎই চোখ আটকে গেল। হাঁটু পর্যন্ত হরেক রকম পোশাকে মডেলরা পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এই পোশাক কি দেশি ফ্যাশন হাউজটি আমাদের সাধারণ নারীদের জন্য তৈরি করেছে? নাকি এই পোশাকগুলো সিনেমা, নাটকে যারা অভিনয় করে তাদের জন্য?

সিনেমা/নাটকের অভিনেত্রীদের জন্য যদি তৈরি করে থাকে তবে ভিন্ন কথা। কারণ অনেক নায়িকাই আজকাল গর্বভরে বলে থাকেন, চরিত্রের খাতিরে নাকি নগ্ন হতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই! আর পয়সা দিয়ে যেহেতু মানুষ বিনোদন কিনতে যায়, কাজেই নারীর নগ্ন শরীর যদি সেই পয়সা উসুল করার বন্দোবস্ত করে দেয়, তাহলে মন্দ কি? তারা শরীর দেখিয়ে আয় করে করুক, কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমাদের দেশের তথাকথিত আধুনিক মেয়েরা কি এখন এসব পোশাক পরছে? আমরা নারীরা কি তবে আধুনিকতার নামে শরীর দেখানোতেই আজকাল বেশি আগ্রহী?

এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে বাঙালি নারীর চলনে, পোশাকে। নারীর পোশাকের এই পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। ব্যক্তি স্বাধীনতা ও আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে বাঙালি নারী বেছে নিয়েছে নিজের পছন্দমত পোশাক।

যেখানে একসময় শাড়ি ছিল বাঙালি নারীর প্রধান পরিধেয়, কালক্রমে তা দখল করে নেয় সালোয়ার-কামিজ-ওড়না। দৈনন্দিন কাজকর্ম করার সুবিধা, সস্তা ও শালীনতার কারণে গ্রামেগঞ্জে সর্বত্রই সালোয়ার কামিজের একচেটিয়া ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।

বাঙালি নারীর চিরন্তন পোশাক "শাড়ি" আজকাল অকেশনাল পোশাক হয়ে উঠেছে। কোনো অনুষ্ঠান বা বিশেষ দিবসে আজকাল আধুনিক শহুরে মেয়েরা শাড়ি পরে থাকে। নারী ইদানিং শাড়ি কম পরে বলে নারীর চেয়ে বাঙালি পুরুষদেরই কেন যেন হা-হুতাশ বেশি করতে দেখা যায়!!এই হা-হুতাশ কি বাঙালি নারীর স্বকীয়তা নষ্ট হচ্ছে এই কারণে, নাকি নারী দেহের সৌন্দর্য দর্শনে বঞ্চিত হচ্ছে সেই কারণে- তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।

"নারী সুন্দর শাড়িতে" যতই বলি না কেন, সে সৌন্দর্য কিন্তু নির্ভর করে শাড়ি পরার ধরনের উপর। অনেকেই বলে থাকেন শাড়ি হলো সব চেয়ে উত্তেজক পোশাক। ব্লাউজের ডিজাইনের উপর এবং সেইসঙ্গে শাড়ির ফেব্রিকের উপর নির্ভর করে শাড়িতে নারী কতোটা আবেদনময়ী। ইমপোর্টেড পাতলা জর্জেট কিংবা স্লিভলেস, পিঠখোলা ব্লাউজের সঙ্গে দেশি জামদানি/তাঁতের শাড়ি আদৌ কোনো শালীন পোশাক কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
 
ইদানিং শহর ও মফস্বলে অল্প বয়সী মেয়েদের দেশি ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে এক বিচিত্র পোশাকের ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফ্যাশনেবল পোশাক বলে এগুলোকে গণ্য করা হয়। সেই সঙ্গে মাথায় হিজাব বা ওড়না পরা নারীর সংখ্যাও বাড়ছে সমানতালে। পুরুষের লালা থেকে নিজেদের রক্ষা করতেই হোক, পারিবারিক কিংবা ধর্মীয় অনুশাসনেই হোক, বিভিন্ন ডিজাইনের হিজাব/বোরখা পরা নারীর উপস্থিতি বাড়ছে সর্বত্রই। আর বাড়ছে বাঙালি নারীর পোশাক নিয়ে তর্ক-বিতর্ক।

বোরখা-হিজাব পরিহিত অনেক নারীর ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে এই পোশাক পরিহিতারাও নানা সমালোচনার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, হিজাব পরা বা নেকাব পরিহিতারা কেউ আনস্মার্ট। বরং অনেক আধুনিক পোশাকে সজ্জিত অনেক মেয়েদের চেয়েই তারা অনেক বেশি স্মার্টও বটে।
 
পোশাক সে আরব দেশ থেকেই আসুক, আর পাশ্চাত্য থেকে কিংবা উপমহাদেশ থেকে, নারীর পোশাক হোক শালীন। শরীর যে যত দেখাতে পারবে সে তত আধুনিক, কিংবা হিজাব-নিকাব পরিহিত কেউ আনস্মার্ট এমনটি ভাবা মোটেও উচিত নয়।

নারীর ভেবে দেখা দরকার, হরেক ডিজাইনের হিজাবই হোক আর স্লিভলেস টপস-জিন্সই হোক যে পোশাক সে পরছে তা কি পুরুষকে আকর্ষিত করার জন্য? যদি আশপাশের তাবত পুরুষকে নিজের শরীরী সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থা নারী নিজেই করে দেয়, তাহলে সেটা অবশ্যই সেই নারীর নিজস্ব অভিরুচি। কিন্তু ইসলাম তা কোনোভাবেই সমর্থন করে না।   

পুরুষরা নারীর পোশাক নিয়ে কে কি বলল তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, নিজেকে পণ্য হিসেবে নাকি শালীনতার মোড়কে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী হিসেবে উপস্থাপন করবে তা নারীকেই ঠিক করে নিতে হবে।

তবে অবশ্যই মনে রাখা দরকার, শরীরকে উন্মুক্ত করার নাম কখনই আধুনিকতা নয়, আধুনিক হতে হবে মেধায়-মননে।

ইসলাম তার শিক্ষা ও আদর্শের মাধ্যমে মানব প্রকৃতিকে- যা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন- তো দ্ব্যর্থহীন কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য দিয়ে নারী-পুরুষ দুই শ্রেণীতে সৃষ্টি করেছেন। এরা যাতে একে অপরের সম্পূরক হয়। এ ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ঠিক রাত-দিনের মতো। যে দুয়ের সমন্বয়ে হয় একটি দিন। কিংবা বলা যায় ইতি ও নেতিবাচক স্রোত তথা জোয়ার-ভাটার মতো, যে দুইয়ের যোগে গঠিত হয় বিদু্ৎ-শক্তি। এ বিদু্ৎ-শক্তি সঞ্চার করে বহু জড় পদার্থে প্রাণ ও প্রাণস্পন্দন।

আল্লাহ তা‘আলা নারীকে যেসব অনন্য বৈশিষ্ট্যে শোভিত করেছেন, তার অন্যতম হলো আচার-আচরণে আহ্লাদের প্রাচুর্য ও আবেগের বাহুল্য। তেমনি গঠন-প্রকৃতিতেও নারী কোমলতা ও এমন নম্রতায় সমুজ্জ্বল,  যা পুরুষের সঙ্গে বসবাসরত পরিবেশে তার স্বাধীনতাকে করে সীমাবদ্ধ। আল্লাহ তা‘আলা নারীকে স্বভাব-চরিত্রেও বানিয়েছেন কোমল। যাতে সে শুষে নিতে পারে পুরুষের যাবতীয় রুক্ষতা। কেড়ে নিতে পারে তার হৃদয়। নারীর সান্বিধ্য পুরুষকে দেয় মানসিক আশ্রয়। যেখানে এলে তার টেনশন-অস্থিরতা লঘু হয়। কেটে যায় সব ক্লান্তি ও বিস্বাদ।

একইভাবে সে যাতে হয় মমতাময়ী এবং শিশুর লালন-পালনে উপযুক্ত।
আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ এক কোমল সৃষ্টি নারী। অপরের সুখের জন্য নারীই পারে সবচেয়ে বেশি ত্যাগের মহত্ব প্রকাশ করতে। এসব মানবিক গুণ ও সহজাত উপাদান ছাড়া কোনো পরিবার ও সমাজ টেকসই হয় না। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রমাণ করেছে, নারীই সবচেয়ে বেশি কঠিন মানসিক চাপ বহন করতে সক্ষম।আর মানসিক আঘাত সারাতে নারীই রাখতে পারে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা।

ইসলামে নারীর সুরক্ষা ও পর্দা:
ইসলাম শব্দের মূল হচ্ছে শান্তি। একমাত্র ইসলাম-ই পেরেছে এবং পারে যমীনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে। ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বাইরে কোথাও শান্তি পাওয়া যায়নি এবং যাবেও না। জীবনের এমন কোনো অঙ্গন নেই, যেখানে ইসলামের বিধান ও শিক্ষা নেই। সেই শিক্ষা ও বিধান যখন আমরা ভুলে যাই তখনই আমাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসে। আখেরাতের ভয়াবহ শাস্তি তো আছেই, দুনিয়ার জীবনও বিপর্যস্ত হয়ে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নারী ও পুরুষকে স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্যের অধিকারী করে সৃষ্টি করেছেন।

এই বৈশিষ্টগত পার্থক্যটা সৃষ্টিগত; যা আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি না। আর কিছু পার্থক্য আছে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে। একজন পুরুষ যে দায়িত্ব পালন করতে পারে নারীরা তা পারে না। আবার একজন নারী যে কাজ করতে পারে একজন পুরুষ তা করতে পারে না। নারীর জন্য সন্তান লালন-পালন, স্বামীর খেদমত, আপনজনকে আপ্যায়ন, ঘরের রান্না- বান্না ইত্যাদি কর্মই হল শোভনীয়।

আর পুরুষের জন্য খেত-খামার, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি শোভনীয়। নারী ও পুরুষের প্রত্যেকেরই নিজস্ব অঙ্গনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারী ও পুরুষের কর্ম ক্ষেত্র ও দায়িত্ব ভিন্ন হলেও আল্লাহ তা‘আলার নিকট মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিবেচনা হলো তাকওয়া। যে ব্যক্তি আল্লাহকে যত বেশি ভয় করবে, চাই সে নারী হোক বা পুরুষ হোক আল্লাহর নিকট তার মূল্যায়নটা তত বেশি হবে।নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় গঠিত হয় পরিবার, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র। একটি আদর্শ পরিবার ও সমাজ গঠনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

পুরুষের ভূমিকার পাশাপাশি নারীর ভূমিকাও মুখ্য। একমাত্র ইসলামই নারীর অধিকার যথার্থভাবে সংরক্ষণ করেছে। তাকে বানিয়েছে গৃহের রাণী। রাসূল (সা.) বলেছেন, “নারী নিজ গৃহের দায়িত্বশীলা, তার গৃহ সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে।” তাই বলে ইসলাম তাকে ঘরের আসবাবপত্র বানায় নাই। বরং প্রয়োজনের তাগিদে হিজাব পরিধান করে বা পর্দা সহকারে মার্জিতভাবে বাড়ি থেকে বের হওয়ার এবং প্রয়োজনীয় সকল প্রকার হালাল কাজের অনুমতি দিয়েছে। তবে শর্ত তা-পর্দা ও শালীনতা সহকারে করতে হবে এবং সৌন্দর্য প্রদর্শন করা যাবে না।

আজ আমাদের ঘরে-বাইরে, সমাজে-রাষ্ট্রে সবদিকেই শুধু অশান্তি আর অস্থিরতা। বিশেষ করে নারীঘটিত ফিতনায় সমাজ জর্জরিত। নারীরা আজ সর্বত্র লাঞ্ছিত, অপমানিত। পর্দাহীনতার পরিণতিতে তারা শিকার হচ্ছে সম্ভ্রমহানির, টিজিংয়ের, যাক মেইলের, খুন হচ্ছে যৌতুক ও অন্যান্য কারণে। এর সবগুলোর পিছনে কারণ ইসলাম থেকে দূরে সরে যাওয়া; অর্থাৎ ইসলামী শরয়ী পর্দার বিধান মেনে না চলা। কারণ ইসলামী বিধান অর্থাৎ শরয়ী পর্দা মহিলাদের সম্মান, ব্যক্তিত্ব ও পবিত্রতার প্রতীক। পরপুরুষের সাথে বন্ধুত্ব, কথা বলা ও যোগাযোগ রাখা, প্রয়োজন হলে আত্মীয়-সঙ্গী সাথে না নিয়ে একাকী অন্য পুরুষের কাছে যাওয়া ইত্যাদি।মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে হিজাব শব্দটি বহুবার এসেছে, যার আভিধানিক অর্থ- প্রতিহত করা, ফিরিয়ে আনা, আড়াল করা, আবৃত্ত করা, আচ্ছাদিত করা ইত্যাদি।আল্লাহ তা‘আলা নারীদের ইজ্জত, সম্ভ্রম ও সম্মান রক্ষার জন্য পর্দার বিধানকে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন।

পর্দা নারীর সৌন্দর্য এবং নারীর ইজ্জত সুরক্ষার ঢাল। পর্দাহীন নারী বাকলহীন কলার মত- যার উপর পোকা-মাকড়, ধূলা-বালি, মশা-মাছি বসার কারণে কেউ তা নিতে চায় না। বাজারে তার কোনো দাম নেই। অনুরূপ নারীও যখন ঘরের বাইরে পর্দাহীন অবস্থায় বের হয়, তখন সমাজে তার কোনো দাম থাকে না।আজ পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের মুসলিম-সমাজ এতটাই প্রভাবিত হয়ে পড়েছে যে, কুরআন ও সুন্নাহর বিধান তাদের ভালো লাগে না। মনে করে এটা অপরিচিত ও অপ্রয়োজনীয় যা নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল।

ইসলামের যাবতীয় বিধান শুধু আমাদের আখেরাতে নাজাতেরই উপায় নয়, আমাদের দুনিয়ার জীবনের শান্তি, স্বস্থি ও পবিত্রতারও রক্ষাকবচ। মুসলমান আজ নিজেদের আর্দশ ত্যাগ করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। আমাদের পরিবার ও সমাজেও পশ্চিমা সমাজের ভয়াবহ উপসর্গগুলো প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে অশনিসংকেত। পশ্চিমা সভ্যতা যেসব মরণব্যাধিতে আক্রান্ত তা থেকে যদি আমরা আমাদের পরিবার ও সমাজকে রক্ষা করতে চাই তার একমাত্র উপায় ইসলামের বিধান ও আদর্শের উপর আত্মসমর্পণ।

আমরা যদি আমাদের পরিবারিক শান্তি ফিরে পেতে চাই তাহলে নারী-পুরুষ সকলকে পর্দার বিধানের অনুসারী হতে হবে।পর্দার বিধানটি আজ নানাবিধ ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে জর্জরিত। খোদ মুসলিমদের দ্বারাই লঙ্ঘিত আজ পর্দার প্রকৃত বিধান। এখনকার উঠতি ছেলে-মেয়েদের পোষাক হলো- প্যান্ট, ফতুয়া, নেটের জামা, টাইটস-সর্টস যা এমন টাইটফিট, আঁট-সাঁট যাতে দেহের প্রতিটি অঙ্গের আকার, আকৃতি কাপড়ের উপরেও বুঝা যায়। এমন চোস্ত ও ফ্যাশনের লেবাস মুসলিম নারী পরিধান করতে পারে না, যাতে তার দেহের আকর্ষণীয় সৌষ্ঠব প্রকাশ পায়। যা কেবল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক সুদৃঢ় ও মধুময় করার জন্যই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সমাজে ফিতনা ছড়ানোর জন্য নয়। নারীদের বেশ ধারি পুরুষের উপর অভিশাপ এবং পুরুষদের বেশ ধারিণী নারীদের উপর আল্লাহর অভিশাপ।

পশ্চিমা সংস্কৃতি-সভ্যতা কখনো আমাদের অনুকরণের বস্তু হতে পারে না। যাতে নারীর বিন্দুমাত্র মর্যাদা নেই। সেখানে তো নারী নিছক ভোগের বস্তু। বিভিন্ন উপায়ে নারীকে প্রলুব্ধ করা হয়েছে পুরুষের ভোগের চিতায় আত্মাহুতি দেওয়ার জন্য। বারুদের নিকট আগুন রাখা হলে বিস্ফোরণ তো হতেই পারে। যেহেতু মানুষের মন স্বভাবতই কামপ্রবণ এবং অনিয়ন্ত্রিত-দুর্নিবার কামনা- বাসনা মানুষকে অন্ধ, বধির ও পশুতুল্য করে তোলে।পোশাক-পরিচ্ছদের ভালো-মন্দ মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা তথা মানবিক জীবনের উপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে এবং অন্তর ও মন-মানসিকতায় গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাই পোশাকের বিষয়টি এ রকম সাধারণ কোনো বিষয় নয় যে, একটি কাপড় কিনলাম এবং তা পরে নিলাম। বরং এক্ষেত্রে শরীয়তের দিক-নির্দেশনা মেনে চলা জরুরি। আমাদের দেশের কিছু জ্ঞান-পাপী বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা হর-হামেশা বলে থাকেন পর্দাপ্রথা নারীর অধিকার হরণ করে এবং প্রগতির অন্তরায়।

অবশ্যই এদের নিকট নৈতিক চরিত্রের প্রশ্নটি নিতান্তই বাহুল্য।কোনো ইঁদুর নিজের চোখ বন্ধ করে যদি মনে করে যে, সে সমস্ত বিড়াল থেকে নিরাপদ তবে এ তার বোকামী নয় কি? নারীর সৌন্দর্য দেখে বদখেয়াল, কুচিন্তা আসাও মানুষের জন্য স্বাভাবিক। অতএব পর্দা না করে কাম লোলুপতা ও ব্যভিচারের পথ বন্ধ করা সম্ভব নয়।ইসলামের ইতিহাসে দেখা যায় কি নারী কি পুরুষ- বড় বড় বিজ্ঞানী, দার্শনিক, শিক্ষক, চিকিৎসকের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। নিঃসন্দেহে এসব কৃতিত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ কোন মূর্খ মায়ের কোলে লালিত পালিত হননি। হজরত আয়েশা (রা), রাবেয়া বসরীর ন্যায় বহু জ্ঞানী মহীয়সী নারীর ইতিহাস আমরা জানি।

পর্দার বিধান পূর্ণভাবে মান্য করেই তারা জ্ঞানের জগতে খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাই যারা মনে করেন পর্দা প্রগতির অন্তরায় তাদের ইসলাম সম্পর্কে জানা উচিত। হতে পারে তারা ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ যার কারণে না বুঝেই বিরোধিতা করে নয়তো তারা নারীর উন্নতির নামে পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে কবর দিয়ে নিজেদের নিকৃষ্ট কামনা বাসনাকে পূর্ণ করতে চায়।সম্প্রতি নারীনির্যাতন খুব বেড়ে গেছে, বিশেষত উঠতি বয়েসী মেয়েরা চরম নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এটা এ সমাজের চরম ব্যর্থতা যে, নিজেদের মা-বোনকেও নিরাপত্তা দিতে পারছে না। এ অবস্থায় মা-বোনদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে নিজেদের নিরাপত্তা সম্পর্কে। অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন প্রয়োজন অনেক বেশি সতর্কতা ও সচেতনতার।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সত্য এই যে, বিপর্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়েই যেন বেড়ে চলেছে আমাদের অবহেলা ও অসচেতনতা।নিজের ঘরকে অরক্ষিত রেখে নারীরা বিভিন্ন কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হবার কারণে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত সন্তান বড় হচ্ছে নৈতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় শিক্ষাহীনভাবে। এ অবস্থার ভয়াবহ ঝুঁকির মুখে পড়ে আমাদের সন্তানেরা এক পর্যায়ে বখাটে, নেশাখোর, সর্বশেষ সন্ত্রাসী হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করছে। তাই সময় এসেছে সার্বিক বিষয় বিবেচনা নেয়ার। তাই বলা যায়- মানব রচিত কোন মতবাদ নয়, ইসলামই নারীকে সবচেয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করে। আর এক্ষেত্রে পর্দা হলো নারীর সৌন্দর্যের ভূষণ। ফলে নারী সমাজকে এসব হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে ইসলামের বিধান পর্দাকে নিজেদের সুরক্ষার উত্তম পন্থা হিসেবে বেছে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।  
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএম/ডিআরএ

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে