ইসলাম ডেস্ক: আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ভাগে কোরবানি দেয়ার প্রচলন অত্যান্ত বেশি। নিয়ম কানুন না জানার কারণে অনেক সময় অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি দিতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়েন। মূলত ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দ্বারা এক পরিবারের পক্ষ থেকে একটা পশু কোরবানি করতে পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দ্বারা সাত জনের নামে সাতটি কোরবানি করা যাবে। তবে অংশীদারি ভিত্তিতে কোরবানি করার দুটি পদ্ধতি হতে পারে-
১। সওয়াবের ক্ষেত্রে অংশীদার হওয়া। যেমন-কয়েক জন মুসলিম মিলে একটি বকরি ক্রয় করল। অত:পর একজনকে ঐ বকরির মালিক বানিয়ে দিল। বকরির মালিক বকরিটি কোরবানি করল। যে কজন মিলে বকরি খরিদ করেছিল সকলে সওয়াবের অংশীদার হলো।
২। মালিকানার অংশীদারির ভিত্তিতে কোরবানি। দুজন বা ততোধিক ব্যক্তি একটি বকরি কিনে সকলেই মালিকানার অংশীদার হিসেবে কোরবানি করল। এ অবস্থায় কোরবানি শুদ্ধ হবে না। অবশ্য উট, গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি জায়েয কি নাজায়েয অর্থাৎ উট বা গরুর এক সপ্তাংশ একটি পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে কি? - সে ব্যাপারে উলামাদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন, যথেষ্ট নয়। কারণ, তাতে ৭ জনের অধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ নয়। তা ছাড়া পরিবারের তরফ থেকে একটি পূর্ণ দম (জান) যথেষ্ট হবে। আর ৭ ভাগের ১ ভাগ পূর্ণ দম নয়। (ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মদ বিন ইবরাহীম, ৬/১৪৯)। অনেকের মতে একটি মেষ বা ছাগের মতই এক সপ্তাংশ উট বা গরু যথেষ্ট হবে। (শুমাইমিরী, মাজালিসু আশরি যিলহাজ্জাহ, পৃ. ২৬; আল-মুমতে ইবনে উসাইমীন, ৭/৪৬২-৪৬৩)।
মূলত এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে উলামাগণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন:
১ম পক্ষ: মুসাফির ও মুক্বীম উভয় অবস্থায় ১টি উট বা গরু বা মহিষে ৭ জন বা ৭টি পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে করেন।
২য় পক্ষ: মুসাফির অবস্থায় উট বা গরু বা মহিষে ৭ জন বা ৭জনের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে করেন। কিন্তু এ পক্ষ মুক্বীম উভয় অবস্থায় ১টি উট বা গরু বা মহিষে ৭টি পরিবারের পক্ষ থেকে কোরবানি করাকে যথেষ্ট মনে করেন না। এদের মতানুযায়ী, মুক্বীম অবস্থায় একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশুই কোরবানি করতে হবে।
কোরবানিতে অংশগ্রহণ ও সাত ভাগা প্রসংগে প্রথম পক্ষের প্রমাণাদি ও বক্তব্য
অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় কোরবানিকেও আল্লাহ বিভিন্নভাবে আদায় করার বিধান দান করেছেন। ফলে আমরা উট, গরু, ছাগল ,ভেড়া, দুম্বার যেকোন একটা কোরবানি করতে পারি, আবার সবগুলো একসাথেও করতে পারি। আবার এককভাবে উট, গরু, মহিষ কোরবানি করতে না পারলেও সাত জন অংশগ্রহণ করতে পারি। কিন্তু একটি জন্তুতে সাত জনের অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে নানাবিধ বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন বলা হয়ে থাকে, শুধু সফরের অবস্থায় সাত জন অংশগ্রহণ করতে পারবে, তবে তাদের একই পরিবারের অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, বিভিন্ন পরিবারের হলে নয়। এ বিষয়টিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই- ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম । এমতাবস্থায় কোরবানির ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (তিরমিযী নাসাঈ, ইবনু মাজাহ)।
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একটি গরু সাতজনের পক্ষ কোরবানি করা যাবে...। (তিরমিযী)
হাদিসে বর্ণিত সাতজনে একটি গরুতে শরীক হয়েছিলাম এ সাতজন শব্দের অর্থ বুঝতেই অনেকে ভূল করেছেন এবং মনে করেছেন একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা সাতের অধিক হলে সেই পরিবারের জন্য একটি গরু বা উট যথেষ্ট নয়; অথচ একটি গরু বা উট শুধু এক পরিবার নয়, বরং সাতটি পরিবারের জন্য যথেষ্ট । আর সেই পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা যতই হোক না কেন। কারণ হাদিসে সাতজন বলতে সাতজন কর্তা ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে যাদের প্রত্যেকে একেকটা পরিবারের মালিক। যেমন- আপনি এক পরিবারের কর্তা, সুতরাং আপনার উপরই কোরবানির বিধান বলবৎ হবে ।আপনার সন্তান ও স্এীর উপর এ বিধান বলবৎ হবে না। তবে হ্যাঁ তাদের কারো নামে যদি এ পরিমাণ সম্পদ থাকে যে, তারা কোরবানি দেয়ার সমর্থ্য রাখে। তবে কারো কারো মতে তাদের উপর কোরবানির বিধান বলবৎ হয়ে যাবে। তিরমিযী শরীফে লিখিত আবু আইয়ুব হতে বর্ণিত সহিহ হাদিস দ্বারা এ কথাই সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, যা নিম্নরূপ:
আতা বিন ইয়াসার বলেন, আমি আবু আইয়ুব (রা.) কে প্রশ্ন করলাম যে, নবী (সা.) এর যুগে কোরবানি কিভাবে করা হতো? তখন তিনি বললেন, এক ব্যক্তি তার ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে একটি একটি ছাগল কুরবনী করত, সেখান থেকে তারা খেত এবং অন্যদের খাওয়াত, আর মানুষ এভাবে আনন্দিত হতো ও গর্ববোধ করত। আর সে প্রথা বর্তমানকাল পর্যন্ত চলে আসছে।
ইমাম শাওকানী (রাহ.) নায়লুল আওতার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সঠিক কথা হচ্ছে যে, একটি ছাগল একটি পরিবারের থেকে যথেষ্ট হবে যদিও তারা ১০০ জনের পরিবার অথবা ততধিক হয়। নবী (সা.) এর সুন্নাতের এটাই ফায়সালা। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯২)।
ইবনুল কাইয়িম (রাহ.) বলেন, নবী (সা.) এর তরীক্বা হচ্ছে যে, একটি ছাগল এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ থেকে যথেষ্ট হবে যদি তাদের সংখ্যা অনেক হয়। ( তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯১)।
নবী (সা.) এর যুগে এক ব্যক্তি যেহেতু একটি ছাগলের কোরবানিতে অংশগ্রহণ করত ও সাত ব্যক্তি একটি গরু কিংবা উটে অংশগ্রহণ করত, সুতরাং সাধারণ ভাবেই বুঝা যায় যে, একটি ছাগল এক ব্যক্তি ও তার পরিবারের জন্য যখন যথেষ্ট ছিল, তখন সাত ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে একটি গরু কেন যথেষ্ট হবে না।
ইবনে আববাস (রা.) এর হাদিসে বর্ণিত যে সমস্ত সাহাবায়ে কেরামগণ সাতজন করে একটি গরুতে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তারা প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের লোক ছিলেন।
জাবির (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন, গরু সাত জনের পক্ষ হতে এবং উট সাত জনের পক্ষ হতে কোরবানি করা যাবে। (মুসলিম, আবূ দাউদ)।
ভারতবর্ষের মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, অবশ্যই উট এবং গরুর কোরবানিতে বিভিন্ন পরিবারের অংশগ্রহণ প্রমাণিত যেমন ছাগলে একই পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণ প্রমাণিত। (তুহফাতুল আহওয়াযী, ৫/৯৩)।
আল্লামা নবাব সিদ্দিক হাসান খান ভুপালী (রাহ.) বলেন, উট এবং গরুর কোরবানিতে সাত ব্যক্তির অংশগ্রহণ সঠিক যদিও তারা বিভিন্ন পরিবারের হয়ে থাকে। (আর-রওযাতুন নাদিয়াহ, পৃ. ১২৮)।
আল্লামা ওবায়দুল্লাহ রহমানী মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, আর কোরবানি প্রসঙ্গে অধিকাংশ ইমামগণের মত হচ্ছে, কোরবানিতেও হাদি তথা হজ্জের পশুর ন্যায় অংশ গ্রহণ বৈধ যদিও অংশগ্রহণকারীগণ একই পরিবারের সদস্য হয়, কিংবা বিভিন্ন পরিবারের হয় এবং তারা নিজেদের মধ্যে আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয় হোক। তরে ইমাম আবু হানীফা (রাহ.) শর্তারোপ করেছেন যে, একই পশুতে বিভিন্ন জনের অংশগ্রহণ তখনই বৈধ যখন তারা পরস্পরের নিকটাত্মীয় হবে। (মিরআতুল মাফাতীহ, ৫/১৭৭)।
ইমাম তিরমিযী (রাহ.) মন্তব্য করেন যে, ১টি জন্তুতে সাতজনের অংশগ্রহণের উপর বিজ্ঞ সাহাবা কেরামের আমল প্রমাণিত এবং পরবর্তীতে ইমাম সুফইয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারাক, শাফেয়ী, আহমাদ ও ইসহাক এর উপর আমল করেছেন। (তুহফাতুল আহওয়াযী, পৃ৮৮)।
তাছাড়া, একটি গরু যে সাতটি ছাগলের সমান তা নবী (সা.) এর নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত: ইবনু আববাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী (সা.) এর কাছে এসে বলল যে, আমার উপর একটি হজ্জের পশু কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে আছে কিন্তু আমি তা ক্রয় করতে পারছি না। তখন নবী (সা.) তাকে নির্দেশ প্রদান করলেন যেন সে সাতটি ছগল ক্রয় করে সেগুলোকে জবেহ করে। (আহমাদ, ইবনু মাজাহ)।
ইমাম নববী (রাহ.) মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যায় বলেন, একটি গরু সাতজনের পক্ষ যথেষ্ট হবে, আর প্রতিটা গরু সাতটি ছাগলের স্থলাভিষিক্ত হবে। লক্ষনীয় যে, আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রাহ.), ওবায়দুল্লাহ রহমানী মুবারকপুরী (রাহ.), নবাব সিদ্দিক হাসান খান (রাহ.) প্রমুখ উলামায়ে কিরাম কেউই কোরবানির ভাগাভাগিতে অংশগ্রহণের সাথে সফরের কোন শর্তের কথা উল্লেখ করেননি।
সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলাো পরিষদের স্থায়ী কমিটি নামক ফাতাওয়া বোর্ড ফাতাওয়া প্রদান করেছে যে, একটি পরিবারের হোক কিংবা বিভিন্ন পরিবারের হোক এবং তারা আত্মীয়ই হোক কিংবা অনাত্মীয় হোক। (ফাতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়েমাহ, ১১/৪০১)। আল্লামা ইবনু উসাইমীন বলেন, একটি ছাগল একজনের পক্ষে যথেষ্ট এবং উট এবং গরুর সাত ভাগের এক ভাগ ঐ পরিমাণ যথেষ্ট যে পরিমাণের জন্য একটি ছাগল যথেষ্ট। (আহকামুল উযহিয়্যাহ ওয়ায যাকাত, পৃ. ৭)।
দ্বিতীয় পক্ষের প্রমাণাদি ও বক্তব্য:
(ক) নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হতে একটি পশুই যথেষ্ট:
এ বিষয়ে বর্ণিত হাদিসে মা আয়িশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি শিংওয়ালা সুন্দর সাদা-কালো দুম্বা আনতে বললেন, .. অত:পর এ দুআ পড়লেন-
«بسم الله اللهم تقبل من محمد وأل محمد ومن أمة محمد»
(আল্লাহ নামে, হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল করে নিন। এরপর উক্ত দুম্বা কোরবানি করলেন। (সহিহ মুসলীম, হাদিস নং ১৯৬৭)।
বিদায় হজ্জে আরাফার দিনে সমবেত জনমন্ডলীকে উদ্দেশ্য করে রাসূলুল্লাহ ( সা.) বলেন, হে জনগণ! নিশ্চয়ই প্রত্যেক পরিবারের উপরে প্রতি বছর একটি করে কোরবানি ও আতীরাহ। ইমাম আবু দাউদ বলেন, আতীরাহ প্রদানের হুকুম পরে বহিত করা হয়। [তিরমিযী, আবু দাউদ প্রভৃতি, মিশকাত, হা/১৪৭৮; এ হাদিসটির সনদ শক্তিশালী (ইবনু হাজার, ফতহুল বারী, ১০/৬); সনদ হাসান, আলবানী, সহিহ নাসাঈ, হ/৩৯৪০; সহিহ আবু দাউদ, হা/২৪২১; সহিহ তিরমিযী, হা/১২২৫; সহিহ ইবনু মাজাহ, হা/২৫৩৩]।
সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পরিবার পিছু একটি করে বকরী কোরবানি করার রেওয়াজ ছিল। যেমন- সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী (রা.) বলেন, একজন লোক একটি বকরী দ্বারা নিজের ও নিজের পরিবারের পক্ষ হতে কোরবানি দিতেন। অত:পর তা খেতেন ও অন্যকে খাওয়াতেন এবং এভাবে লোকেরা বড়াই করত। এ নিয়ম রাসূলের যুগ হতে চলে আসছে যেমন তুমি দেখছ। (সহিহ তিরমিযী, হা/১২১৬; সহিহ ইবনু মাজাহ, হা/২৫৪৬; মিরআত, ২/৩৬৭, ৫/১১৪) ।
একই মর্মে ধনাঢ্য সাহাবী আবু সারীহা (রা.) হতে সহিহ সনদে বর্ণিত ইবনু মাজার একটি হাদিস উদ্ধৃত করে ইমাম শাওকানী বলেন,সঠিক কথা হচ্ছে, একটি বকরি একটি পরিবারের পক্ষ হতে যথেষ্ট, যদিও সে পরিবারের সদস্য সংখ্যা শতাধিক হয় এবং এভাবেই নিয়ম চলে আসছে। (সহিহ ইবনু মাজাহ, হ/২৫৪৭; নায়লুল আওতার, ৬/১৪৪)।
মিশকাতের ভাষ্যকার ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রাহ.) বলেন, যারা একটি ছাগল একজনের জন্য নির্দিষ্ট বলেন এবং উক্ত হাদিসগুলোকে একক ব্যক্তির কোরবানিতে পরিবারের সওয়াবে অংশীদার হওয়ার তাবীল করেন বা খাস হুকুম মনে করেন কিংবা হাদিসগুলোকে মানসূখ বলতে চান, তাদের এ সব দাবী প্রকাশ্য সহিহ হাদিসের বিরোধী এবং তা প্রত্যাখ্যাত ও নিছক দাবী মাত্র । (মিরআত, ২/৩৫১, ৫/৭৬)।
রাসূল (সা.) মদীনায় মুক্বীম অবস্থায় নিজ পরিবার ও উম্মতের পক্ষ হতে দুটি করে খাসি এবং হজ্জের সফরে মিনায় গরু ও উট কোরবানি করেছেন। (মুত্তাফাক্বুন আলাইহ, মিশকাত, হা/১৪৫৩; বুখারি, ১/২৩১; সহিহ আবূ দাউদ, হা/১৫৩৯)।
কোরবানিতে শরীক হওয়া:
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রা.) বলেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। এমতাবস্থায় কোরবানির ঈদ উপস্থিত হলো। তখন আমরা সাতজনে একটি গরু ও দশজনে একটি উটে শরীক হলাম। (তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত, হা/১৪৬৯; সনদ সহিহ)।
জাবির (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সাথে হজ্জ ও উমরার সফরে সাথী ছিলাম।..... তখন আমরা একটি গরু ও উটে সাতজন করে শরীক হয়েছিলাম। (সহিহ মুসলিম, হা/১৩১৮) সফরে সাত বা দশজন মিলে একটি পরিবারের ন্যায়, যাতে গরু ও উটের মতো বড় পশু জবেহ ও কুটাবাছা এবং গোশত বণ্টন সহজ হয়। জমহুর বিদ্বানগণের মতে হজ্জের হাদির ন্যায় কোরবানিতেও শরীক হওয়া চলবে। (মরআত, ২/৩৫৫, ৫/৮৪)।
আনাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) হজ্জের সফরে মিনায় নিজ হাতে ৭টি উট (অন্য বর্ণনায় এরও অধিক) দাড়ানো অবস্থায় নহর করেছেন এবং মদীনায় (মুক্বীম অবস্থায়) দুটি সুন্দর শিংওয়ালা খাসি কোরবানি করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, বিদায় হজ্জের সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) তার সফরসঙ্গী স্ত্রী ও পরিবারের পক্ষ হতে একটি গরু কোরবানি করেন। (বুখারি, ১/২৩১; সহিহ আবু দাউদ, হা/১৫৩৯) অবশ্য মক্কায় (মিনায়) নহরকৃত উটগুলো সাহাবীগণের পক্ষ থেকেও হতে পারে।
আলোচনা: ইবনু আববাস (রা.) এর হাদিসটি নাসাঈ, তিরমিযী ও ইবনু মাজাহতে, জাবির (রা.) বর্ণিত হাদিসটি সহিহ মুসলিম ও আবুদাউদে এবং আনাস (রা.) বর্ণিত হাদিসটি সহিহ বুখারিতে সংকলিত হয়েছে। সহিহ মুসলিম ও সহিহ বুখারিতে যথাক্রমে হজ্জও মানসিক অধ্যায়ে এবং সুনানে কোরবানি অধ্যায়ে হাদিসগুলো এসেছে। যেমন-(১) তিরমিযী কোরবানিতে শরীক হওয়া অধ্যায়ে ইবনু আববাস, জাবির ও আলী (রা.) থেকে মোট তিনটি হাদি এনেছেন। (২) ইবনু মাজাহ উক্ত মর্মের শিরোনামে ইবনু আববাস,জাবির, আবূ হুরায়রা ও আয়েশা (রা.) হতে যে পাঁচটি হাদিস (৩১৩১-৩৪ নং) এনেছেন, তার সবগুলোই সফরে কোরবানি সংক্রান্ত। (৩৬) নাসাঈ কেবলমাত্র ইবনু আববাস ও জাবির (রা.) থেকে পূর্বের দুটি হাদিস (২৩৯৭-৯৮ নং) এনেছেন। (৪) আবু দাউদ শুধুমাত্র জাবির (রা.) এর পূর্ববর্ণিত সফরে কোরবানির হাদিসটি এনেছেন। তিনটি সহিহ সনদে (২৮০৭-৯ নং), যার মধ্যে ২৮০৮ নং হাদিরটিতে কোন ব্যাখ্যা নেই।
বিভ্রাটের কারণ: মিশকাত শরীফে ইবনু আববাস (রা.) এর সফরের হাদিসটি (১৪৬৯ নং) এবং জাবির (রা.) বর্ণিত ব্যাখ্যাশুন্য হাদিসটি (১৪৫৮ নং ) সংকলিত হয়েছে। সম্ভবত জাবির (রা.) বর্ণিত মুত্বলাক্ব বা ব্যাখ্যাশুন্য হাদিসটিকে ভিত্তি করেই মুক্বীম অবস্থায় গরু বা মহিষে সাতভাগা কোরবানির নিয়ম চালু হয়েছে। অথচ, ভাগের বিষয়টি সফরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা ইবনু আববাস ও জাবির (রা.) বর্ণিত বিস্তারিত হাদিসে উল্লেখিত হয়েছে। (মিশকাত, হা/১৪৬৯; মুসলিম , হা/১৩১৮; বুখারি, ১/২৩১) আর একই রাবীর বর্ণিত সংক্ষিপ্ত হাদিসের স্থলে বিস্তারিত ও ব্যাখ্যা সম্বলিত হাদিস দলীলের ক্ষেত্রে গ্রহণ করাই মুহাদ্দিসগণের সর্ববাদীসম্মত রীতি।
তাছাড়া, মুক্বীম অবস্থায় মদীনায় রাসূল (সা.) বা সাহাবায়ে কেরাম কখনো ভাগে কোরবানি করেছেন বলেও জানা যায় না। ইমাম মালিক (রাহ.) কোরবানিতে শরীক হওয়ার বিষয়টিকে মাকরূহ মনে করতেন। (মুওয়াত্বা মালেক, পৃ. ২৯৯)।
উভয় পক্ষের প্রদানকৃত দলীল সমূহের পর্যালোচনা: মুক্বীম অবস্থায় সাতটি পরিবারের সকল সদস্যের পক্ষ থেতে সাতটি ভাগ দিয়ে একটি উট বা গরু বা মহিষ ক্রয় করে করে কোরবানি করার ব্যাপারে উপরে উল্লেখিত উভয় পক্ষের উপস্থাপিত প্রমাণিত প্রমাণাদিকে বিশ্লেষণমূলক পর্যলোচনা করলে যে বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে, জাবির (রা.) বর্ণিত আবু দাউদদের ব্যাখ্যা শূন্য হাদিসটির কারণেই মুসাফির ও মুক্বীম অবস্থায় কোরবানিতে ভাগাভাগি নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমত: এ হাদিসটিতে কেবল বলা হচ্ছে, গরুতে সাতজন আর উটে সাতজন। এখানে সফর না মুক্বীম তা বলা হয়নি। কিন্তু এটি যে সফরের হাদিস তা জাবির (রা.) বর্ণিত অন্যান্য হাদিসগুলো দ্বারা প্রমাণিত।
দ্বিতীয়ত: জাবির (রা.) বর্ণিত সফরের হাদিসগুলো ইমাম আবূ দাউদ যে অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন এ ব্যাখ্যাশূন্য হাদিসটিও সে অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।
সর্বোপরি, উভয় পক্ষের মতের স্বপক্ষে উপস্থাপিত দলীলাদি পর্যালোচনা করলে আমাদের সামনে তিনটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তা হলে:
1. সফর ও মুক্বীম অবস্থায় একটি পরিবারের পক্ষ থেকে একটি পশু কোরবানি করার ব্যাপারে উভয় পক্ষই একমত।
2. ভাগে কোরবানি জায়েয।
3. সফর ও মুক্বীম অবস্থায় সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ভাগে একটি পশু কোরবানি করা যায়।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কিছু কথা না বললেই নয়, তা হলো- হাদিসে বলা হয়েছে, সাতজনের পক্ষ থেকে (মুসলিম, মিশকাত, হা/১৪৫৮), কিন্তু আমাদের সমাজে কোরবানি করা হচ্ছে সাত পরিবারের পক্ষ থেকে। বলা যায়, সফর অবস্থাতেও সাত পরিবারের পক্ষ থেকে অনুমতি নেই। আরো স্পষ্ট হলো, সাত জনের প্রেক্ষাপট কেবল সফর অবস্থায় সৃষ্টি হয়। মুক্বীম অবস্থায় কোরবানি পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত, যেমন- রাসূল (সা.) করতেন। মূলত, এক্ষেত্রে সফরের হাদিসগুলোকে আম হিসেবে ধরা যাচ্ছে না। কারণ, এ হাদিসগুলো রাসূলুল্লাহ (সা.) ও তার সাহাবীগণ (রা.) মুক্বীম অবস্থায় যে ভাগা কোরবানি করতেন, সে সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন হাদিস নেই। রাসূল (সা.) প্রতি বছর দুটি করে খাসি কোরবানি করতেন। (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত, হা/১৪৫৩) অথচ, দঃখের বিষয় বর্তমানে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়; বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের বর্তমানে কেবল সাত ব্যক্তির পক্ষ থেকে নয়; বরং মুক্বীম অবস্থায় সাত পরিবারের ৭-এর অধিক ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি গরু কোরবানি দেওয়া হচ্ছে।
আজকাল পরিবারের পক্ষ থেকে একটি ছাগল কোরবানির সাথে একটি গরুর ভাগা নেওয়া হচ্ছে মূলত গোশত বেশী পাবার স্বার্থে। নিয়ত যখন গোশত খাওয়া, তখন কোরবানির উদ্দেশ্য কিভাবে হাছিল হবে? কোরবানি হলো পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত, যা তিনি পুত্র ইসমাঈলের জীবনের বিনিময়ে করেছিলেন। আর তা ছিল আল্লাহর পক্ষ হতে পাঠানো একটি পশুর জীবন অর্থাৎ দুম্বা। অতএব ইবরাহীম ও মুহাম্মাদী সুন্নাতের অনুসরণে নিজের ও নিজ পরিবারের পক্ষ হতে আল্লাহর রাহে একটি জীবন তথা একটি পূর্ণাঙ্গ পশু কোরবানি দেওয়া উচিত, পশুর দেহের কোন খন্ডিত অংশ নয়। পরিশেষে, মনে রাখতে হবে কোরবানি হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত ও আল্লাহ রাববুল আলামিনের নৈকট্য লাভের উপায়। তাই তা আদায় করতে হবে সময়, সংখ্যা ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে শরীয়ত অনুমোদিত নিয়মাবলি অনুসরণ বা শুধু সদকা (দান) নয়।। কোরবানির উদ্দেশ্য শুধু গোশত খাওয়া নয়, শুধু মানুষের উপকার করা নয় বা শুধু সদকা (দান) নয়। কোরবানির উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ রাববুল আলামীনের একটি মহান নিদর্শন তার রাসূলের নির্দেশিত পদ্ধতিতে আদায় করা। প্রিয় নিউজ
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/রাসেল/এমআর