রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৬:০৯:২৯

জাকাত কি ও কেন?

জাকাত কি ও কেন?

কৃপণতা একটি মারাত্মক ব্যাধি যা ঈমান ও আমল উভয়কেই ধ্বংস করে দেয়। তাই অর্থ সম্পদ দান করাই কৃপণতা দোষ দূর করার উপায়। জাকাত মানে হচ্ছে পবিত্রতাকারী। অর্থাৎ জাকাত মুসলমানকে কৃপণতার মারাত্মক অপবিত্রতা থেকে মুক্ত করে। এই পবিত্রতা ততটুকুই হবে যতটুকু মানুষ দান করবে এবং ব্যয় করে মানুষ আনন্দ অনুভব করবে।

হজরত ইয়াহইয়া (আ.) একবার ইবলিসকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার কাছে মানুষের মধ্যে কে সর্বাধিক প্রিয় আর কে অধিক অপ্রিয়? ইবলিস উত্তর দিল, আমার কাছে সর্বাধিক প্রিয় হলো সেই লোক যে মু’মিন হলেও বখিল আর সবচেয়ে অপ্রিয় লোক হলো ফাসেক হওয়া সত্ত্বেও যে মহৎ ও দানশীল। আল্লাহর নবী হজরত ইয়াহইয়া(আ.) জিজ্ঞেস করলেন, এর কারণ কী? ইবলিস উত্তর দিলো, বখিলি এমন এক দোষ যে বখিল মোমেন হওয়ার পরও তার খারাপ পরিণতির ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত থাকে। কিন্তু মহৎ দানশীলতা এমন এক গুণ, আমার সর্বদা ভয় হয়, ফাসেক হওয়া সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাকে মাফ করে দেবেন। যাওয়ার সময় ইবলিস বলে গেলো, আপনি আল্লাহ নবী ইয়াহইয়া (আ.) না হলে এ কথা আমি কিছুতেই বলতাম না।

শয়তান মানুষকে দরিদ্রতার ভয় দেখায়। সেজন্য শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণকারীরাই কৃপণ।

প্রত্যেক মুসলমান একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তাকে জাকাত দিতে হবে, এটা মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত বিধান। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওই ব্যক্তির কাছ হতে জাকাত আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন যার ওপর জাকাত ফরজ হয়েছে চাই সে ব্যক্তি ছোট বা বড়, পুরুষ বা নারী, সুস্থ বা অসুস্থ বা মানসিক ভারসাম্যহীন।

মহান আল্লাহর বাণী, “তাদের সম্পদ থেকে জাকাত গ্রহণ কর যাতে তুমি তা দিয়ে তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করতে পার”-সূরা তওবা, আয়াত-১০৩।

মনে রাখতে হবে জাকাত দেওয়ার অর্থ যাকে জাকাতের টাকা দিলেন তার প্রতি অনুগ্রহ নয়। বরং আপনার সম্পদের ওপর এটা তার হক যা মহান আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। জাকাত হলো সম্পদের পবিত্রতা অর্জনের রাস্তা। এর এই রাস্তা নির্ধারণই আমার আপনার গন্তব্য ঠিক করে দেবে। আর পবিত্র সম্পদের অর্থ হলো হালাল সম্পদ, হালাল সম্পদ থেকেই হালাল রিজিক এবং সেই হালাল রিজিকই দোয়া কবুলের অন্যতম নিয়ামক। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নির্ধারিত মৃত্যুকে শুধুমাত্র দোয়া পিছিয়ে দিতে পারে আর পুণ্যই কেবল আয়ু বাড়াতে পারে।

সুস্থ মস্তিস্কে চিন্তা করলে দেখা যায় কেউ যদি বিজ্ঞানী হওয়ার আশা নিয়ে ইতিহাস চর্চা করতে থাকে তার দসা কী হবে? আবার কেউ যদি চিকিৎসক হতে গিয়ে অঙ্ক শাস্ত্র নিয়ে মাতামাতি করে তাহলে তার কী হবে? ঠিক তেমনি মহান আল্লাহর নির্ধারিত সম্পদ পবিত্র করার রাস্তা বাদ দিয়ে কেউ যদি তার নিজের মতো বিবেচনা করে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে নিজেকে বড় দানবির ভেবে আত্মতৃপ্তি লাভ করে সে তা তারই একান্ত বাস্তব বিবর্জিত চিন্তা ভাবনা, যা মানুষকে কুপথেই নিয়ে যাবে। সমাজে এখন নতুন সব চিন্তা ভাবনা লক্ষ করা যায়, যেমন জাকাতের কাপড়, জাকাতের লুঙ্গি ইত্যাদি। এ শব্দগুলো কাদের আবিষ্কার? আর আবিষ্কার যারই হোক, কোরআন হাদিসে যে শব্দগুলো নেই সেগুলো যতই তৃপ্তিদায়ক হোক না কেন তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। জাকাতের কাপড় লুঙ্গি ইত্যাদির নামে অনাচার চলছে। যিনি তথাকথিত জাকাতের জামা কাপড় বিতরণ করেন তিনি কী একবার ভেবে দেখেছেন ওই কাপড় বা বস্তু নিজের স্ত্রী সন্তান পিতা মাতা বা অন্য যে কোনো নিকটআত্মীয় বা নিজে পরবেন কি না? যদি না পরেন তাহলে কেন অন্যের জন্য ওই কাপড় নির্দিষ্ট করলেন? ভেবে দেখবেন একবার? এই নিন্মমানের পণ্য বিতরণের মাধ্যমে নিজের জাকাত আদায়ের যেমন ক্ষতি হচ্ছে তেমনি ঈমানেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

হজরত আনাছ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোনো ব্যক্তি সেই পর্যন্ত মু’মিন হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে অন্য মুসলমান ভাইয়ের জন্য ঠিক সেইরূপ ব্যবস্থা ও ব্যবহার পছন্দ করে, যেরূপ ব্যবস্থা ও ব্যবহার নিজের জন্য পছন্দ করে। বোখারী শরীফ,১ম খণ্ড,হাদিস নম্বর-১২।

যারা পরকালের আশা করেন তাদের জন্য জাকাত প্রদানে কয়েকটি আদব মানতে হবে।

প্রথমত: জাকাত কেন দিতে হবে তা বুঝতে হবে। এটা কোনো দৈহিক ইবাদত নয়। এটি একটি আর্থিক ইবাদত। তারপরও কেন জাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ এটা বুঝতে হবে।

জাকাতের প্রধান উদ্দেশ্য দারিদ্র দূরীকরণ। কারো জাকাত যদি একলাখ টাকা হয় তাহলে যদি ওই টাকা এক হাজারজনকে জনপ্রতি একশ’ টাকা করে দেওয়া হয় তাহলে একথা সবাই মানবেন যে তাহলে দারিদ্র দূর তো হবেই না বরং দারিদ্র পালন হবে। তার চাইতে ওই এক লাখ টাকা একজনকে বা একটি পরিবারকে দিয়ে তার আয়ের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে দিলে তাকে আর পরবর্তী বছর জাকাতের টাকার জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে জাকাতের কথা বার বার বলেছেন, তাঁর প্রিয় হাবিব মহানবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও জাকাত আদায়ের ব্যাপারে তাগিদ দিয়েছেন। জাকাতের মাধ্যমে সামাজিক উপকার হয়, দরিদ্রতা দূর হয়। ফলে সামাজিক স্থিরতা থাকে, যিনি জাকাত দিলেন বা দান করলেন তারও অশেষ সওয়াব হাসিল হয়, সামাজিক সম্প্রীতির মাধ্যমে ধনী দরিদ্র সবাই হাসিখুশি থাকে এবং সেই সঙ্গে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে ইহজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো যায়। ঈমানের সঙ্গে মৃত্যু নসীব হয় এবং আল্লাহর হাবীব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ফেরেশতাকুলের অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকা যায়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, “জাকাত হলো কেবল ফকির,মিসকিন,জাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাস মুক্তির জন্য, ঋণ গ্রস্থদের জন্য, আল্লাহর পথে জেহাদ কারিদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য,এই হল আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।’’ সূরা তওবা,আয়াত-৬০।

ঈমাম গাজ্জালির (র.) মতে জাকাত ওয়াজিব হওয়ার কারণ তিনটি। প্রথমটি হলো- কালেমায়ে শাহাদাত। কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের মানে হলো তাওহীদকে সুসংহত করা, আল্লাহ তা’আলার একত্ত্ববাদের সাক্ষ্য প্রদান করা। মহব্বত যত বেশি তাওহিদ তত মজবুত হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই তাওহিদে মহব্বত আছে কি না তা প্রিয় বস্তুর বিচ্ছেদ দ্বারা পরীক্ষা করা যায়। যেহেতু মানুষের কাছে তার মাল ও ধন সম্পদ অত্যধিক প্রিয়। দুনিয়াতে মানুষ মাল কড়িকে অত্যধিক ভালোবাসে এবং মৃত্যুকে অত্যধিক ঘৃণা করে। অথচ মৃত্যুর মাধ্যমে পরম আরাধ্য মহান আল্লাহর সাক্ষাৎ ঘটে।

তাই মানুষের সবচেয়ে কাম্য প্রিয় বস্তু আল্লাহর পথে বিসর্জন দিতে বলা হয়েছে।আর সেই বিসর্জন তিনিই অনায়াসে করতে পারেন যার ভালোবাসা মৌখিক কপটতায় পূর্ণ নয় বরং আত্মিক। সেই জন্যই মহান আল্লাহ বলেছেন “আল্লাহ মু’মিনদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে ক্রয় করেছেন”।

দ্বিতীয় কারণ হলো- মানুষকে কৃপণতা দোষ থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য থাকাতেই জাকাত ওয়াজিব হয়েছে।

আর তৃতীয় কারণ হলো- নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা।কারণ মহান আল্লাহ তা’য়ালা যাকে এতো সম্পদের মালিক করেছেন সে যদি গরীব দুঃখিকে নিজের কাছে হাত পাততে দেখে ও মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ জাকাত আদায় বা অন্যান্য দান খয়রাত না করে তাহলে সে অত্যন্ত নিচ।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ওই ব্যক্তির জন্য সু-সংবাদ যে জাকাত ও উশর প্রদান করে; কেয়ামতের দিন সে সব ধরনের আজাব থেকে সুরক্ষিত থাকবে,কবর আজাব থেকে নাজাত পাবে,তার দেহ জাহান্নামের জন্য হারাম করে দেওয়া হবে,বিনা হিসেবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং কেয়ামতের দিন সে পিপাসার্ত হবে না।
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/জহির/মো:জই/

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে