সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:০৩:৪৮

ক্বারী ওবায়দুল্লাহর সেই সুললিত কণ্ঠ নেই, রোগ-দারিদ্র্যতায় ধুকছেন

ক্বারী ওবায়দুল্লাহর সেই সুললিত কণ্ঠ নেই, রোগ-দারিদ্র্যতায় ধুকছেন

ইসলাম ডেস্ক : ক্বারী উবায়দুল্লাহ আজ ভালো নেই। বয়সের ভারে ন্যুজ ৯ বছর ধরে অসুস্থ। ছয়বার ব্রেইন স্ট্রোক ও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে আজ ধুকে ধুকে মরতে বসেছেন তিনি।

অথচ এই ক্বারী উবায়দুল্লাহ বাংলাদেশের একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। তার সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত কে শোনেনি, সেই  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে আবাল বৃদ্ধ-বনিতা সবাই তার তেলাওয়াত শোনে মুগ্ধ হয়েছেন।

আজও বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে কোটি কোটি মানুষ সুমিষ্টস্বরের যে হৃদয়গ্রাহী আজানের ধ্বনি শুনছেন তাও ক্বারী উবায়দুল্লাহর কণ্ঠের রেকর্ড।

জানা গেছে, ক্বারী উবায়দুল্লাহ ২০০০ সালে প্রথমবারের মত হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ওই সময় চিকিৎসা করার পর তিনি সুস্থ হন।

এর ছয় বছর পর ২০০৬ সালে ঢাকার বাইরে একটি ওয়াজ মাহফিলে যাওয়ার সময় পান্থপথ এলাকায় ব্রেনস্ট্রোকের শিকার হলে তাকে শমরিতা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অধ্যাপক ডা. দ্বীন মোহাম্মদের তত্ত্বাবধানে দু'মাস চিকিৎসা নেন তিনি। এসময় চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেন তিনি।

পরবর্তীতে তাকে ভারতের কলকাতায় নিয়ে এএমআরআই হাসপাতালে অধ্যাপক জিকে পুস্তির তত্ত্বাবধানে ১৫ দিন চিকিৎসা দেয়া হলে তিনি কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে চলাফেরা করতে শুরু করেন তিনি।

দু'বছর পর ২০০৮ সাল থেকে পরপর তিন বছর ব্রেনস্ট্রোকের শিকার হন তিনি। আবার দু’বছর পর ২০১২ সালে সর্বশেষ ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হন তিনি। তখন থেকেই রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের বাসায় অসুস্থ অবস্থায় দিন পার করছেন তিনি।

যেভাবে হলেন ক্বারী উবায়দুল্লাহ

১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার কোদালা গ্রামে জন্ম নেন ক্বারী উবায়দুল্লাহ। তার বাবা হলেন আল্লামা শাহ মেহেরুজ্জামান ইসলামাবাদী। শৈশব-কৈশোরেই তার সুললিত কণ্ঠে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শুনে পরিচিত জনরা মুগ্ধ হতে শুরু করেন।

ক্বারী উবায়দুল্লাহ ছোট বেলায় বাবার কাছে কায়দা পড়ার পর লালবাগ মাদরাসায় মক্তব বিভাগে। সেখানে তিনি হাফেজ্জী হুজুর (রহ) এবং শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের (রহ) কাছে পড়েছেন। শায়খুল হাদিস তাকে বোখারী শরিফ পড়িয়েছেন।

১৯৬২ সালে তিনি মাওলানা পাশ করলে শায়খুল হাদীস তাকে লালবাগ মাদরাসাতেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বোখারী শরিফ পড়ানোর দায়িত্ব দেন।

ওই বছরই মাত্র ১৮ বছর বয়সে নাজিমুদ্দিন রোডে অবস্থিত রেডিও পাকিস্তান কেন্দ্রে প্রথম কোরআন তেলাওয়াত করে ক্বারী উবায়দুল্লাহ। তার কণ্ঠে সূরা ফাতেহার তেলাওয়াত শুনে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে।

তারপর শুরু হল বাংলাদেশি মুসলমানের জীবনের এক নতুন সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষ যেন ক্বারীর  কণ্ঠে ‘ফাবিআইয়ি আলা ইরাব্বিকুমা তুকাযযিবান’-এর মতো সুরময় কোরআনের নানা ছন্দে নিজের সারা দিনটিকে রাঙিয়ে নিতে উন্মুখ হয়ে থাকত। তাই প্রতিদিন ফজর নামাজের পর রেডিওর পাশে বসে থেকে ক্বারী ওবায়দুল্লাহর কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত শুনতেন।

এরপর ১৯৬৫ সালে প্রথম চালু হওয়া পাকিস্তান টেলিভিশনেও নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতেন ক্বারী উবায়দুল্লাহ।

একাত্তরে দেশ স্বাধীন হলে ক্বারী উবায়দুল্লাহর সমাদার বাড়ে রাষ্ট্র ও সমাজে। ফলে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশ বেতারে প্রথম যে সুর ধ্বনি বেজে উঠল সেও ক্বারী উবায়দুল্লাহর কণ্ঠে ‘জালিকাল কিতাবু লা রাইবা ফিহ’।

এরপর ১৯৭৫ সালে বিটিভি যার তেলাওয়াতের মাধ্যমে উদ্বোধন হল তিনিও ক্বারী উবায়দুল্লাহ। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সেই শুরুর অধিবেশন থেকে ৯ম পার্লামেন্ট পর্যন্ত আমাদের জাতীয় সংসদকেও কোরআনের মধুর সুরে মুখরিত করে রেখেছিলেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু ও শহীদ জিয়াও তেলাওয়াতের ভক্ত ছিলেন
ক্বারী উবায়দুল্লাহর সুমধুর কুরআন তেলাওয়াতের ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ক্বারী সাহেবের তেলাওয়াত শুনতে শুক্রবারই চকবাজার শাহী মসজিদে জুমার নামাজ পড়তেন বঙ্গবন্ধু। নামাজের পর বঙ্গবন্ধু ক্বারী উবায়দুল্লাহর বুকে বুক মিলিয়ে তার কুশলাদি জেনে ও দোয়া নিয়ে বিদায় নিতেন।

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন ক্বারী উবায়দুল্লাহর ছাত্র। তিনি দীর্ঘদিন তার কাছে কোরআন শিক্ষা করেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন শহীদ জিয়া বিভিন্ন সময়ে কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য তাকে বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেতেন।

এদিকে ক্বারী ওবায়দুল্লাহর তেলাওয়াত শুনে অত্যন্ত বিমোহিত হতেন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল ও খালেদ। তারা দুইবার তাকে কোরআনের শিল্পী বা ক্বারী হিসেবে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন।

ক্বারী উবায়দুল্লাহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করে ব্যাপকভাবে সম্মানিত হন।
তিনি বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বারবার প্রথম স্থান অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনেন বিরল মর্যাদা।

বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সৌদি আরব, লিবিয়া, জর্দান, ইরাক, আরব আমিরাত, কাতার, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, বার্মা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ ৩৩টি দেশ সফর করেছেন তিনি।

এদিকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, নিউমার্কেট, হোটেল শেরাটনসহ জাতীয় অসংখ্য স্থাপনার উদ্বোধন হয়েছে তার তেলাওয়াতের মাধ্যমে।

ভাগ্য বিড়ম্বনা
ক্বারী উবায়দুল্লাহ ১৯৬২ সাল থেকে ঐতিহ্যবাহী চকবাজার শাহী মসজিদে খতিবের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর থেকে নামাজ পড়াতে না পারলেও তাকে নিয়মিত সম্মানী দিয়ে যাচ্ছে মসজিদ কর্তৃপক্ষ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালেই সরকার ক্বারী উবায়দুল্লাহকে থাকার জন্য একটা বাড়ি বরাদ্দ দেয়। তাকে চকবাজার মডেল থানার চাঁদনীঘাট এলাকার গৌর সুন্দর রায় লেনের ৩৩/৩৭ নম্বর বাড়ির সাড়ে ৮ কাঠার মধ্যে ৪ কাঠা জমির বন্দোবস্ত দেয়া হয়।

এই বাড়িতেই ২ স্ত্রী, ২ ছেলে ও ৬ মেয়েকে নিয়ে বসবাস করতেন ক্বারী উবায়দুল্লাহ। বিভিন্ন সরকারের সময়ে বাড়ির বরাদ্দ পাওয়া অংশটি তার নামে সাব-কবলা দলিল করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও পরে আর তা করেনি।

এর মধ্যেই বরাদ্দের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। এই সুযোগে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের গেজেটভূক্ত বাড়িটি মামলা ও জালিয়াতির মাধ্যমে দখল করে নেয় স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল। সেখানে একটি বহুতল বাড়ির নির্মাণ চলছে।

অন্যদিকে বৃদ্ধ বয়সে গৃহচ্যুত হয়ে পথে দাঁড়ানো ক্বারী উবায়দুল্লাহ বাধ্য হয়ে মূল ঢাকা শহর ছেড়ে বুড়িগঙ্গার ওপারে কামরাঙ্গীরচরে চলে যেতে হয় তাকে।

কামরাঙ্গীরচরের নিজামবাগ এলাকার মাতবর বাজারে স্ত্রীর নামে কেনা জমিতে শাশুড়ির নামে প্রতিষ্ঠিত আক্তার বানু নূরানী মাদ্রাসা। এই মাদ্রাসার ভবনেই এসে আশ্রয় নেন ক্বারী উবায়দুল্লাহ ও তার স্ত্রী। ইতোমধ্যে ছেলে ও মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
 
অনেক কৃতিত্বের অধিকারী হলেও মাত্র ৭১ বছর বয়সেই ভেঙে পড়েছেন ক্বারী উবায়দুল্লাহ। ছয়বার ব্রেইন স্ট্রোক ও প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে গত ৯ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি অসুস্থ।

একদিন যে সুর দিয়ে গোটা পৃথিবীকে মাতিয়ে ছিলেন আজ আর সেই সুর নেই তার কণ্ঠে। কথা বলেন হাতের ইশারা-ইঙ্গিতে।

কেউ ক্বারী উবায়দুল্লাহর খোঁজ খবরও নেয় না। দেশে গানের শিল্পীসহ নানা ক্ষেত্রের মানুষের অসুখে-বিসুখে গণমাধ্যম ও সুধীজনের ব্যাপক সংবেদনশীল আচরণ করে।

কিন্তু বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম একটি বাতিঘর আলগোছে নিভে যাচ্ছে। একটু একটু করে ফুরিয়ে তার জীবনী শক্তি। অথচ কেউ তার খবরও রাখে না। যেন ক্বারী উবায়দুল্লাহর আগেই ফুরিয়ে গেছে এদেশের হৃদয়বান মানুষ!

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে