হাসান মোল্লা : দেশব্যাপী বিএনপির মাঠ পর্যায়ের কমিটি গঠনের জন্য বেঁধে দেয়া সময় বুধবার শেষ হয়েছে। একমাস ২১ দিনের নির্ধারিত সময় শেষে তৃণমূল থেকে একটি ফিরতি চিঠিও পায়নি কেন্দ্র। সারাদেশ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় আরো একমাস সময় বাড়ানো হবে। এরপরও কোনো সাড়া না মিললে কেন্দ্র থেকেই কমিটি গঠন করে দেয়া হবে।
গত ৯ আগস্ট 'দলকে অধিকতর সংগঠিত ও সক্রিয় করা প্রসঙ্গে' শিরোনামে একটি চিঠি জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের কাছে চিঠি পাঠায় কেন্দ্রীয় বিএনপি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের পক্ষ থেকে দলের যুগ্ম মহাসচিব মো. শাহজাহান ওই চিঠি পাঠান। তিন পৃষ্ঠার চিঠিতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, থানা ও পৌর এলাকায় প্রতিনিধিদের সম্মেলনের মাধ্যমে দলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়।
এ সময়ের মধ্যে কমিটি করতে ব্যর্থ হলে কেন্দ্রের পক্ষ থেকে নতুন কমিটি গঠন করে দেয়ার হুশিয়ারি দেয়া হয়। কমিটি গঠনে এলাকার স্থায়ী কমিটির সদস্য, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সাবেক সাংসদসহ দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সহযোগিতা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। একই সঙ্গে অনিবার্যকারণে দায়িত্ব পালনে সক্ষম নন, এমন প্রবীণ ও যোগ্য নেতাদের দলীয় কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রাখতে সব পর্যায়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করতে বলা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের শেষদিন অর্থাৎ গত বুধবার পর্যন্ত কোনো কমিটি গঠনের লিখিত তালিকা পায়নি কেন্দ্র। কয়েকটি স্থানে কার্যক্রম শুরু হলেও মৌখিকভাবে কেন্দ্রে এসেছে বিস্তর অভিযোগ। আর অধিকাংশ স্থানেই শুরু হয়নি কোনো কার্যক্রম। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, তৃণমূলের অনেক নেতা এখনো আত্মগোপন থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অনেকে আছেন জেলে। আর কিছু কিছু স্থানে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে স্বল্প সময়ে কমিটি গঠন করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া কেন্দ্র থেকে সক্রিয়দের নেতৃত্বে আনতে নিষ্ক্রিয়দের দায়িত্ব দেয়ার কারণেই মূলত পুনর্গঠন কার্যক্রম একেবারেই এগুচ্ছে না।
সারাদেশে বিএনপির ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার অধীন সাড়ে ৭ শতাধিক ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা ও পৌর কমিটি রয়েছে। তৃণমূলে কমিটি গঠনের এই প্রক্রিয়া শেষে জেলা সম্মেলনের কাজে হাত দেবে বিএনপি। বেঁধে দেয়া সময়ের শেষ পর্যায়ে নয়া পল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দপ্তরের নেতারা সুনির্দিষ্টভাবে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দপ্তরের এক নেতা জানান, জেলা বা মহানগর পর্যায়ের কমিটি গঠনের কোনো ধরনের তথ্য নেই দপ্তরে। তবে দেশের অধিকাংশ থানা কমিটি গঠনের কিছু তথ্য মৌখিকভাবে তারা পেয়েছে।
এর মধ্যে বরিশাল বিভাগের বরগুনা ও পিরোজপুর ছাড়া বাকি থানা, পঞ্চগর ছাড়া রংপুর বিভাগের থানা, রাজশাহী মহানগর, বগুড়া, নাটোর ছাড়া রাজশাহী বিভাগের থানা, চট্টগাম মহানগর, কুমিল্লা দক্ষিণ ছাড়া চট্টগ্রাম বিভাগের থানা, ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ উত্তর ও দক্ষিণ ছাড়া ঢাকা বিভাগের থানা এবং সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ ছাড়া সিলেট বিভাগের থানা কমিটি গঠনের কাজ শেষ হয়েছে। যেসব থানা কমিটি গঠন করা সম্ভব হয়নি সেইসব কমিটি দ্রুত গঠন করতে বলা হয়েছে।
দপ্তরের অপর একটি সূত্র জানায়, জেলা পর্যায়ে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রাঙ্গামাটি, নীলফামারী, সৈয়দপুরসহ আটটি জেলা সম্মেলন করার জন্য কেন্দ্রের কাছে মৌখিক অনুমতি চেয়েছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে প্রায় ১৫টি জেলায় স্থানীয় পর্যায়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা সম্ভব নয় বলে কেন্দ্র নিশ্চিত হয়েছে। ফলে শিগগিরই এসব কমিটি ভেঙে দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি গঠন করে দেয়া হতে পারে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই তৃণমূলে হাত দেয়ায় স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। আন্দোলনে জীবনবাজি রেখে যারা মাঠে ছিলেন তাদের কমিটি গঠনের জন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ের যেসব নেতা নিরাপদ আশ্রয়ে ছিলেন তাদের পরামর্শ নেয়ার কথাটা মেনে নিতে পারেনি অনেকে। সঙ্গত কারণে তৃণমূলের নেতারা অভিমান করেই এই চিঠির জবাব দেয়ার জন্য যথাযথ উদ্যোগী হয়নি। এর ফল পাওয়া গেল সময় শেষ হওয়ার পরেও সারাদেশ থেকে একটিও কমিটি গঠন না হওয়ার মধ্য দিয়ে।
বিএনপির এই নেতার মতে, দীর্ঘ মেয়াদের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর দল পুনর্গঠনের ফর্মুলা পরিকল্পিত ছিল না। ফলে তুণমূল থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তাই সুপরিকল্পিতভাবে নতুন কিছু বিষয় সংযোজন করে কমিটি গঠনের জন্য ১ মাস সময় বাড়িয়ে দেয়া হবে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব চিকিৎসার জন্য সাংগঠনিক কাজে সময় দিতে না পারায় পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এগুয়নি। আজ থেকে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড শুরু করবেন। দিনের যে কোনো সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন তিনি। এ ছাড়া দলের চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর পুরোদমে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হবে। আগামী ৮ অক্টোবরের আগে খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন না। এ সময় মির্জা আলমগীর চেয়ারপারসনের নির্দেশে দলের সাংগঠনিক সব দায়িত্ব পালন করবেন।
বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে বিএনপির পুনর্গঠনের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, কমিটি গঠনের কার্যক্রম চলছে খবুই ধীরগতিতে। অধিকাংশ নেতাকর্মী কারাগারে এবং মামলার কারণে আদালতেই বেশি সময় দিতে হচ্ছে বলেই সাংগঠনিক কাজে গতি পাওয়া যাচ্ছে না। এরপরও কাজ হচ্ছে। আগামী ডিসেম্বরে দলের জাতীয় কাউন্সিল করার যে পরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য সুষ্ঠুভাবেই সব পর্যায়ের কমিটি গঠন শিগগিরই সম্পন্ন হবে।
সময়সীমা বেঁধে দিয়ে চিঠি দেয়া দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহানের দাবি, ৮০ শতাংশ কমিটি গঠন হয়েছে। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সারাদেশে ইউনিয়ন, থানা, উপজেলা ও পৌরসভায় কমিটি গঠনের কাজ এগিয়ে চলছে। নির্ধারিত সময় পেরোনোর পরই এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব। কমিটি গঠনের সময় বাড়ানো হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে সময় বৃদ্ধি করা হবে না। তবে যেসব কারণে বিভিন্ন জায়গায় কমিটি বিলম্ব হচ্ছে, তা যদি যুক্তিযুক্ত হয়, অবশ্যই তাদের সময় দেয়া হবে।
একই বিষয়ে দলের মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, নতুন করে কমিটি গঠন, চিঠি, বেঁধে সময়সহ পুনর্গঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতারা কোনো ধরনের তথ্য তাকে জানায়নি। সঙ্গত কারণে এ বিষয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে বিভিন্ন মামলায় নেতাদের কারাবন্দি করে এই প্রক্রিয়ায় সরকার বাধা দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এদিকে মাঠ পর্যায়ে খবর নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর প্রথমে মাঠপর্যায়ে পুনর্গঠনে হাত দেয়ায় শুরু থেকেই ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতাকর্মী। দলের এমন বিধ্বস্ত অবস্থায় তাগাদা দিয়ে কেন্দ্র চিঠি দেয়ায় তারা হতবাকও হয়েছেন। অধিকাংশ তৃণমূল নেতারা কেন্দ্রকে পরিষ্কার জানিয়েছে, তাদের পক্ষে এই সময়ের মধ্যে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কমিটি গঠন করা সম্ভব নয়। কারণ মামলার কারণে অধিকাংশ নেতাদের আদালত চত্বরে সময় কাটাতে হচ্ছে। দ্রুতগতিতে সাংগঠনিক কাজ করা সম্ভব নয়। আবার অনেকে এই চিটি পাওয়ার পরও ক্ষুব্ধ হয়ে কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি।
আবার অনেকে চিঠির কার্যক্রম স্থগিত করার অনুরোধ করেছেন কেন্দ্রকে। বেঁধে দেয়া সময়ের প্রায় শেষ পর্যায়ে বুধবার কমিটি গঠনের কার্যক্রম জানতে চাইলে মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানা বিএনপির সভাপতি ও জাসাসের সহ-সাধারণ সম্পাদক দারাদ আহমদ জানান, কোনো কার্যক্রমই শুরু হয়নি তার থানায়। এর কারণ হচ্ছে, জেলার মহানগর পর্যায়ে চিঠি দেয়া হয়েছে শুনেছি। কিন্তু থানা পর্যায়ে কেন্দ্র থেকে কোনো চিঠি দেয়া হয়নি। আর জেলা থেকে কমিটি গঠনের কোনো নির্দেশনাও দেয়নি। ফলে কমিটি গঠনের কোনো কাজ হয়নি। এ ছাড়া আশপাশের থানাগুলো খবর নিয়ে জেনেছি, কোথাও কার্যক্রম শুরু হয়নি।
একই বিষয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি শাহ সারওয়ার হোসেন বলেন, কেন্দ্র থেকে বলেছে যারা আন্দোলনে ছিল তাদের দিয়ে কমিটি গঠন করতে। এজন্যই কমিটি গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ যাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তারা অধিকাংশই আন্দোলনে ছিল না। তিনি আরো জানান, চিঠি দিয়ে দল পুনর্গঠনের তাগাদা দেয়ায় আন্দোলনে ভূমিকা রাখা নেতারা আরো বেকাদায় আছেন। যারা সক্রিয় এবং নতুনভাবে নেতৃত্বে আসতে পারেন তারা যাতে কমিটিতে আসতে না পারেন সেজন্য নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাবাদীরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না। ঈদের মধ্যেও প্রশাসনের সঙ্গে হাত করে দলের নিষ্ক্রিয়রাই তাকে এলাকায় ঢুকতে বাধা দিয়েছিল বলেও অভিযোগ করেন তিনি।-যায়যায়দিন
১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে