বৃহস্পতিবার, ০১ অক্টোবর, ২০১৫, ০৪:২৪:৫৬

খুন করে ফোনে যা বলেছিলো খুনিরা

খুন করে ফোনে যা বলেছিলো খুনিরা

মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু ও সৈয়দ আতিক : ‘বস, ফিনিশ্ড। তোমরা কোথায়? এ মুহূর্তে ডিওএইচএস। ওকে, দ্রুত সরে যাও। ওই নম্বরে কল দিও, কথা হবে।’ ১৮ সেকেন্ডের এ টেলি কথোপকথন এখন ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যার প্রধান ক্লু। সোমবার গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কে চাঞ্চল্যকর ওই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২০ মিনিট পর এয়ারটেল ও বাংলালিংকের দুটি মোবাইল ফোনের এ কথোপকথনের রেকর্ড এখন গোয়েন্দাদের হাতে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৮ মিনিট ৪২ সেকেন্ড থেকে ৬টা ৩৯ মিনিট ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত মোট ১৮ সেকেন্ড ওই মোবাইল নম্বর দুটিতে দু’জনের (সন্দেহভাজন ঘাতক) মধ্যে কথা হয়।

এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের সময় বাংলালিংক নম্বরের ফোনটির অবস্থান ছিল ঘটনাস্থলের আশপাশে। ১৮ সেকেন্ড কথা বলার পর থেকেই ওই মোবাইল ফোন দুটি বন্ধ রয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, কিলিং মিশন শেষে ঘাতকদের কেউ ফোন করে বিষয়টি জানিয়েছিল। সন্দেহভাজন ওই দুটি মোবাইল নম্বর শনাক্তের পর বুধবার তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করে সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা। তবে ভুয়া রেজিস্ট্রেশনে মোবাইল সিম ব্যবহার করায় গোয়েন্দা সংস্থাটি ঘাতকদের অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেনি।

এদিকে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লার এক বান্ধবীকে খুঁজছে গোয়েন্দারা। ডাচ নাগরিক ওই মহিলার নাম নিগার রিগ্যাল। মঙ্গলবার সিজারি তাভেল্লার গুলশানের বাসা থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন থেকে নিগার রিগ্যালের সঙ্গে তার (তাভেল্লা) ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এর সূত্র ধরেই গোয়েন্দারা তার সঙ্গে কথা বলতে চায়। তবে বুধবার রাত ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত গোয়েন্দারা তার সন্ধান পায়নি। গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, নিগার রিগ্যালকে পাওয়া গেলে তাভেল্লার ব্যাপারে কিছু তথ্য জানা যেতে পারে। বিশেষ করে তাভেল্লার সঙ্গে কারও শত্রুতা ছিল কিনা কিংবা কেউ তাকে হুমকি দিয়েছিল কিনা সে বিষয়গুলো জানার চেষ্টা করা হবে বলে গোয়েন্দারা জানান।

এদিকে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ১১ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গোয়েন্দা পুলিশের ডিসি (পূর্ব) মাহবুব আলমকে প্রধান করে গঠিত এ কমিটিতে ডিবির চারটি জোনের (উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি), সহকারী কমিশনার (এসি) ও পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পর্যায়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন। বুধবার সকালে কমিটি গঠনের পর দুপুরে তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

এ সময় কমিটির সদস্যরা আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। অন্যদিকে ইতালি নাগরিক খুনের ঘটনায় তদন্তে কারিগরি সহায়তার জন্য এফবিআইও সহায়তার জন্য তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। বাংলাদেশের আইনশৃংখলা বাহিনীর পক্ষে বলা হয়েছে, তদন্তে কোনো ধরনের প্রয়োজনীয়তা হলে তারা এফবিআইকে জানাবে।

চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বুধবার প্রতিবেদককে বলেছেন, চারটি বিষয় সামনে রেখে তারা তদন্তকাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যে ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক, জঙ্গি ও এনজিও-সংক্রান্ত কোনো বিরোধ আছে কিনা সে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

অন্যদিকে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সংশ্লিষ্টতা নেই বলে একমত পোষণ করেছে বাংলাদেশ ও ইতালি। বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও ইতালির রাষ্ট্রদূত মারিও পালমার মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, এ দেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে সিজারি তাভেল্লা হত্যাকাণ্ডের পর একটি ওয়েবসাইটে আইএস এর দায় স্বীকারের যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে সেটি উভয় দেশ খতিয়ে দেখছে বলে তিনি জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিজারি তাভেল্লা হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ সরকারের নেয়া পদক্ষেপে সে দেশের রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসি ক্যামেরা থেকে কিছু ভিডিও ফুটেজ পাওয়া গেছে। তবে সেগুলো খুব বেশি স্পষ্ট নয়। এগুলো থেকে সন্দেহভাজন ঘাতকদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।

চাঞ্চল্যকর এ মামলার ছায়া তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেছেন, তাভেল্লা খুন হওয়ার আগে ও পরে কাছাকাছি সময়ে ঘটনাস্থলের আশপাশের মোবাইল ফোন টাওয়ারের নেটওয়ার্কের আওতায় যারা কথাবার্তা বলেছেন তাদের মধ্যে ২২ জনকে সন্দেহের তালিকায় রেখে তারা প্রথম থেকেই অনুসন্ধান শুরু করেন। এসব গ্রাহকের কললিস্ট পর্যালোচনার পাশাপাশি তাদের পিসিআর (প্রিভিয়াস ক্রাইম রেকর্ড) খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সন্দেহভাজনদের এসব ফোনে এরই মধ্যে আড়িপাতা হয়েছে। তবে সোমবার সন্ধ্যায় গুলশানের ৯০ নম্বর সড়কে ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা খুন হওয়ার প্রায় ২০ মিনিট পর দুটি মোবাইল ফোনে সন্দেহজনক কথোপকথনের রেকর্ড হাতে আসার পর গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসেছেন।

ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, ফোন দুটির (০১৯১২৬----৫২) ও ০১৮১৯----১৫) ‘ভয়েজ রেকর্ড’ তাদের হাতে এসেছে। তবে ঘটনার পর থেকেই মোবাইল ফোন দুটি বন্ধ রয়েছে। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেছেন, মাত্র এক সপ্তাহ আগে একই সঙ্গে ওই সিম দুটি মিরপুর এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। গত এক সপ্তাহে ওই দুটি মোবাইল নম্বরে ৩৮ দফা কথা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো নম্বরে ওই মোবাইল থেকে ফোন করা হয়নি। ওই মোবাইল ফোনের রেজিস্ট্রেশনের সূত্র ধরে গোয়েন্দারা সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় খোঁজ নিলে সেখানে ওই নামে কাউকে পাননি। এ থেকে গোয়েন্দাদের ধারণা, ঘাতকরা ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ওই সিম সংগ্রহ করেছিল। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ঘাতকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ধূর্ত প্রকৃতির।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সিজারি তাভেল্লা ‘আইসিসিও বিডি’ নামে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক যে এনজিওতে কাজ করতেন ওই প্রতিষ্ঠানে অনুদানপ্রাপ্তিসহ প্রজেক্টভিত্তিক আনুষঙ্গিক বিষয়াদিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই এনজিওটি সর্বশেষ কবে কী পরিমাণ তহবিল পায় এবং এর কত অংশ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ব্যবহার করা হয়েছে তাও খুঁজে দেখা হচ্ছে। ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র থাকতে পারে এমন কোনো বিষয়কে তারা সন্দেহের বাইরে রাখছেন না।

সিজারি তাভেল্লা যে এনজিওর কর্মী সেই সংস্থার গোড়ার খবরও নিচ্ছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে সংস্থাটির কর্মকাণ্ডও। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, কূটনীতিক পাড়ার সব কটি পয়েন্টের সিসি টিভির ফুটেজ হাতে নেয়া হয়েছে। ওই সব ফুটেজে অন্তত ৬০ থেকে ৭০টি মোটরসাইকেলকে যাতায়াত করতে দেখা যায়। এর মধ্যে ৫টি মোটরসাইকেলকে সন্দেহের সংক্ষিপ্ত তালিকায় আনা হয়েছে। এই ৫টি মোটরসাইকেলের মধ্যে খুনিদের ব্যবহৃত দুটি মোটরসাইকেল শনাক্ত হতে পারে বলে আশা করছেন তদন্তে নিয়োজিত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত গুলশানের চেকপোষ্টগুলোতে একাধিক আরোহী থাকলে মোটরসাইকেল থামানো হয়। খুনিদের সঙ্গে থাকা মোটরসাইকেলটি আসলে কোন চেকপোস্ট ভেদ করে এসেছে, কোন ভবনের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সরকারের একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসা কয়েকটি ফোনকল খতিয়ে দেখছে। একই সঙ্গে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতার ফোনালাপের সূত্রগুলো থেকে আকার ইঙ্গিতে কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা সেটিও তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।

ওই গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে নিয়োজিতদের ইতিমধ্যে জানিয়েছে, তাদের কাছে মনে হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশে আসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিয়ে যে আপত্তি তোলা হয়েছে এর সঙ্গে তাভেল্লা হত্যার এক ধরনের যোগসূত্র থাকতে পারে। কারণ একই সময়ে দুটি বিষয় উঠে এসেছে। আর তার পরপরই গুলশানে বিদেশী নাগরিক খুনের ঘটনা ঘটিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়েছে।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের ছায়া তদন্তকারী সংস্থা র‌্যাবের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা করে কোন সড়ক দিয়ে মোটরসাইকেল দুটি বেরিয়ে গেছে এর খোঁজ করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা সর্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছি। সেই প্রযুক্তির সঙ্গে কয়েকটি ক্লু মিলিয়ে দেখা হচ্ছে। গোয়েন্দাদের প্রাথমিক ধারণা, সরকারবিরোধী নাশকতাকারীরা তাদের অপরাধের ‘প্যাটার্ন চেঞ্জ’ করে থাকতে পারে। আর এই প্যাটার্নের প্রধান বলি হতে পারেন বিদেশী নাগরিক তাভেল্লা।

সোমবার সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বর সার্কেলের ৯০ নম্বর সড়কে খুন হন ইতালির নাগরিক সিজারি তাভেল্লা। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি এনজিওর প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন।-যুগান্তর
১ অক্টোবর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে