মতিউর রহমান চৌধুরী, লন্ডন থেকে : দরজা খোলা ছিল ইউরোপের। সবার জন্য, সব মতের জন্য। জাতি, ধর্ম, বর্ণ এর কোনো বাছবিচার ছিল না। উদার সংস্কৃতির কারণে দুনিয়াকে টানতো ইউরোপ। এখন সে ইউরোপেই দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক সন্ত্রাস ইউরোপের জনপদকে কাবু করে ফেলছে। এক অজানা, অচেনা আতঙ্ক ভর করেছে।
ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস তৈরি করেছে জাতিতে জাতিতে। অবশ্য মুসলিমরা এখন বেশি চাপের মুখে। তাই মুসলিম মহিলাদের পোশাক- বোরকা, হিজাব, নেকাব আর বুরকিনি এক আতঙ্কের তকমা পেয়ে গেছে। এ কারণে দেশে দেশে নিষিদ্ধ হচ্ছে বোরকা, হিজাব, নেকাব আর বুরকিনি। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় বুরকিনি। ফ্রান্স নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আদালতও সায় দিয়েছে। জরুরি অবস্থা থাকায় আইনের কোনো সংশোধন করতে হয়নি।
বুরকিনি কী- আমাদের পাঠকদের মধ্যে হয়তোবা প্রশ্ন থাকতে পারে। কারণ এই পোশাকের সঙ্গে আমরা পরিচিত নই। আসলে এটা হচ্ছে সাঁতার কাটার একটি পোশাক। মুখ খোলা রেখে পুরো শরীর ঢেকে সাঁতার কাটা যায়- এভাবেই ফ্যাশনকর্মীরা তৈরি করেছিলেন পোশাকটি। ফরাসি মুসলিম মহিলাদের কাছে এটা ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। কান সমুদ্র সৈকতে মহিলারা অনায়াসেই এই পোশাক পরে সাঁতার কাটতে পারতেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কয়েকটি জঙ্গি হামলা ফরাসি সরকারকে ভাবনার মধ্যে ফেলে দেয়।
বোরকা আগেই নিষিদ্ধ ছিল ফ্রান্সে-২০১০ সন থেকে। অতি সম্প্রতি নিষিদ্ধ হলো বুরকিনি। মুক্ত চিন্তার দেশ ফ্রান্স। অবাধ স্বাধীনতায়ও বিশ্বাসী দেশটি। অনেকটা বাধ্য হয়েই এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে- এমনটাই বলছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। চারটি শহরে নিষিদ্ধ হয়েছে বুরকিনি।
নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বুরকিনি পরে সাঁতার কাটতে যাওয়ায় চার মহিলাকে জরিমানাও গুনতে হয়েছে। ফ্রান্সের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অনেকেই বলতে চেষ্টা করছেন, এ সিদ্ধান্ত হয়েছে রাজনৈতিক মতলবে। আগামী বছর অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে ফ্রাসোয়া ওঁলাদের সরকার এ থেকে ফায়দা তুলতে চান।
কিন্তু ফরাসি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশটি সত্যিই জঙ্গি হুমকির মধ্যে রয়েছে। মনে রাখতে হবে, একের পর এক জঙ্গি হানা দেশটির গতি থমকে দিয়েছে। অর্থনীতি পড়েছে চাপের মুখে। পর্যটনে দেশটি বিশ্ব লিডার। জঙ্গি হামলার কারণে পর্যটন ব্যবসায় ধস নেমেছে। প্রতি বছর ৮৩ মিলিয়ন পর্যটক ফ্রান্সে ভ্রমণ করতে যান। এখন অনেক পর্যটক ভিন্ন গন্তব্যে যেতে শুরু করেছেন।
ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টেরেন্স জি পিটারসন (যিনি ফ্রান্স বিষয়ে এবং মুসলিম দুনিয়া সম্পর্কে গবেষণা করেছেন) নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, একটা ছোট্ট ইস্যু। এ নিয়ে তারা লড়াই করছে। আসলে ফ্রান্সের পরিচয়টাই বা কি? জার্মানি ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল এসবে আমলই দিতেন না। হাজারও সমালোচনার মুখে ১০ লাখ শরণার্থীকে জায়গা দিয়েছেন। শুধু কি তাই?
প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিরোধী বন্ধুরা জেনে রাখুন, শরণার্থীরা এদেশে সন্ত্রাস নিয়ে আসেনি। গেল সপ্তাহে এক বাক্যে বোরকা নিষিদ্ধের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। বলেন, এটা নিষিদ্ধ করতে হলে জার্মান সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। কারণ জার্মান সংবিধানে সব ধর্মের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে। বোরকা তো একটি ধর্মের অংশ।
তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টমাস ডি মেইজিয়ের আরেক দফা এগিয়ে বলেন, সবকিছু বন্ধ করা যায় না। বন্ধ করা সমাধানও নয়। এটা বলার এক সপ্তাহের মধ্যেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ক্ষমতাসীন খ্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টির নির্বাহী কমিটি সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
কারণ, জনমত তৈরি হয়েছে, বোরকা নিষিদ্ধ করার পক্ষে। তাছাড়া, বিরোধীরা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। দেশটিতে নির্বাচন আগামী বছর। তাই সম্ভবত, অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ঝুঁকি নিতে চান না। এ কারণে বোরকা আংশিক নিষিদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও গাড়ি চালনার সময় বোরকা, হিজাব ও নেকাব পরা চলবে না। জার্মান বিচার অ্যাসোসিয়েশন চেয়েছিল, বিচারকাজের সময় কোনো মহিলা স্কার্ফ পরতে পারবে না। কিন্তু সরকার তাতে সায় দেয়নি।
জার্মান চ্যান্সেলর একাধিকবার বলেছেন, আমরা এমন এক সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করি, যেখানে একে অপরের সঙ্গে কথা বলা, চেহারা দেখা এরই অংশ। মুখ ঢেকে, শরীর ঢেকে থাকলে মনে হয় জার্মান সংস্কৃতিকেই অবজ্ঞা করছেন। বৃটেন এসবের বাইরে। গণতন্ত্রের সূতিকাগার বৃটেন। কেউ কেউ গণতন্ত্রের মক্কাও বলে থাকেন। এখানে সব মতেরই স্থান রয়েছে। দেশটি জঙ্গি নিশানার মধ্যেও রয়েছে। বোরকা, হিজাব বা নেকাব তারা নিষিদ্ধ করেনি। যদিও চাপ রয়েছে তেরেসা মে’র সরকারের ওপর।
চ্যানেল ফোরের প্রেজেন্টার ফাতিমা মঞ্জি হিজাব পরে খবর পড়ায় সমালোচনার মধ্যেই পড়েছিলেন। সেটা অবশ্য বেশিদূর এগোয়নি। বৃটেনের উদার সংস্কৃতি তাকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। তার পাশে রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ দাঁড়িয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তো এক ধরনের বিপ্লব হয়ে গেছে। আর বৃটেনের জনগণ! তারা তো এটাকে পাত্তাই দেয়নি।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রধান বলেছেন, কখন হামলা হবে- এটা বড় কথা নয়। হামলা হবে এটাই বড় কথা। সশস্ত্র পুলিশ লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় মোতায়েন করা হয়েছে। ব্রেক্সিটের পর হিংসা-বিদ্বেষজনিত অপরাধ বেড়েছে। যদিও এ পরিস্থিতি ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বৃটেন কী সিদ্ধান্ত নেয়- সেটাই দেখার বিষয়। পরিস্থিতি এমনই চাদের মতো একটি ছোট দেশেও বোরকা নিষিদ্ধ হয়েছে। যেখানে মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই মুসলমান।
বেলজিয়াম, ক্যামেরুন, নাইজার, কঙ্গো ও সুইজারল্যান্ডে বোরকা নিষিদ্ধ রয়েছে। নেদারল্যান্ডস ও স্পেনে আংশিক নিষিদ্ধ। ২০১৩ পর্যন্ত তুরস্কে নিষিদ্ধ ছিল। এখন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। তুরস্কে এখন কোনো মহিলার মুখ দেখা যায় না। যেমনটা দেখা যায় না আফগানিস্তানে। এক দশক আগে, আফগানিস্তানে ব্র্যাক পরিচালিত একটি স্কুলে গিয়ে কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। ক্লাস চলছে, সবাই মহিলা। যিনি পড়াচ্ছেন তার চোখ-মুখও ঢাকা। ছাত্রীদের অবস্থাও এরকমই। মানবজমিন
২১ আগস্ট ২০১৬/এমটি নিউজ২৪/এসবি/এসএস