শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:৪৬:৪৮

তিন জঙ্গি আস্তানা এখন যে অবস্থায়

তিন জঙ্গি আস্তানা এখন যে অবস্থায়

মহিউদ্দিন অদুল ও বিল্লাল হোসেন রবিন : গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর জঙ্গিবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে রাজধানীর কল্যাণপুর, রূপনগর ও নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ তিন অভিযানে নিহত হয় গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীসহ জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত উগ্রপন্থিরা।

এ তিন অভিযানের পর মামলার তদন্ত ও নিরাপত্তার স্বার্থে ওই তিন বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয় পুলিশ। এখনও কড়া নিরাপত্তা বলয়ে রয়েছে বাড়ি তিনটি। কল্যাণপুরের জাহাজ বাড়ির বাসিন্দারা ঘটনার পর পরই ভবন ছেড়ে গেছেন। রূপনগরের বাড়িতে জঙ্গিদের ব্যবহৃত ফ্ল্যাটটি এখনও পরিত্যক্ত। একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের দেওয়ান বাড়ির ওই ফ্ল্যাটটিও।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ- কমিশনার (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, কল্যাণপুর ও রূপনগরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানের পর এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। তারা যাতে শঙ্কিত না হয়ে আশ্বস্ত হন, সেজন্য ঘটনাস্থলে দীর্ঘদিন পুলিশ মোতায়েন অব্যাহত রাখা হয়েছিল। কিন্তু ভবন পাহারায় পুলিশ মোতায়েন হয়নি। এখন যেসব ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ সরিয়ে নেয়া হবে সেখানে পুলিশি টহল অব্যাহত রাখা হবে।

সরজমিন দেখা গেছে, রূপনগরের ৩৩ নম্বর সড়কের প্রধান ফটক খোলা। সড়কের দু’পাশে বহুতল ও টিনশেড বাড়ির সারি। ঢুকেই হাতের বামের তৃতীয় বাড়িটিই ৩৪ নম্বর বাড়ি। পাশের সড়কে টহল পুলিশের তদারকি। সড়কটিতে তেমন লোক চলাচল নেই। সড়কটির বাসাবাড়ির পুরুষ ও নারীরা প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হচ্ছেন না। ৩৪ নম্বর বাড়ির পকেট গেটটি খোলা পাওয়া যায়। গেটের ভেতরে কোনো সাড়া-শব্দ নেই। নিস্তব্ধ পুরো ভবন। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দরজাই বন্ধ। ৬ তলা বাড়িটির প্রতি তলায় দুটো করে ফ্ল্যাট। দুই বেড, এক ডাইনিং, ড্রয়িং, কিচেন, বাথ ও বারান্দার বাসা। তবে পুরো তৃতীয় তলা জুড়ে একটি মাত্র ফ্ল্যাট।

তাতে থাকেন বাসার মালিক আবুল হাশেমের পরিবার। ঘটনার সপ্তাহখানেক আগেই তিনি স্ত্রী দেলোয়ারাকে নিয়ে হজে গেছেন। চতুর্থ তলার পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটটিও বাসার মালিক ব্যবহার করেন। আর ষষ্ঠ তলার পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটটিই দু’মাস আগে ভাড়া নিয়েছিল গত ২রা সেপ্টেম্বর পুলিশের অভিযানে নিহত জেএমবি’র প্রশিক্ষক জাহিদ। নিহত জাহিদের ফ্ল্যাটের দরজায় ঝুলছে তালা। দরজার উপরের অংশের কাঠ কিছুটা ভাঙা। ষষ্ঠ তলায় পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি বিভাগের ছাত্র উত্তম দাশ, নর্দান ইউনির্ভাসিটির শিক্ষার্থী কিশোর কুমার দাশ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস টেকনোলজির ছাত্র শৈবাল সৈকত শুভ।

তারা বলেন, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে ও ভবনের বাইরে যখন এই ঘটনা ঘটছিল আমরা তখনই তা টেলিভিশন দেখে জানতে পারি। অবশ্য গোলাগুলির শব্দ শুনেছি। একবার উঁকি দিতেই পুলিশের পরামর্শে দরজা বন্ধ করে দিই। পুলিশও নির্ভয় দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। দুই মাস আগে ওই লোক বাসায় উঠলেও কখনও তাকে দেখিনি। তাদের নিচে পঞ্চম তলায় থাকেন মুদি দোকানদার আব্দুস ছাত্তার। বাসার কাছেই তার দোকান। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটার জন্য তার সঙ্গে বাড়িটির সব ভাড়াটিয়ার প্রতিদিনই একাধিকবার যোগাযোগ হয়। দোকানের পাশাপাশি তার বাসায়ও ভবনের বাসিন্দারা নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তিনিও জাহিদকে দেখেননি। আব্দুস সাত্তার বলেন, দু’মাস আগে ওই ফ্ল্যাটে ভাড়াটিয়া আসার কথা শুনেছি, দেখিনি।

রূপনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ মো. আখতারুজ্জামান ইলিয়াছ বলেন, ঘটনার পর থেকে রূপনগর ৩৩ নম্বর রোডের ৩৪ নম্বর বাড়িতে পুলিশ মোতায়েন ছিল। ঈদের দিন অন্যত্র জরুরি নিরাপত্তা বিধানের প্রয়োজন পড়ায় সেখান থেকে প্রত্যাহার করে অন্যান্য স্থানে পাঠানো হয়েছে। তবে থানার টহল টিম নিয়মিতভাবে ওই এলাকায় টহল দিচ্ছে, যাতে স্থানীয়দের মাঝে আতঙ্ক না ছড়ায়।

এদিকে গত ২৫শে জুলাই রাতে কল্যাণপুরের ৫ নম্বর সড়কের পুলিশ ব্লক রেইড দেয়ার সময় সড়কটির ৫৩ নম্বর তাজ মঞ্জিলের পঞ্চম তলায় জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশ। পরদিন সকালে পুলিশের স্পেশাল উইপনস অব টেকটিকস (সোয়াট) টিমের এক ঘণ্টার অপারেশন স্টর্ম-২৬ এ ৯ জঙ্গি নিহত হয়। ওই সময় ছয়তলা বাসার প্রতিটি তলার ফ্ল্যাটের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে এই অভিযান পরিচালনা করায় ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেয়েছেন অন্য ভাড়াটিয়ারা। ঘটনার পর বাসা থেকে ৫২ জনকে আটক করে মিরপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে বাসার মালিক প্রবাসী আতাহার উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী মমতাজ পারভীন ও ছেলে মাজহারুল ইসলামকে ভাড়াটিয়াদের তথ্য না দেয়ার অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। এখনও তারা কারাগারে রয়েছেন।

ঘটনার পর এ বাড়ির ভাড়াটিয়ারা পর্যায়ক্রমে বাসা ছেড়ে দেন। সরজমিন দেখা গেছে, পুরো বাড়িটি দ্বিতীয় তলায় মালিকের ফ্ল্যাট ছাড়া বাকি সব ফ্ল্যাট ফাঁকা। দ্বিতীয় তলার বারান্দায় ঝুলছে ঘরের পর্দা ও কয়েকটি কাপড়। পাঁচতলার জঙ্গি আস্তানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জিনিসপত্র। প্রধান ফটকের ভেতরে দেখা গেছে ১০ জন পুলিশ সদস্যকে। যথারীতি জাহাজ বাড়ির সামনে ও পাশে কয়েকটি ‘ঘর ভাড়া’র সাইন বোর্ড ঝুলছে। জাহাজ বিল্ডিংয়ের সামনেই রয়েছে কাপড়ের দোকান ‘তাঁতি কুঠির’। দোকানটির মালিক জিনাত জাবিন বলেন, ৫ নম্বর সড়কটি আগে সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহার হলেও জাহাজ বিল্ডিংয়ে অভিযানের পর থেকে এখন পর্যন্ত সবাই সড়কটি এড়িয়ে চলছে।

সম্প্রতি জাহাজ বিল্ডিংয়ে পাহারারত পুলিশের সহকারী পরিদর্শক মাহফুজুল আলম বলেন, গত মাসের মাঝামাঝিতে জাহাজ বাড়ির ভাড়াটিয়ারা তাদের মালামাল নিয়ে গেছে। এখন প্রায় সব ফ্ল্যাট খালি। ভবনের সামনে বসে ২৪ ঘণ্টায় দু’শিফটে ১০ জন করে পুলিশ সদস্য পাহারায় আছি। তবে এখন এলাকাটি নিরিবিলি হয়ে গেছে।

এদিকে এখনো পুলিশ পাহারায় থাকা নারায়ণগঞ্জের দেওয়ান বাড়িতে ওই বাড়ির লোকজন ছাড়া অপরিচিত কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। তৃতীয় তলার নিহত জঙ্গিদের ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ। তিনজন করে পুলিশ সদস্য পালাক্রমে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছেন। তবে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে রাস্তার ব্যারিকেড। ফলে বাড়ির সামনে দিয়ে পথাচারীদের যাতায়াত ও এলাকার পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তিন তলা ভবনের প্রধান ফটকের সামনে একটি ছোট টিনের ঘরে দুই পুলিশ সদস্য বসে পাহারা দিচ্ছেন। টিনশেড রুমের ভাড়াটিয়ারা যে যার মতো করে আছেন। শুক্রবার বিকালে শহরের পাইকপাড়া বড় কবরস্থান শাহসুজা রোডের ৪১০/১ দেওয়ান বাড়ির সামনে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

গত ২৭ শে আগস্ট সকালে এই বাড়িতে পুলিশের স্পেশাল উইপনস অ্যান্ড টেকটিকস (সোয়াট) টিমের ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭’ পরিচালনা করেন। ওই অভিযানে মারা যায় গুলশান হামলার মাস্টারমাইন্ড কানাডাপ্রবাসী তামিম চৌধুরী ও তার দুই সহযোগী তাওসিফ হোসেন ও কাজী ফজলে রাব্বী। এরপরই আলোচনায় উঠে আসে বাড়িটি। লোহার গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই দুইপাশে বাড়াটিয়াদের ঘর ডিঙ্গিয়ে সোজা পূর্বদিকে গেলে হাতের বাম পাশে ভবনের অবস্থান।

এই ভবনের নিচতলার দুটি ফ্ল্যাটে কবির হোসেন ও সোলায়মান পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকে। কবির হোসেন একটি গার্মেন্টসে মেকানিক হিসেবে কাজ করেন আর সোলায়মান চটপটি বিক্রেতা। দ্বিতীয় তলার দুটি ফ্ল্যাট জুড়ে থাকেন বাড়ির মালিক নুরুদ্দিন দেওয়ান ও তার পরিবার। আর তৃতীয় তলায় উত্তর-পূর্ব দিকের ফ্ল্যাটটিতে থাকতো মাস্টারমাইন্ড নব্য জঙ্গি নেতা তামিম চৌধুরী ও তার দুই সহযোগী। যদিও দুই মাস আগে মুরাদ ও রনি পরিচয় দিয়ে দুই যুবক জুলাই মাসের প্রথমদিকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেয়।

ঘটনার দিন নুরুদ্দিন দেওয়ান গ্রেপ্তার হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে তার স্ত্রী রুনা আক্তার সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র এক আত্মীয়দের বাসায় আশ্রয় নেন। তবে ৮ই সেপ্টেম্বর সকাল থেকে তিনি বাড়িতে আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু বাড়িতে থাকছেন না বলে জানান বাড়ির ভাড়াটিয়া সোলায়মান।

তিনতলা ভবনের নিচতলার ভাড়াটিয়া সোলায়মান আরো জানান, ঘটনার দিন ও এরপরের কয়েকদিন ভয় ও আতঙ্ক ছিল। ঘটনার পর বাড়িওয়ালার স্ত্রী ৮ই সেপ্টেম্বর সকালে প্রথম এসেছেন। নিহত জঙ্গিরা যে ফ্ল্যাটে ছিলেন সেটা তালা মেরে রাখা হয়েছে।  বাড়ির ভাড়াটিয়া দিন ইসলাম। শহরের একটি হোসিয়ারিতে কাজ করেন। গত দুই বছর ধরে এই বাড়িতে আছেন। তিনি জানান, এখন আর পুলিশের কড়াকড়ি নেই। দুপুরে (৮ই সেপ্টেম্বর) বাসায় খেতে এসে দেখি বাড়ির সামনে পুলিশ নেই। রাস্তার ব্যারিকেড উঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

তবে ঘটনার দিন সকাল ৭টার দিকে পুলিশ আমাদের ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে। তবে যারা কাজে যেতে চেয়েছিল তাদের যেতে দিয়েছে। আমিও কাজে চলে যাই। কিন্তু ৩ জঙ্গি নিহত হওয়ার পর আমরা আর বাইরে থেকে ঘরে ঢুকতে পারিনি। দুই রাত বাইরে ছিলাম। এখন বাসায় স্বাভাবিকভাবেই আছি। এদিকে তিন জঙ্গি নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুর রাজ্জাক জানান, এখনো বাড়িটির পাহারায় ২৪ ঘণ্টা পুলিশ রয়েছে। তবে কবে নাগাদ পুলিশি পাহারা প্রত্যাহার হবে তা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন। এমজমিন
১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে